মাছুম বিল্লাহ

  ০৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মতামত

মাধ্যমিকে বিভাগ বিভাজন প্রসঙ্গে

পূর্ববর্তী সরকারের তথাকথিত নতুন শিক্ষাক্রমে নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের বিভাগ বিভাজন অর্থাৎ বিজ্ঞান, মানবিক ও বাণিজ্য তুলে দেওয়া হয়েছিল। এর পেছনে শক্ত কোনো যুক্তি ছিল না। যে শিক্ষার্থী গণিত বুঝে না, তাকেও গণিত ও বিজ্ঞান পড়তে হবে, যে শিক্ষার্থীর গণিত, বিজ্ঞানে আগ্রহ বেশি তাকেও সাধারণ বিজ্ঞান অর্থাৎ বিজ্ঞানে যাদের আগ্রহ নেই, তাদের জন্য দায়সারা গোছের যে বিজ্ঞান সিলেবাস, সেই বিজ্ঞান পড়েই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। একইভাবে বাণিজ্যে পড়ার যাদের কোনোই আগ্রহ নেই, সবাইকে সেই বিষয় পড়তে হবে অর্থাৎ জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে হবে। এটি কোনো সুচিন্তিত মতামত নয়। আমি তৎকালীন মেম্বার কারিকুলামকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, বিজ্ঞান শিক্ষার্থীরা যদি বিজ্ঞানের বিষয় আরো বিষদভাবে জানত চান, তাদের সেটি করতে দেওয়া উচিত কিন্তু উনি উত্তরে বললেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান পড়ে আমাদের দেশকে সার্ভ করে না, তারা আমেরিকাকে সার্ভ করে। অতএব মাধ্যমিকে শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান পড়ার কোনো দরকার নেই। আমি এ কথার উত্তরে বলেছিলাম, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা আমেরিকা চলে যায় বলে তারা বিজ্ঞান পড়বে না? তার কোনো সদুত্তর পাইনি অর্থাৎ আমাদের কথার কোনো গুরুত্ব তাদের কাছে ছিল না। তারা দু-চারজন যা ভাবতেন তাই করতেন।

যাদের জন্য বিজ্ঞান, মানবিক, বাণিজ্য বিভাগ বা যাদের ছেলেমেয়ে এসব বিভাগে পড়বে, তাদের সঙ্গে কথা না বলে এনসিটিবির কয়েকজন মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, সবাইকে সব বিষয় পড়তেই হবে। যার সাহিত্য ও ইতিহাস ভালো লাগে কিন্তু বিজ্ঞানে আগ্রহ কম কিংবা বুঝে না তাদেরও বিজ্ঞান পড়তে হবে। বিষয়টি নিয়ে বারবার বলেছি, লিখেছি কিন্তু তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। তারা সবাইকে সব বিষয় পড়িয়ে পূর্ণজ্ঞানদান করার কথা বলেছিলেন। আমি বলেছিলাম, যে বিজ্ঞানে পড়েও অনেকে নিজ আগ্রহে সাহিত্য পড়েন কিন্তু জোর করে পড়ানো যায় না। এটি আমি প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি, অনেক মেডিকেলের শিক্ষার্থী, বুয়েটের শিক্ষার্থী নিজ আগ্রহে সাহিত্যের বহু বই পড়ে ফেলেছেন। এটি সবাই করবে না। কিন্তু যাদের আগ্রহ আছে, তারা করবেনই। তাই বলে জোর করে সবাইকে সবকিছু পড়তে বলার মানে হলো কুইনিন খাওয়ানো। দ্বিতীয়ত, উচ্চমাধ্যমিকে গিয়ে

হঠাৎ করে বিজ্ঞান, বাণিজ্য ও মানবিকে বিশাল সিলেবাস

অনুসরণ করতে পারা অনেক শিক্ষার্থীদের জন্য মানানসই হয় না, কারণ উচ্চমাধ্যমিকে সময় কম, বিষয় ও বিষয়ের

