বিপ্লব বড়ুয়া
দৃষ্টিপাত
পরিবারই মূল্যবোধের ভিত্তিভূমি
পরিবার হচ্ছে নীতিনৈতিকতার প্রথম চর্চাকেন্দ্র ও মূল্যবোধের ভিত্তিভূমি। পরিবারের ওপর নির্ভর করে সন্তান কোন আদর্শে নিজেকে গড়ে তুলবে। এরপর আসে শিক্ষক। শিক্ষক হচ্ছেন গুরুজন। গুরুজনের আনুকূল্য ছাড়া ব্যক্তিজীবনে সফল হয়েছে- এ রকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। বাবা-মায়ের পরে যার স্থান তিনি হচ্ছেন শিক্ষাগুরু। সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকে আদর, স্নেহ, ভালোবাসা, শাসন, নীতিনৈতিকতা শেখানোর প্রথম ধাপ শুরু হয় মা-বাবার কাছ থেকেই। এরপর দ্বিতীয় ধাপে যার স্থান তিনি হচ্ছেন, শিক্ষক বা শিক্ষাগুরু। স্কুলের বাইরেও প্রতিনিয়ত যে শিক্ষকদের সংস্পর্শে গিয়ে শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নীতিবোধ সম্পর্কে জ্ঞানদান করেছেন, সেসব শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের কথা স্মরণ করা প্রত্যেক ছাত্রেরই কর্তব্য। নিজেকে একজন সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে শিক্ষকদের অবদানের অন্ত নেই। এত বছর পর্যন্ত শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের আমরা সেভাবেই সম্মান দিয়ে আসছি। হঠাৎ বর্তমান সময়ের নবপ্রজন্মের শিক্ষার্থীদের হাতে শিক্ষাগুরু, শিক্ষকসমাজ নিগৃহীত হতে দেখে হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই শিক্ষক নির্যাতনের খবর দেখে অশ্রু সংবরণ করা যাচ্ছে না। এর আগে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটলেও লাগাতার এমন ঘটনা আগে কখনো দেখা যায়নি। এতে করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে দূরত্ব বেড়ে যাবে। আধুনিক বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষের সময়ে এ রকম ঘটনার সাক্ষী হতে হবে, তা কখনো ভাবিনি।
আমাদের দেশের মানুষ যত না বাবা-মা কিংবা শিক্ষাগুরুর আদেশ মানেন, তার চেয়ে বেশি ধারণ করেন ধর্মগুরুদের কথা। প্রত্যেক ধর্মেই বর্তমানে এ অবস্থা বিরাজমান। তাই স্বভাবতই ধর্মগুরুদের কদর বেশিই বলা যায়। তারা বুঝতে চেষ্টা করে না যে ধর্ম ব্যাপারটি ‘আপেক্ষিক’ একটি দিকনির্দেশনা মাত্র। যেটি আচরণ তথা ধর্মীয় বিধিবদ্ধের মধ্যে সীমাবদ্ধ। অতীব দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আজকাল প্রত্যেক ধর্মে ধর্মীয় শিক্ষা দিতে গিয়ে ধর্মীয় বিভেদকে উসকে দিতে দেখা যায়। মুখের কথা আর অন্তরের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য নেই। তাই অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদের বিস্তার ঢুকিয়ে দিচ্ছে শিক্ষার্থীদের মনন ও চেতনায়। এর থেকে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে। ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ‘উন্নতি হচ্ছে, তবে বৈষম্য বাড়ছে’ বিষয়ের এক প্রবন্ধে লিখেছেন- দেশে তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। তিন ধারার মধ্যে দুই ধারা- ইংরেজি ও মাদরাসা। দুটি কৃত্রিম, অসম্পূর্ণ এবং দুটির মধ্যেই মাতৃভাষার চর্চার অভাব। দুটিই আমাদের স্থানীয় ইতিহাস, পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি প্রবন্ধে উল্লেখ করেন, মাদরাসা শিক্ষার সঙ্গে ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষার মূল মিল হলো উভয়েই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে।
দেশের মূল সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মানে বিপথে পরিচালিত হওয়া। এতে করে তাদের মন থেকে দেশাত্মবোধ ক্রমেই হারিয়ে যায়। ফলে একসময় সেই তরুণদের একটি অংশ মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, অন্য আরেকটি অংশের ধর্ম হয়ে ওঠে প্রধান অস্ত্র। তারা মনে করে ধর্মই তাদের রক্ষা করতে পারবে। পরিবারও মনে করে তা। সে কারণে তাদের মা-বাবারা অতি উৎসাহে সন্তানদের ঠেলে দেয় ধর্মীয় জীবনযাপনে। এভাবে একসময় সন্তানরা শেখর থেকে হারিয়ে গিয়ে বৈষম্যের বেড়াজালে বেড়ে ওঠে। আমি শিক্ষক নই কিন্তু একসময় অসংখ্য শিক্ষকের ছাত্র ছিলাম। বড় হওয়ার পর পেশাগত জীবনে আমি যাদের কাছ থেকে কিছু না কিছু শেখা বা জানার জন্য সংস্পর্শ লাভ করেছি, প্রত্যেককে একইভাবে আমি শিক্ষগুরু হিসেবে সম্মান করি। এই সম্মানের অর্থ হচ্ছে কৃতজ্ঞতাপরায়ণ হওয়া। কৃতজ্ঞতাপরায়ণ না হলে একজন মানুষ কখনো উদার মনের মানুষ হতে পারে না। মানুষ হয়ে মানুষের উপকার করতে পারে না, মানবিকতাবোধ জন্ম নেয় না। একজন সহজ-সরল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হতে হলে তাদের মধ্যে এই গুণাবলিগুলো অবশ্যই থাকতে হবে। আজ একশ্রেণির লোক মানুষ হয়ে পশুর মতো আচরণ করছে, কথায় কথায় অপদস্থ, হেনস্তা করছে, যেটি একজন সত্যিকারের মানুষের কখনো কাম্য নয়। সব ধর্মের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থে সমস্ত প্রাণীর চেয়ে মানবজাতিকে শ্রেষ্ঠ বলার কারণ কারণ হচ্ছে, মানুষের মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত আছে বলেই। এই মনুষ্যত্ব বা বিবেক যাদের মধ্যে লোপ পায় তারা হিংস্র হয়ে ওঠে। পশুর মতো আচরণ করে।
