এম এ জিন্নাহ

  ০২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ

তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে গড়ে উঠুক নতুন বাংলাদেশ। সুস্থ-সুন্দর পরিকল্পনামাফিক একটি সভ্য সমাজব্যবস্থা থেকে শুরু করে রাষ্ট্রব্যবস্থা পর্যন্ত গড়ে উঠুক তরুণদের সতেজ ছোঁয়ার মধ্য দিয়ে। একটি শুদ্ধ-সুন্দর, সন্ত্রাসমুক্ত, সংঘবদ্ধতার সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্করণ চাই। যেখানে চাটুকার, চাঁদাবাজ, জলদস্যু এবং অজ্ঞদের দূষণ থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র হবে সমুজ্জ্বল। এই সমুজ্জ্বলতার সংক্ষিপ্ততা শুধু একটি সার্কেলে নয়, ক্রমানুসারে বিস্তার লাভ করবে বহুমুখী হয়ে বহুদিকে। এ জন্য তরুণ প্রজন্মকে সংঘটিত হয়ে একটি সুষ্ঠুধারার মাধ্যমে এটা গঠন করতে হবে। যে তরুণ প্রজন্ম স্বৈরাচারের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে জানে, সে তরুণ প্রজন্ম ইচ্ছে করলে বাংলাদেশকে একটি সভ্য দেশ হিসেবেও গড়ে তুলতে পারবে। রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারের পাশাপাশি সমাজ সংস্কারের কাজটিও করতে হবে যথারীতিভাবে, কারণ এ দুটি একই সুতোয় গাঁথা।

দেশের দীপ্তিমানের দীপ্তি দিগবিদিক দিশেহারা হয়ে ছুটে যাবে, যদি যথাযথ মন-মানসিকতা, মানবিকতা, সরলতা, কর্মনিষ্ঠা, দৃঢতা, দেশপ্রেমের জাগরণ ও ব্যক্তিত্বের আত্মমর্যাদায় নিজেকে সোপর্দ করা যায়। দেশপ্রেম হলো একটি শক্তিশালী আলোকিত শক্তি। দেশপ্রেমের মতো এত উদারতা, পবিত্রতা ও আহ্লাদে ভরপুর স্নিগ্ধতা দ্বিতীয় কোনো কিছুর মধ্যে আর নেই। দেশপ্রেম মানুষকে মহৎ হতে শেখায়, মহৎ করে গড়ে তোলে।

স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশে নির্মিত হয়েছে তরুণ প্রজন্মের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তরুণসমাজ ইচ্ছে করলে আগামীর বাংলাদেশকে সব ধরনের অনিয়ম-দুর্নীতি ও সর্বপ্রকারের অরাজকতা থেকে সুসমৃদ্ধ করে গড়ে তুলতে পারবে। তাহলে ক্রমানুসারে গণতন্ত্রের দেশে সবার মতামত এবং ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠাসহ গড়ে উঠবে নব উত্তীর্ণ দুর্নীতি ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা।

সামাজিকতার ধারা সুন্দরভাবে নির্মাণের মধ্য দিয়ে সন্ত্রাস নির্মূল ও জনজীবনে স্বস্তি ফিরে আসা সম্ভব। রাজনৈতিক বলপ্রয়োগ কিংবা অন্য কোনো সূত্র ধরে সহিংসতা কিংবা নাশকতা বৃদ্ধির চেষ্টা করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ ও নির্মূল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সমাজ ও দেশ থেকে অধিকাংশ অরাজকতা কমিয়ে আনা সম্ভব। তবেই যারা সমাজের সামাজিকতার মধ্যে নাশকতা বিস্তার করতে চায়, তারা সহজে নির্মূল হবে।

সমাজ ও রাষ্ট্র সংস্কার এবং সাজানো-গোছানোর মধ্য দিয়ে সুসমৃদ্ধ একটি জনজীবন ও পরিবেশ গড়ে ওঠে। এ দায়িত্ব যুগ যুগ ধরে বহুজন করে এসেছে। কেউ একা করেছে, কেউ আবার সংঘবদ্ধ হয়ে। সমাজ সংস্কারের মধ্য দিয়ে সমাজের সংস্কৃতি, সৌন্দর্যতা, সম্পৃক্ততা ও সহজলভ্যতা সমুজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এতে করে রাষ্ট্র হবে আলোকময় উজ্জ্বল ও শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক। এতে সবার মনোবল, মন-মস্তিষ্ক এবং সুসম্পর্ক আরো বৃদ্ধি পাবে। সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সরলতার এ রেখা যুগে যুগে তরুণসমাজে টেনে নিয়ে গেছে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্যন্ত এভাবেই চলমান থাকবে।

খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ৪ শতকের দিকে তৎকালীন এথেন্স নগরীর গণতন্ত্রের মহানায়ক পেরিক্লিস সমাজ থেকে শুরু করে পুরো এথেন্স নগরীকে সুসম্মৃদ্ধভাবে গড়ে তুলেছেন। পেরিক্লিস (৪৯৫ খ্রিস্টপূর্ব-৪২৯ খ্রিস্টপূর্ব) ছিলেন গ্রিকসভ্যতার স্বর্ণযুগে এথেন্স নগরের একজন প্রভাবশালী ও মান্যগণ্য নেতা, বক্তা এবং সেনাপতি। পারস্য ও পেলোপনেস যুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে তিনি খ্যাতি অর্জন করেন। তিনি আল্কমেনিডি পরিবারের সদস্য ছিলেন।

