মাকসুদা আক্তার
মুক্তমত
বাংলার অসাম্প্রদায়িক সাহিত্য মানব নজরুল
বাংলাদেশের জাতীয় কবির আসনটি যিনি নির্দ্বিধায় দখল করে আছেন, তিনি পশ্চিমবঙ্গের চুরুলিয়ায় জন্ম নেওয়া সাহিত্যিক কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-৭৬)। পিতার দরিদ্রতা তাকে স্পর্শ করলেও সেই দারিদ্র্য তাকে নিচু করেনি বরং করেছে মহান। জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়েও নিজের স্বাতন্ত্র্যবোধ নিয়ে সব সময়ই মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছিলেন। কি সাহিত্য, কি জীবন সব জায়গাতেই অসাম্প্রদায়িক ভাবনাকে করেছিলেন অঙ্গের ভূষণ। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে লেখা শুরু করে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে এসে নজরুলের কলম থেমেছে। কিন্তু এই অন্তর্বর্তী সময়েই নিজের স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য দিয়ে মানুষের উত্তপ্ত হৃদয়কে স্পর্শ করতে পেরেছিলেন নজরুল। তীব্র লেখনীঘাতে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে ধ্বজাধারীদের মুখোশ খুলে দিয়েছেন।
নজরুলের লেখায় হিন্দু-পুরাণ ঐতিহ্য যেমন ব্যবহৃত হয়েছে, তেমনি মুসলিম ঐতিহ্য ও গ্রিক পুরাণও জায়গা পেয়েছে। এর পেছনে তার জীবনের নানা চড়াই-উতরাই হয়েছিল উত্তম সঙ্গী। নজরুলের পিতা গ্রামের একটি মসজিদের খাদেম ছিলেন। ছোটবেলায় যে মক্তবে পড়াশোনা করেছেন, সেখানেই পরে পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়ে কাজে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। ইসলামি ইতিহাস, ঐতিহ্য জানার প্রাথমিক আঁতুড়ঘর বলা যায় তার শৈশবকে। কিন্তু সদা বোহেমিয়ান জীবনের প্রতি যার লোভ সে তো এক মসজিদের গণ্ডিতে আটকে থাকতে পারে না। ১২ বছর বয়সে নজরুল লেটোর দলে যোগ দিলেন। সেখানেই তার হিন্দু পুরাণ-মহাভারত, রামায়ণ, ভগবদ পুরাণের দীক্ষা গ্রহণ। লেটোর দলে নৃত্য ও গান আয়ত্ত করার সঙ্গে তিনি গান লিখতেনও। এরপর বাংলার নানা জায়গায় তার পদচারণা ঘটে।
সমাজের অন্যায়, অবিচার দেখে তিনি ক্ষুব্ধ হতেন। সেই ক্রোধের অগ্নিশিখায় একের পর এক রচনা করেছেন অগ্নিবীণা (১৯২২), দোলনচাঁপা (১৯২৩), বিষের বাঁশি (১৯২৪), ভাঙার গান (১৯২৪), সাম্যবাদী (১৯২৫), ঝিঙে ফুল (১৯২৬), সিন্ধু হিন্দোল (১৯২৮) ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ। বাঁধনহারা (১৯২৭), মৃত্যুক্ষুধা (১৯৩০) ও কুহেলিকা (১৯৩১) তার উপন্যাস। এ ছাড়া কিছু গল্প, নাটক ও প্রবন্ধও তিনি লিখেছেন যেগুলোর মূল সুর অসাম্প্রদায়িকতা।
‘অগ্নিবীণা’ নজরুলের অসাম্প্রদায়িকতার সর্বোত্তম প্রকাশ। এই কাব্যের মূল সুর ‘পুরাতনকে ধ্বংস করে নতুন সৃষ্টির প্রেরণা’। ভারতীয় পুরাণের নিপুণ ও শৈল্পিক ব্যবহার হয়েছে ‘অগ্নি-বীণা’র প্রথম দিকের কবিতা প্রলয়োল্লাস, বিদ্রোহী, রক্তাম্বরধারিনী মা, আগমনী প্রভৃতিতে। আবার অগ্নিবীণার শেষের দিকের কাব্য শাত-ইল-আরব, কারবালা, মহররম, কোরবানি প্রভৃতিতে পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে নিপুণভাবে ব্যবহার করেছেন। নজরুল তার বিদ্রোহ প্রকাশের জন্য একদিকে ভারতীয় পুরাণ, অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস-ঐতিহ্য উভয়ই গ্রহণ করেছেন। অগ্নিবীণার ১২টি কবিতার নজরুল ভারতীর পুরাণ এবং পশ্চিম এশিয়ার ইতিহাস, ঐতিহ্য ব্যবহার করেছেন তরুণ সমাজকে বিদ্রোহী করে তোলার জন্য। নজরুল হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবাইকে জাগ্রত করতে চান। অগ্নিবীণা কাব্যেরই সম্প্রসারিত রূপ ‘বিষের বাঁশি’।
কবিতার পাশাপাশি উপন্যাসেও একই ভাব পরিলক্ষিত হয়। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসে পাঠক দেখতে পান খ্রিস্টান ও মুসলমানদের বসবাসের এক অসাম্প্রদায়িক নজির। উপন্যাসের প্রথমেই বলা হয়- কৃষ্ণনগরের চাঁদসড়কে মুসলমান, কনভার্টেড ক্যাথলিক খ্রিস্টান এবং দু-এক ঘর হিন্দুর বসবাস। পাশাপাশি বসবাস করা এসব ধর্মের মানুষগুলো ঝগড়া-ফ্যাসাদ করে আবার একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। প্যাঁকালের মা ও হিড়িম্বার একে অন্যকে মেরে ফেলার মতো ঝগড়া শেষে গর্ভবতী মেয়ের বিপদে আবার সেই হিড়িম্বার দ্বারস্থ হতে দেখা যায় তাকে।
প্রবন্ধ নজরুলের বিদ্রোহ ও অসাম্প্রদায়িকতা প্রকাশের অন্যতম মাধ্যম। তার যুগবানী (১৯২২), দুর্দিনের যাত্রী (১৯২৬), রুদ্র মঙ্গল (১৯২৭), ধূমকেতু (১৯৬১), রাজবন্দির জবানবন্দি (১৯২৩) ইত্যাদিতে প্রকাশ পেয়েছে হিন্দু মুসলমানের সম্প্রীতির গান। রুদ্র-মঙ্গলের হিন্দু-মুসলমান প্রবন্ধে তিনি স্পষ্ট বলে দেন, ‘অবতার-পয়গম্বর কেউ বলেননি, আমি হিন্দুর জন্য এসেছি, আমি মুসলমানের জন্য এসেছি, আমি ক্রিশ্চানের জন্য এসেছি। তারা বলেছেন, আমরা মানুষের জন্য এসেছি- আলোর মতো, সকলের জন্য’। অন্ধকার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামায় আলো জ্বালতে চেয়েছিলেন তিনি। যে আলোয় পথ দেখে মানুষ টিকি-দাড়িতে নয় বরং মনুষ্যত্ব হবে সবাইকে মূল্যায়নের মানদ-। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কারণে যে মৃত্যু প্রত্যক্ষ করেছেন নজরুল তার প্রতি ব্যথিত হয়েছেন, ধ্বংস চেয়েছেন সাম্প্রদায়িক হিংসার।
নজরুলের রচনা ছাড়াও তার ব্যক্তিগত জীবনেও তিনি অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা করেছেন। নিজে মুসলমান হলেও ১৯২৪ সালে বিয়ে করেছিলেন সনাতন ধর্মাবলম্বী আশালতা সেনগুপ্ত ওরফে প্রমিলাকে। সন্তানদের নামও রেখেছিলেন অসাম্প্রদায়িক ভাবধারা বজায় রেখে।
বিদ্রোহের আবেগ, স্বাধীনতার কামনা ও সাম্যের আকুতি নিয়ে নজরুলের মানসচেতনা সৃষ্টি করেছিল অসাম্প্রদায়িকতার বাস্তব মায়াজাল। অসমসাহসী, বীরযোদ্ধা নজরুল নারী-পুরুষ, ধর্ম-অধর্মের বন্ধন ছিন্ন করে এই পৃথিবীর মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে বেদনামুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষও জাতীয় কবির ভাবধারায় অসাম্প্রদায়িকতার গানে সুর মিলাবে এবং নতুন এক সাম্যের দেশ গড়ে তুলবে বলে প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
"