আজিজ ওয়েসি
দৃষ্টিপাত
বাদশাহ আলমগীরের চোখে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক
মা-বাবা বানায় ভূত, ওস্তাদে বানায় পুত। এ রকম একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে। জন্মদাতা পিতা-মাতা সন্তানকে জন্ম দিয়ে লালনপালন করে বড় করে তোলেন। আদর-যত্ন দিয়ে সন্তানকে ভালোবাসতে শুরু করেন। এভাবে পিতা-মাতার সঙ্গে সন্তানের সম্পর্ক স্নেহ-মমতায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে সন্তানকে শাসন করার মতো মনমানসিকতা দূর হয়ে যায়। কিন্তু শাসন ছাড়া শুধু ভালোবাসা আর স্নেহ-মমতায় একজন ছেলে বা মেয়ে কখনো মানুষ হতে পারবে না। পাশাপাশি সন্তানকে মানুষ করার জন্য মৌলিক চাহিদা শিক্ষার প্রয়োজন। ফলে সন্তানকে শিক্ষিত করে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার দায়িত্বটা শিক্ষকের ওপরে বর্তায়। শুধু পিতা-মাতার দ্বারা সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এজন্য মানুষের জীবনে শিক্ষক অবশ্য প্রয়োজনীয়। একজন শিক্ষক একজন ছেলে বা মেয়েকে শুধু পড়াশোনা করান এমন নয়। তিনিও পিতা-মাতার মতো স্নেহ-মায়া-মমতায় বড় করে তোলেন। পাশাপাশি ছেলে বা মেয়ের খারাপ আচরণ বা দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। কখনো কখনো শাসন করে থাকেন। তাই একজন ছেলে বা মেয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকপর্যায়ে যেভাবে মানুষ হওয়ার দিকে ধাবিত হয়, তা জীবনব্যাপী চলতে থাকে। এজন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অবদান অপরিসীম।
সম্প্রতি কোটা সংস্কার আন্দোলন কেন্দ্র করে শেখ হাসিনার পতন হয়। আর ঠিক এরপর থেকে দেশের বিভিন্ন উচ্চ পদ-পদবির পরিবর্তনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আসে। প্রশাসন থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেন পদত্যাগের হিড়িক পড়ে যায়। যেখানে দুর্নীতির অভিযোগ সেখানেই পদত্যাগ। এভাবেই চলতে থাকে কিছুদিন পর্যন্ত। সর্বশেষ কিছু দুঃখজনক খবর ও ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। যেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদত্যাগ চেয়ে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামে। দুর্নীতির অভিযোগ থাকলে আন্দোলন যৌক্তিক। কিন্তু কখনো কখনো দেখা যায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা প্রধান শিক্ষককে জোর করে, গায়ে হাত দিয়ে পদত্যাগপত্রে
স্বাক্ষর করাতে চায়। এ রকম ভিডিও যখন চোখের
সামনে আসে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। যেখানে শিক্ষকের পায়ে ছাত্রদের শির লুটিয়ে পড়ার কথা, সেখানে গায়ে হাত দেওয়ার মতো বেয়াদবিমূলক আচরণ মানানসই নয়। তাও প্রাথমিক, মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা এমন ব্যবহার করছে। আমরা এমন প্রজন্ম কখনো প্রত্যাশা করিনি। শিক্ষককে যথোপযুক্ত সম্মান না দিয়ে এভাবে অপমান করা জাতির জন্য কলঙ্ক বয়ে আনবে।
শিক্ষককে কীভাবে সম্মান করতে হবে, কীভাবে শিক্ষকের মর্যাদা দিতে হবে, ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক কেমন হবে, তা নিয়ে চমৎকার কবিতা লেখেছেন কবি কাদের নেওয়াজ। কবিতার নাম ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’। কবিতায় ফুটে উঠেছে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষককে কীভাবে সম্মান করবে। কবিতার কিছু পঙক্তি :
‘একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধূলি
ধুয়ে-মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।’
অর্থাৎ এক দিন সকালে তিনি দেখতে পেলেন, শাহজাদা একটি পাত্র হাতে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে তার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছে। আর শিক্ষক নিজের হাত দিয়ে নিজেরই পায়ের ধুলাবালি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করছেন। শিক্ষকের পায়ে শুধু পানি ঢেলেই শাহজাদা তার শিক্ষকের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করছে। দূর থেকে বাদশাহ এই দৃশ্য দেখে খুবই মর্মাহত হলেন।