কনটেন্ট অনেক বেশি। ফলে, অনেকেই তা ডাইজেস্ট করতে পারে না। তাই ফল খারাপ করে। এসব কোনো চিন্তাই তাদের টাচ করেনি।

কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকার মাধ্যমিকে বিভাজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং ২০১২ সালের শিক্ষাক্রমের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনতে যাচ্ছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২ অনুসারে প্রণীত বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষাভিত্তিক পাঠ্যপুস্তকগুলোর একটি সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করা হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা এক শিক্ষাবর্ষের মধ্যেই পাঠ্যসূচিটি সম্পন্ন করতে পারেন। অর্থাৎ এখন যারা নবম শ্রেণিতে পড়েন, তারা বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাননি, তারা দশম শ্রেণিতে উঠে বিভাগ বিভাজনের সুযোগ পাবে, যেটি সংক্ষিপ্ত হবে। এটি একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত, যা শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষা-সংক্রান্ত ব্যক্তিদের দুশ্চিন্তাকে অনেকটাই লাঘব করবে। আরো বলা হয়েছে, শিক্ষাবিদ, শিক্ষাক্রম বিশেষজ্ঞ, মূল্যায়ন বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, সংশ্লিষ্ট প্রশাসক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও অভিভাবক প্রতিনিধিদের সহযোগিতায় ২০২৫ সালে পরিমার্জিত শিক্ষাক্রম চূড়ান্ত করা হবে, যা ২০২৬ সাল থেকে পরিপূর্ণরূপে কার্যকর করা হবে। এটিও চমৎকার প্রস্তাব, কারণ পূর্ববর্তী কারিকুলাম পরিবর্তন বা পরিমার্জনের সময় মুখচেনা কিছু শিক্ষাবিদ যাদের মাঠের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই, বর্তমান শ্রেণিকক্ষ সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই, তাদের নিয়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। আর বেশি সময়ই শিক্ষা প্রশাসকদের নিয়ে মিটিং করা হতো, যাদের বই সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না, কারণ এখানে অর্থের ব্যাপার আছে। আমরা আর একটি কথা ভুলে যাই যে, শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশি হচ্ছে শিক্ষক ও শিক্ষা গবেষকরা। কারণ তারা দীর্ঘদিন ধরে বিষয়টির সঙ্গে লেগে থাকেন, বলা যায় ৩০-৪০ বছর কিংবা সারাজীবন। শিক্ষা প্রশাসকদের কয়েক বছরের বিশেষ করে মন্ত্রণালয়ে যারা থাকেন। অথচ তাদের সিদ্ধান্তকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। তারা এক মন্ত্রণালয় থেকে আরেক মন্ত্রণালয়ে ঘুরতেই থাকেন, অতএব শিক্ষার সঙ্গে তাদের সম্পর্ক কিন্তু কম। অথচ পূর্ববর্তী কারিকুলামের কাজের সময় তারাই মিটিং, ওয়ার্কশপে থাকতেন। আবার মাউশি ও এনসিটিবিতে যেসব শিক্ষক ডেপুটেশনে বা বদলি হয়ে আসেন, তারাও কিন্তু বই, কারিকুলাম, শ্রেণিকক্ষ এগুলোর কথা ভুলে যান। তারা শিক্ষকের চেয়ে কর্মকর্তা পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বই পড়া, শ্রেণিকক্ষের অবস্থার কথা কিন্তু তারা ভুলে যান। এই শ্রেণিকেও গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলোয় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। এগুলো সবই কিন্তু ভুল ও আংশিক সিদ্ধান্ত। তাই, বর্তমান সরকার যা বলেছে তা যুক্তিযুক্ত।

জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২ ও নতুন পুস্তক মুদ্রণ এবং চলমান মূল্যায়ন পদ্ধতি-সংক্রান্ত জরুরি নির্দেশনাবিষয়ক এ পরিপত্রে বলা হয়, জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০২২-এর বিষয়ে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা তথা অংশীজনদের অভিমত, গবেষণা ও জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নে শিক্ষকদের অপ্রয়োজনীয় প্রস্তুতির ঘাটতি, পাঠ্য বিষয়বস্তু ও মূল্যায়ন পদ্ধতি সম্পর্কে অস্পষ্টতা ও নেতিবাচক ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার প্রকট অভাব ইত্যাদি নানা বাস্তব সমস্যা বিদ্যমান থাকায় ওই শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নযোগ্য নয় মর্মে প্রতীয়মান। এই বিষয়টিও আমরা বারবার বলেছিলাম, মাঠের চিত্র ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে সিদ্ধান্ত নিতে কিন্তু তারা কেউই কর্ণপাত করেননি। নির্দেশনায় বলা হয় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে চলমান পাঠ্যপুস্তকগুলো ২০২৪ সালব্যাপী বহাল থাকবে। ২০২৫ সালে যথাসম্ভব সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করা হবে। ২০২৪ সালের অবশিষ্ট সময়েও বার্ষিক পরীক্ষায় ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের সংশোধিত ও পরিমার্জিত মূল্যায়ন পদ্ধতিতে মূল্যায়ন করা হবে এবং তার একটি রূপরেখা শিগগিরই বিদ্যালয়ে পাঠানো হবে। ছয় মাস পরপর একটি করে লিখিত পরীক্ষা হবে এবং প্রশ্ন হবে সৃজনশীল। রূপরেখাটি বিদ্যালয়ে পাঠানোর সঙ্গে সমস্ত মিডিয়ায় বেশি বেশি প্রচার করতে হবে, যাতে সবাই বিষয়টি ভালোভাবে জানতে ও বুঝতে পারে। শ্রেণি কার্যক্রমসমূহ নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির প্রতিটির ৬টি করে বিষয়ভিত্তিক যে মূল্যায়ন কার্যক্রম অসম্পন্ন রয়েছে, সেগুলো আর অনুষ্ঠিত হবে না। এই সিদ্ধান্তটি দিতে মন্ত্রণালয়ের একটু বিলম্বই হয়েছে, কারণ বিদ্যালয় খোলার পর বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সবাই উদ্বেগের মধ্যে ছিলেন এবং আমরা বিষয়টির সিদ্ধান্ত দ্রুত জানানোর জন্য অনুরোধ করেছিলাম। যেসব শিক্ষার্থী ২০২৫ সালে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হবে, তাদের জাতীয় শিক্ষাক্রম-২০১২-এর আলোকে প্রণীত শাখা ও গুচ্ছভিত্তিক সংশোধিত ও পরিমার্জিত পাঠ্যপুস্তকগুলো (বর্তমানে অর্থাৎ ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে ব্যবহার করছেন) দেওয়া হবে। এই শিক্ষার্থীরা নবম ও দশম শ্রেণি মিলিয়ে দুই শিক্ষাবর্ষে সম্পূর্ণ পাঠ্যসূচি শেষে ২০২৭ সালের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করবে। নতুন কারিকুলামে ছিল, শুধু দশম শ্রেণির সিলেবাসে শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষা হবে, সেটিও পরিবর্তন হলো।

নির্দেশনায় প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়... প্রাথমিক স্তরে প্রাক-প্রাথমিক, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এবং প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে ধারাবাহিকতা রেখে ইতিমধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যবইগুলোর পাণ্ডুুলিপি প্রয়োজনীয় সংশোধন ও পরিমার্জন করে মুদ্রণ করা হবে। নতুন কারিকুলাম যে গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে এবং এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়, সেটি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়, যেজন্য আমরা মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ জানাই। শিক্ষার এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এত সহজে অনুধাবন করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

লেখক : শিক্ষাবিশেষজ্ঞ ও গবেষক

(সাবেক ক্যাডেট কলেজ, রাজউক কলেজের শিক্ষক, চিফ অব পার্টি ব্র্যাক এডুকেশন এবং কান্ট্রি ডিরেক্টর-ভাব বাংলাদেশ)

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close