দেশব্যাপী মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষক সমাজ একশ্রেণির উচ্ছুঙ্খল শিক্ষার্থীর কাছে যেভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে, সেই ধারাবাহিকতা এখনো পর্যন্ত চলমান রয়েছে। তা দেখে একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে ভীষণ লজ্জাবোধ করছি। জোর করে পদত্যাগ করিয়ে মারধর করার ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে শোভা পাচ্ছে। যারা এই অঘটনগুলো করে চলেছে, তারা নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ইউনিফর্মধারী শিক্ষার্থী। যেসব শিক্ষক শিক্ষার্থীদের চাপে পদত্যাগ করতে অপরাগতা জানিয়েছেন, তাদের ওপর চালানো হয়েছে মানসিক নির্যাতন। ভিডিওতে একজন পুরুষ শিক্ষককে দৌড়ায়ে দৌড়ায়ে উল্লাস করে করে আঘাত করতে দেখা যায়। এক শিক্ষার্থীকে বলতে শোনা যায়, আজ দীপক স্যারকে মারতে পেরে খুব ভালো লাগছে। ছিঃ কী লজ্জার কথা। এই দীর্ঘজীবনে শিক্ষাগুরুদের নিয়ে এ জাতিয় কথা কোনো দিন শুনিনি।
দীপক চৌধুরী সিলেটের একটি স্কুলের শিক্ষক। কুড়িগ্রাম সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রুখসানা পারভীনকে প্রথমে অন্য স্কুলে বদলি করা হলেও পরে ওএসডি করা হয়। বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুক্লা রাণী হালদার ‘পদত্যাগ করলাম’ এই দুটি শব্দ লিখে শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে সড়ে পড়েন। একই কায়দায় সড়ানো হয়েছে ঢাকার আজিমপুর সরকারি বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজের অধ্যক্ষ গীতাঞ্জলি বড়য়াকে। এ রকম দেশের বহুস্থানে দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি অতি-উৎসাহী অভিভাবক ও বহিরাগতদের যোগ দিতে। শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলে মারধর করে শিক্ষার্থীদের নৈতিক স্খলন ঘটেছে। বিকৃতরুচির পরিচয় দিয়েছে। সুশিক্ষা যে কোথায় গিয়ে ঠেকেছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এ রকম কর্মকাণ্ড পুরো জাতির জন্য অশনিসংকেত হয়ে দাঁড়িয়েছে। উচ্ছৃঙ্খল বেপরোয়া শিক্ষার্থীদের হাত থেকে শিক্ষকসমাজের সম্মান রক্ষার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গত ২৭ আগস্ট সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ জারি করে। নির্দেশ জারির পরও থেমে নেই, যা চরম ধৃষ্টতার শামিল!
দোষে-গুণেই মানুষ। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। শিক্ষকদেরও ভুল থাকতে পারে। তার অর্থ এই নয় যে, শিক্ষার্থীরা আইনকে অবজ্ঞা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করবে! আইনকে নিজেদের হাতে তুলে নেবে! তারা সুনির্দিষ্ট শিক্ষকের ব্যাপরে যদি অভিযোগ থাকে, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে, তাদের দাবি-দাওয়া পেশ করতে পারে। তারা পারে না কোনো অবস্থায় শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলতে, টেনেহেঁচড়ে চেয়ার থেকে তোলে, ভুয়া ভুয়া ধুয়া তোলে, দস্তখত নিয়ে পদত্যাগ করাতে। এটি গোটা আইনিব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল! শিক্ষা হচ্ছে একটি জাতির মেরুদণ্ড। এই মেরুদণ্ডের একটি অন্যতম অঙ্গ হচ্ছে সম্মানিত শিক্ষকসমাজ। এই কদিনে শত শত শিক্ষক চরমভাবে লাঞ্ছিত হয়েছে। শিক্ষাঙ্গন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। শিক্ষকরা মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। সরকারের উচিত শিক্ষকসমাজের প্রতি সদয় হয়ে এর একটি সুন্দর সম্মানজনক বিহিত করা। শিক্ষকরা হচ্ছে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, সেখানে যদি কোনো তৃতীয়পক্ষ এসে হয়রানি, নাজেহাল, নির্যাতন করে, সেটির কালিমা সরকারের ওপরই বর্তায়। শিক্ষকরা দেশ ও সমাজের অগ্রগামী ব্যক্তিত্ব, আলোর পথের যাত্রী, এরা কারো মা, কারো বাবা, কারো ভাই, কারো বোন একটি পরিবারের অভিভাবক, সমাজের মর্যাদাশীল ব্যক্তি। শিক্ষকসমাজের ওপর থেকে পশুবৃত্তি আচরণ বন্ধ হোক। মূলবোধের জাগরণ ঘটুক সর্বত্র।
লেখক : সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক
"