ফয়সাল বিন লতিফ

  ০৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

মুক্তমত

ইলিশ যেন মধ্যবিত্তের বিলাসিতা!

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। সববয়সি মানুষের কাছে মাছটি সমান জনপ্রিয়। ইলিশ নিয়ে বাঙালির আবেগ অন্য যেকোনো মাছের তুলনায় বেশি। মৌসুমে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ ধরা না পড়লেও, সেটি যেমন শিরোনাম হয়, তেমনি ঝাঁকে ঝাঁকে ধরা পড়লেও শিরোনাম হয়। যেখানে ২০ কেজি ওজনের বড় মাছ ধরা পড়লেও শিরোনাম হয় না। কিন্তু দুই কেজি ওজনের ইলিশ ধরা পড়লেই সেটি খবরে আসে। সর্বোপরি রাজনীতি, সামাজিক, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সর্বক্ষেত্রেই রয়েছে বাঙালির ইলিশ চর্চা। বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমারসহ দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে এ মাছটি ব্যাপক জনপ্রিয়। ইলিশের সবচেয়ে বড় আধার বাংলাদেশ। বৈশ্বিক ইলিশ আহরণের ৭০ শতাংশই হয় বাংলাদেশে। দেশের মোট মৎস উৎপাদনে ইলিশের অবদান প্রায় ১২ শতাংশ। জিডিপিতে ও ইলিশের অবদান প্রায় ১ শতাংশ। এরই ধারাবাহিকতায় ইলিশকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব কর্তৃপক্ষ।

এখন প্রশ্ন দাঁড়ায়, দেশের অধিকাংশ মানুষ কি ইলিশের স্বাদ পায়? সরবরাহ বাড়লে দাম কমবে- অর্থনীতির এই সহজ সূত্রটি ইলিশের বাজারে গিয়ে ব্যর্থ হয়। ভরা মৌসুমে বাজারে জোগান ভালো থাকলেও ইলিশ কখনোই গরিব ও স্বল্প আয়ের মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে থাকে না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্তের রান্না ঘরেও ইলিশের সুবাস ছড়ায় না। ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় ইলিশ মাছ নিয়ে হা-হুতাশের শেষ নেই স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে। ভরা মৌসুমেও ১ কেজি আকারের ইলিশ কিনতে গুনতে হচ্ছে অন্তত দেড় হাজার টাকা। ইলিশের দাম শুনে শ্রমজীবী মানুষের দামাদামি করার সাহসই হয় না। হতাশ হয়ে ফিরে আসছে বাজার থেকে এবং লজ্জায় এর প্রতিকার চাওয়ার সাহসও পাচ্ছে না। অন্যদিকে সচ্ছল মানুষরা ও ভরা মৌসুমে চাহিদার অতিরিক্ত ক্রয় করে মজুদ করে রাখে, যাতে করে সারা বছর খেতে পারে। ফলে একদিকে যেমন ইলিশের চাহিদা থাকে তুঙ্গে, অন্যদিকে ইলিশ ব্যবসায়ীরাও দাম হাঁকিয়ে থাকে আকাশচুম্বী। যার ফলে শ্রমজীবী মানুষদের পক্ষে ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করা সম্ভব হয় না।

যে মাছকে জাতীয় মাছ বলা হয়, সেই মাছ দেশের অধিকাংশ মানুষ খেতে পারে না- সেটি কি বাজার ব্যবস্থার ত্রুটি নয়? আড়তদাররা ইলিশ মাছের দাম সব সময়ই উঁচুতে তুলে রাখেন। মাছের সরবরাহ বেশি থাকলেও কিছু অসাধু ব্যবসায়ী সব সময় সংকট জিইয়ে রাখেন। অধিকাংশ ব্যবসায়ীরা মাছ আহরণের খরচকে এর পেছনে দায়ী মনে করছেন। যেখানে আগে একটি ট্রলারপ্রতি খরচ হতো ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা, সেখানে এখন খরচ হচ্ছে আড়াই থেকে তিন লাখ টাকা ও ক্ষেত্রবিশেষ আরো অনেক বেশি। এ ছাড়া মা ইলিশ রক্ষায় বাংলাদেশে যখন ৬৫ দিনের অবরোধ চলে, তখন জেলেরা মাছ ধরতে যেতে পারেন না। ওই নিষিদ্ধ সময় ভারতীয় জেলেরা বাংলাদেশের সীমানায় ঢুকে মাছ ধরে নিয়ে যান। যাতে করে দেশীয় জেলেরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। বিভিন্ন সময়ে ভারতীয় ট্রলার আটকের খবরও গণমাধ্যমের শিরোনামে দেখা যায়। এর জন্য প্রয়োজন যৌথ দেশের কূটনৈতিক সমাধান, যেমন- দুই দেশের একই সময়ে মাছ ধরার নিষিদ্ধ সময় নির্ধারণ করা, ইলিশের প্রজনন ও যাতায়াতের সুরিক্ষিত পথ নিশ্চিত করা, ইলিশ সুরক্ষায় যৌথ দেশের আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করা ইত্যাদি।

কেন ইলিশ মাছ বছরের কোনো একটি সময় এসেও সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমার নাগালে আসে না। এর জন্য ব্যাপক গবেষণা প্রয়োজন। ইতিমধ্যে ইলিশের পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করেছে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী। পুকুরে ইলিশ চাষ করা যায় কি না; টিনজাত করে ইলিশ বিক্রি করা যায় কি না- এ রকম গবেষণাও চলছে। বিশিষ্ট মৎস্যবিজ্ঞানী ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান মনে করেন, বাজারে ইলিশ মাছ কেটে পিস পিস করে বিক্রি করা যেতে পারে। অর্থাৎ যার একটি ইলিশ কেনার সামার্থ্য নেই, তিনি তার প্রয়োজনমতো পিস কিনে পরিবার নিয়ে খেতে পারেন।

মৎস্য উপদেষ্টা ফরিদা আখতার ১১ আগস্ট সচিবলায়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইলিশ নিয়ে নিজের ভাবনার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের মানুষ যাতে ইলিশ মাছ পায় এবং দাম কমে, সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। দেশের মানুষ ইলিশ পাবে না, আর রপ্তানি হবে, সেটা হতে পারে না। তার এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। এর সঙ্গে সঙ্গে তাকে সরকারি বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের সাহায্যে সব ধরনের সিন্ডিকেটকে ধ্বংস করে মাছ বাজারের অস্থিরতাকে কমিয়ে আনতে হবে।

বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে ইলিশ। এই মাছটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে, নদীর দূষণ ও দখল থেকে নদীকে রক্ষা করতে হবে। ইলিশ খুব সংবেদনশীল একটা মাছ। তার প্রজনন টিকে থাকা এবং বেড়ে ওঠার মতো পরিবেশ না থাকলে মাছটি বিলুপ্ত হতে পারে। এ জন্য ইলিশকে তার চেনা রুটে চলতে দিতে হবে। তার জন্য বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের নদী, নালা, খাল-বিলকে। আর তা না হলে বেশি টাকা দিয়েও ইলিশ পাওয়া সম্ভব হবে না। সারা বছর না হোক অন্তত ভরা মৌসুমেও যেন গরিব মধ্যবিত্ত সবাই ইলিশের স্বাদ পেতে পারি, সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভূমিকা পালন করতে হবে।

লেখক : ব্যাংক কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক পিএলসি, পটুয়াখালী

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close