কে এম মাসুম বিল্লাহ
দৃষ্টিপাত
পে-স্কেল নিয়ে নতুন সরকারের ভাবা উচিত
১৯৭২ থেকে ২০১৫ সাল, ৪৩ বছরে মোট আটটি পে-স্কেল ঘোষণা, অর্থাৎ সাধারণ অঙ্কের মতো হিসাব কষতে বসলে গত ১০ বছরে প্রায় দুটি নতুন পে-স্কেল পাওয়ার কথা! সে ক্ষেত্রে একজন সরকারি চাকরিজীবী যিনি কি না নবম গ্রেড অর্থাৎ প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা তার বেতন স্কেল ২০১৫ সাল অনুযায়ী ২২ হাজার টাকা, দুটি পে-স্কেল পেয়ে তার বেসিক এখন প্রায় ৬৬ হাজার টাকা হওয়ার কথা ছিল! অঙ্কের হিসাবটি যদিও এখনকার বাসস্তবতায় কাল্পনিক মনে হচ্ছে, তবে ধারাবাহিকতা থাকলে সেটিই হওয়ার কথা ছিল, দুটি পে-স্কে সম্ভব না হলেও অন্তত একটি পে-স্কেল দিলেও তার বেসিক হওয়ার কথা ছিল ৪৪ হাজার টাকা! অর্থাৎ যে লোকটার বর্তমানে বাজার অনুযায়ী ৪৪ হাজার টাকা স্কেলে বেতন পাওয়ার কথা, তিনি এখনো ২২ হাজারে পড়ে আছেন এবং সে অনুযায়ী তার জীবনযাত্রা পরিচালিত হচ্ছে! একজন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী যিনি সর্বসাকল্যে ১৩/১৪ হাজার টাকা বেতন পান, তিনি এখন তার পরিবার ও সমাজের কাছে বোঝা! তবে গত দশ বছরে যে মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হলো, সেখানে আমরা কী পেলাম? এত এত উন্নয়ন দিয়ে কী হবে, যদি সমাজের একটি অংশকে তাদের প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত করা হয়!
২০১৫ সালে সর্বশেষ অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়, তবে ৯ বছর পার হলেও নবম জাতীয় পে-স্কেল এখনো আলোর মুখ দেখেনি। করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, এমনকি বিগত সরকারের নেওয়া মেগা প্রজেক্টের নামে হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির ফলে দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গিয়েছে। যার ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনী সব পণ্য বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় অধিকাংশ জিনিসপত্রের পাশাপাশি মাছ-মাংসের দাম স্বাভাবিকের তুলনায় গত দুবছরে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে! এ ছাড়া ভোজ্য তেলও দীর্ঘদিন ধরে সাধারণের মাথাব্যথার কারণ। বাজারদর বেড়ে যাওয়ায় সবকিছুতেই তার প্রভাব পড়েছে। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির ফলে চলাচলের ক্ষেত্রে বাস, ট্রাক, লঞ্চ এমনকি আলফা, মিশুকের ভাড়াও বাড়ানো হয়েছে ৫০-১০০ শতাংশ। সবকিছু মিলে সাধারণ জনগণ সত্যিকার অর্থেই সমস্যার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। বাজারে এই মুহূর্তে ৬০-৮০ টাকার নিচে কোনো সবজি পাওয়া দুষ্কর। মাছের দাম বেড়ে গেছে কয়েক গুণ, ইলিশ মাছের দাম তো ধরাছোঁয়ার বাইরে। ইলিশ যেন মধ্যবিত্তের বিলাসিতার শামিল! গরুর মাংস, খাসির মাংস কিংবা ইলিশ মাছ এখন নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্তদের জন্য দুরূহ। এক হাজার টাকা নিয়ে বাজারে গেলে ব্যাগভর্তি বাজার হয় না। এর মধ্যে বিগত সরকারের আমলে বাজার মনিটরিং ব্যবস্থায় পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না থাকায় মাঝেমধ্যেই কিছু কিছু নিত্যপণ্যের দাম উঠে গিয়েছিল আকাশচুম্বী! সেসব পণ্যের দাম এখনো কিন্তু কমেনি! এর বড় উদাহরণ হতে পারে ডিম! ফার্মের ডিম এখনো হালিপ্রতি ৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে! অথচ কিছুদিন আগেও তা ৩০-৩৫ টাকা ছিল! নিত্যপণ্যের দাম কোনোভাবেই এখন সহনীয় পর্যায়ে নেই। অসাধু ব্যবসায়ীরা এতে লাভবান হলেও পকেট ফাঁকা হচ্ছে সাধারণ চাকরিজীবীদের।
অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল অনুযায়ী সর্বনিম্ন ২০তম গ্রেডে ৮ হাজার ২০০ টাকা স্কেলে সর্বসাকল্যে ১২-১৩ হাজার টাকার মতো বেতন আসে। অথচ চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যেভাবে বেড়ে গেছে, তাতে ১২ হাজার টাকায় জীবনব্যয় মেটানো কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অষ্টম পে-স্কেল অনুসারে একজন প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা ২২ হাজার টাকা স্কেলে সর্বসাকল্যে ৩১/৩২ হাজার টাকার মতো বেতন পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া একজন দশম শ্রেণির কর্মকর্তা সর্বসাকল্যে ২৩-২৪ হাজার টাকা বেতন পেয়ে থাকেন, যা কি না একজন শ্রমিকের বেতনের চেয়ে খুব বেশি নয়! এমতাবস্থায় নিত্যপ্রয়োজনীয় সবকিছুর বাড়তি দাম, পাশাপাশি যানবাহনে অতিরিক্ত ভাড়া ও বাড়তি বাসাভাড়া দিতে গিয়ে তাদেরও হিমশিম খেতে হচ্ছে! বিশেষ করে গত দুবছর আগের তুলনায় এখন জীবনযাত্রার ব্যয় প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ বেড়ে গেছে, অথচ বেতন সেই একই থেকে গেছে। এতে করে মধ্যবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো হতাশায় দিন পার করছে। ২০১৫ সালে ২৩-২৪ হাজার টাকায় পরিবারের ভরণ-পোষণ সম্ভব হলেও ২০২৪ সালে এসে জীবনযাত্রার মান ও ব্যয় অত্যাধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এই সমপরিমাণ টাকায় এখন একটি পরিবারের ভরণ-পোষণ কোনোভাবেই সম্ভব না! এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান আরো কমে যাওয়া আগের তুলনায় একই টাকায় কম জিনিস পাওয়া যাচ্ছে, এতে করে চাকরিতে যারা নতুনভাবে যোগদান করছেন, তাদের জন্য টিকে থাকা কঠিন থেকে কঠিনতর হচ্ছে। যারা ১১-২০ গ্রেডের কর্মচারী আছেন, তাদের কথা বলাই বাহুল্য! এদের যেন দুর্দশার শেষ নেই।