তবে পেরিক্লিস একা নয়, পেরিক্লিসের সঙ্গে সমতা বজায় রেখেছেন পুরো এথেন্সবাসী। তৎকালীন এথেন্স ছিল গণতন্ত্রের অন্যতম দৃষ্টান্ত। পেরিক্লিসের বুদ্ধিমত্তা ও দেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের ছোঁয়ায় প্রায় ৩০ বছর ধরে এথেন্সের প্রেমে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। এথেন্সের উন্নতির জন্য এবং একে শ্রেষ্ঠত্বের মর্যাদায় ভূষিত করতে প্রচেষ্টা ছিল অন্যরকম। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিক্ষা-চিকিৎসা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন-ইতিহাস- সবকিছু মহান রূপে জন্ম হয়েছে এথেন্সে। পেরিক্লিস নাগরিকদের জন্য গড়ে তুলেছেন অধিবেশন। এথেন্সের যেকোনো নাগরিক এ অধিবেশনের যেকোনো প্রস্তাব রাখতে বা নতুন আইনপ্রণয়নের প্রস্তাব করতে পারতেন। সব ধরনের প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে গৃহীত হতো। প্রত্যেক নাগরিকের সব ধরনের রাষ্ট্রীয় উচ্চপদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার এবং নির্বাচিত হওয়ার অধিকার ছিল। পেরিক্লিসের সময়ে রাষ্ট্রীয় পদগুরোর জন্য বেতন দেওয়ার প্রথা প্রবর্তিত হওয়ার ফলে দরিদ্র লোকরাও এসব পদে নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পান। সব মতামত ও প্রস্তাব সব নাগরিকের ভোটের মাধ্যমে গৃহীত হতো।

পেরিক্লিসের সুন্দর ব্যবস্থাপনার কারণে গ্রিসের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে জ্ঞানী-গুণী মানুষজন এথেন্সে পাড়ি জমাতেন। পেরিক্লিস তার চারপাশে সারা গ্রিসের বিজ্ঞানী, দার্শনিক ও শিল্পী-সাহিত্যিকদের আকৃষ্ট করেছিলেন। এদের মধ্যে দার্শনিক অ্যানাক্সাগোরাস, নাট্যকার ইউরিপাইডিস প্রমুখের নাম বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এস্কাইলাস, অ্যারিস্টফেনিস প্রমুখ নাট্যকারও পেরিক্লিসের এথেন্সের গৌরব বৃদ্ধি করেছিলেন। দার্শনিক সক্রেটিস, ট্র্যাজেডি নাট্যকার সফোক্লিস, সেরা ইতিহাসবিদ হেরাডটাস এরা পেরিক্লিসের সময়ে বেড়া ওঠা মানুষ। অলিম্পিক খেলা, ম্যারাথন দৌড় এর সবকিছুই ক্রমাগত উন্নত হয়ে উঠেছে পেরিক্লিসের সময় থেকে। সবার একতা, যৌক্তিক মতামত, শুদ্ধ আচার-আচরণ এবং অসীম দেশপ্রেমের কারণে এথেন্স হয়ে ওঠে বিশ্বের অন্যতম নগরী। তাদের একতার কারণে রণকৌশলের দিক দিয়েও এগিয়ে যায়। পাশের রাষ্ট্রগুলো কয়েকবার সৈন্য-সেনা পাঠিয়ে এথেন্স দখল করার চেষ্টা করেও কোনো লাভ

হয়নি, সবার ঐক্যবদ্ধতা আর সাহসীকতার কারণে মাতৃভূমির কোনো ক্ষতি হতে দেয়নি। অসীম বুদ্ধিমত্তায় পেরিক্লিস ক্রমাগতভাবে সবার চোখে সেরা হয়ে ওঠে। তারা

বিশ্বাস করত দেশপ্রেমের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকলে যেকোনো কিছুই জয় করা সম্ভব। এথেন্সের মতো একটি নগরী বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি ছিল না।

মানবসম্প্রদায়ের জন্য সবকিছুই সম্ভব। ইচ্ছা করলে আমরাও একটি এথেন্স নগরী প্রতিষ্ঠা করতে পারি। খুব বেশি কিছু প্রয়োজন হবে বলে মনে হয় না, প্রয়োজন শুধু শুদ্ধ নীতিবোধ, শুদ্ধ পরিকল্পনা, পরিচর্যা, প্রয়োজনীয় সংস্কার, গঠনতন্ত্রের সমুজ্জ্বলতা, সবার ঐক্যতা আর শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি। তবে এর মধ্যে চাটুকারিতা অথবা উদ্দেশ্য হাসিল করার কোনো রকম চিহ্ন থাকলে সংস্কারবৃদ্ধি হবে না। সবার মন-মস্তিষ্ক হতে হবে শুদ্ধ ও দেশপ্রেমের মনোভাব। দেশের এই ক্লান্তিকালীন গড়ে উঠুক দেশপ্রেমের মহাজাগরণ, সংস্কার হোক হাজারো সমস্যা। নতুন প্রজন্ম দেখতে পাবে আলোকময় একটি সুসমৃদ্ধ বাংলাদেশ। নাগরিক হিসেবে এটা সবার দায়িত্ব ও কর্তব্য।

লেখক : কবি ও ছড়াকার

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close