এই দৃশ্য বাদশাহ দেখে ফেললে শিক্ষক শাস্তির ভয়ে বিচলিত হন। কিন্তু ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের এমন দৃশ্য দেখে বাদশাহ আলমগীর খুশি হতে পারেননি। বাদশাহ তার খাসকামরায় শিক্ষককে ডাকলেন। তার পুত্র শিক্ষকের কাছ থেকে কোনোপ্রকার ভদ্রতা, শিষ্টাচার, আদব-কায়দা শিখতে পারেনি। বাদশাহর দৃষ্টিতে তার ছেলে এসবের পরিবর্তে বেয়াদবি আর গুরুজনের প্রতি অবহেলা করতে শিখেছে। কারণ বাদশার মতে শিক্ষক নিজের পায়ের ধুলো পরিষ্কার করবেন আর ছাত্র শুধু পানি ঢালবে, তা হতেই পারে না। এতে একজন ছাত্র বেয়াদব হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। ছাত্রের উচিত ছিল নিজ হাতে শিক্ষকের পায়ের ধুলো পরিষ্কার করা এবং নিজেই পানি দিয়ে ধৌত করা। তাহলেই যথোপযুক্ত শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি পেত। বাদশাহর জবানে এমন কথা শুনে শিক্ষক অত্যন্ত আনন্দিত হন। ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতার শেষে আনন্দিত শিক্ষকের উক্তি :
‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’
এমনই একটা সময় ছিল যখন শিক্ষকদের সর্বাধিক মর্যাদার চোখে দেখা হতো। শিক্ষক ছিলেন সমাজের অন্য দশজন থেকে আলাদা। সমাজের রাজা-বাদশাহ এবং জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিরা শিক্ষককে সমাজের মহৎ ব্যক্তি মনে করতেন। সম্মান করতেন। তখনকার সমাজটা ছিল অন্যরকম। পৃথিবীর বড় বড় সভ্যতা গড়ে উঠত তখন। মহামতি আলেকজান্ডারের শিক্ষক ছিলেন অ্যারিস্টটল, অ্যারিস্টটলের শিক্ষক ছিলেন প্লেটো, তার শিক্ষক ছিলেন সক্রেটিস। তাদের ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক এতই উন্নত ছিল যে, গ্রিকসভ্যতা অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। মহামতি আলেকজান্ডার তার শিক্ষক প্লেটোর প্রতি সম্মান জানাতে বলেছিলেন, ‘To my parents I owe to life, to my teacher how to live worthily.’
মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম শিক্ষককে ‘দ্বিতীয় জন্মদাতা’ হিসেবে তার কবিতায় তুলে ধরেন। এ. পি. জে. আবদুল কালাম বলেন, ‘একজন খারাপ ছাত্র একজন দক্ষ শিক্ষকের কাছ থেকে যা শিখতে পারে, তার চেয়ে একজন ভালো ছাত্র একজন খারাপ শিক্ষকের কাছ থেকে অনেক বেশি শিখতে পারে।’
এই লেখাটি শেষ করব ইসলামের চতুর্থ খলিফা হজরত আলী (রা.)-এর বিখ্যাত এক উক্তি দিয়ে।
শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে তিনি বলেছিলেন, ‘যিনি আমাকে একটি হরফ শিক্ষা দিয়েছেন, আমি তার দাস, তিনি চাইলে আমাকে বিক্রি করেও দিতে পারেন, চাইলে আজাদ করে দিতেও পারেন, আবার চাইলে গোলাম বানিয়েও রাখতে পারেন।’ এভাবেই যুগে যুগে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যে জাতি যেটুকু অর্জন করেছে, তা সবই শিক্ষকদের হাত ধরে পেয়েছে। আজও পৃথিবীর বহু দেশে শিক্ষকদের এভাবেই মর্যাদার চোখে দেখা হয়। একটি শিক্ষিত, মার্জিত ও আদর্শ জাতি গঠন করতে শিক্ষকের ভূমিকা সবার আগে। শিক্ষার্থীদের জীবন বদলে যায় শুধু শিক্ষকের দোয়ার বদৌলতে। মা-বাবা যেমন অভিশাপ দিলে জীবন অচল হয়ে যায়, তেমনই শিক্ষকও অভিশাপ দিলে জীবন অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়। এজন্য একজন শিক্ষকের সঙ্গে কেমন আচার-ব্যবহার করতে হবে, তা শিক্ষকই শিক্ষা দেবেন। পাশাপাশি পিতা-মাতাকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। সবশেষে শিক্ষার্থী ভাই-বোনদের উদ্দেশে বলব, একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের প্রত্যাশা আমাদের বহুল আকাঙ্ক্ষিত। আমাদের থেকে যারা শিক্ষা নেবে। তাই সর্বোচ্চ চেষ্টা করে শিক্ষকের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা সমীচীন। আর তাহলেই পৃথিবীতে আমরা একটি সভ্য জাতি হিসেবে পরিচিতি লাভ করব। আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ আমরা যারা শিক্ষার্থী, কাল শিক্ষক হিসেবেই পরিচয় আসতে পারে। কারণ নিয়তির খেলা বোঝা বড় দায়।
লেখক : শিক্ষার্থী, সমাজতত্ত্ব বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
"