১৯৭৩ সালে প্রথম পে-স্কেল দেওয়ার পর ২০১৫ সাল পর্যন্ত ৪২ বছরে আটবার পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রতি পাঁচ বছর পরপর পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছে। প্রথম পে-স্কেল থেকে অষ্টম পে-স্কেল পর্যন্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, প্রতি ৫-৬ বছর পরপর মাথাপিছু আয়, বাজার মূল্যের ওপর ভিত্তি করে নতুনভাবে পে-স্কেল দেওয়া হয়েছে। তবে ২০১৫ সালের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন মোড় নিয়েছে। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে যেখানে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১৪৬৬ মার্কিন ডলার। সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাথাপিছু আয় দাঁড়িয়েছে ২৮২৪ মার্কিন ডলার। অর্থাৎ গত আট বছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হলেও সে অনুযায়ী বেতন স্কেল সমন্বয় করা হয়নি। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, এ সময় কোনো পে-স্কেল দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া এ সময় বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করেছে, সে অনুযায়ী চাকরিজীবীদের বেতন সমন্বয় করা সময়ের দাবি। গত ১০ বছরে আমাদের গড় মাথাপিছু আয় দ্বিগুণ হয়েছে, দেশের জিডিপি বেড়েছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। তবে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সরকারি চাকরিজীবীরা। কারণ পে-স্কেল ঘোষণা না হওয়ায় তাদের ক্রয়ক্ষমতা খুব বেশি বৃদ্ধি পায়নি। তাই সমসাময়িক বাজারের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। এতে করে সামাজিকভাবেও পিছিয়ে পড়ছেন তারা। দেশের জিডিপি, মাথাপিছু আয় বাড়ার সুবিধা থেকে একাংশকে কেন বঞ্চিত করা হচ্ছে? অন্তত ১৯৭৩ থেকে ২০১৫ সালের গড় হিসাব করলে ২০১৫ সালের পর ন্যূনতম একটি পে-স্কেল পাওয়াটা একদমই যৌক্তিক ছিল। আর তাতে করে বাজারের সঙ্গে বেতন যদি সমন্বয় হতো, তবে সাধারণের কষ্ট অনেকটাই লাঘব হতো।
অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণার পর ১১-২০তম গ্রেডের বিভিন্ন বৈষম্য নিয়ে তখন আন্দোলন হয়। যদিও এর পরে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে নবম জাতীয় পে-স্কেলের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে। অষ্টম জাতীয় পে-স্কেলের ২০টি গ্রেডকে কমিয়ে ১০টি গ্রেডে নিয়ে আসা, বিভিন্ন গ্রেডের মধ্যে বৈষম্য কমিয়ে আনা ও ৪০ শতাংশ মহার্ঘ্য ভাতার দাবিগুলো উঠে আসছে তাদের আন্দোলনে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও মাথাপিছু আয় ও মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করে নবম জাতীয় পে-স্কেলের দাবি একান্তই যৌক্তিক। এ ছাড়া যত দিন পর্যন্ত না নবম জাতীয় পে-স্কেল বাস্তবায়ন করা যাচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত মহার্ঘ্য ভাতার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। এমতাবস্থায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির ফলে নতুন পে-কমিশন গঠনের মাধ্যমে নবম পে-স্কেল ঘোষণাসহ অন্যান্য বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে।
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারের ওপর মানুষের প্রত্যাশার শেষ নেই। এই মুহূর্তে অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ সবকিছুই বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ভুলে গেলে চলবে না, ছাত্র-জনতা ৫ আগস্ট যে বিজয় অর্জন করেছে, তার ভিত্তি ছিল বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। একশ্রেণির মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে, সে জন্য সরকারি চাকরিজীবীরা পে-স্কেলের মতো ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে, সেটা কখনোই কাম্য নয়। বাজারের সঙ্গে মিল রেখে পে-স্কেল ঘোষণার জন্য অবশ্যই নতুন সরকারের একটি কমিটি গঠন করা উচিত যারা সবকিছু পর্যবেক্ষণ করে একটি গ্রহণযোগ্য পে-স্কেল দিতে সক্ষম হবে।
লেখক : কলাম লেখক ও ব্যাংক কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক পিএলসি, চৌরাস্তা শাখা, পটুয়াখালী
"