এফ এম আনোয়ার হোসেন
দৃষ্টিপাত
রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কৌশল ও ছাত্রশক্তি
বৈষম্যহীন ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বাধীন সাফল্য রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়াই বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যে একটি ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা করেছে। অকুতোভয়, অদম্য ছাত্র-জনতা তথা যুবশক্তি বুকের রক্ত দিয়ে এই দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছে, যারা দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে। এই তরুণ ছাত্রসমাজ রাজনৈতিক দলগুলোর গতানুগতিক পালাবদলে সম্পূর্ণরূপে আস্থাহীন। তারা চায় আমূল সংস্কার, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কারও অন্তর্ভুক্ত থাকবে, যা প্রকৃত অর্থেই জনগণের স্বার্থ ও অধিকার বৈষম্যহীনভাবে রক্ষা করবে। তাদের আশা ও ভাবনাকে গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তা কার্যকর না করে এগোনো আমাদের ভবিষ্যৎকে আবারও স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে। তাই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে তাদের পছন্দের নেতা তারুণ্যে আস্থাশীল ড. মুহাম্মদ ইউনূস। অনেক জীবন দিয়ে পরিবর্তনের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টিকারী আমাদের ছাত্রনেতাদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারকে যুবকদের আকাঙ্ক্ষা ও ধারণাকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করতে হবে। সংস্কারকাজে তারা প্রথমেই রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে মৌলিক পরিবর্তন আনতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যেন ব্যক্তিকেন্দ্রিক, জবাবদিহিহীন, জনগণের অধিকার হরণকারী চলমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রভাবমুক্ত থাকে। এক কথায় যাকে ডিপলিটিসাইজেশন বা অরাজনৈতিকীকরণ বলা যেতে পারে।
অরাজনৈতিকীকরণের কৌশল বাস্তবায়নের মতো কঠিন কাজটি আমাদের দেশে যে প্রথম ভাবা হচ্ছে, এমনটি নয়। আমাদের অনেকেই হয়তো জানেন এল সালভাদরের রাজনৈতিক ইতিহাস। সেখানকার উদাহরণের সঙ্গে বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের সাদৃশ্য এবং পার্থক্য এই যে, এখানে শক্তিশালী পরিবর্তনের ধারক-বাহক ছাত্র-জনতা, কোনো রাজনৈতিক দল বা কোনো একক জনপ্রিয় নেতার নেতৃত্বে নয়। ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক দলের পরিবর্তে ছাত্রদের সামগ্রিক চেতনা এবং কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সংঘটিত হয়েছে, যা দলীয় রাজনীতির বাইরের একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পেরেছে।
আমাদের নিকটবর্তী ও অন্যান্য উন্নত দেশের সংস্কার ও অরাজনৈতিকীকরণের কৌশল পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর প্রযুক্তিগত পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশাসন পরিচালনা করে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, নগর-পরিকল্পনা, জনস্বাস্থ্য ইত্যাদির ক্ষেত্রে দক্ষ এবং প্রমাণভিত্তিক নীতিনির্ধারণের জন্য এটি পরিচিত। যদিও সিঙ্গাপুরের রাজনৈতিক পরিবেশ অত্যন্ত কেন্দ্রীভূত এবং নিয়ন্ত্রিত; তবে তার জনসেবা এবং অর্থনৈতিক নীতির ব্যবস্থাপনা অরাজনৈতিক প্রশাসনের মডেল হিসেবে উল্লেখযোগ্য। সুইজারল্যান্ড তার সরাসরি গণতন্ত্র এবং ঐকমত্য রাজনীতির মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে সক্ষম হয়েছে। এখানে নাগরিকদের সরাসরি সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে, যা রাজনৈতিক প্রভাবের বদলে প্রকৃত জনগণের মতামতকে গুরুত্ব দেয়।
নিউজিল্যান্ড স্বাধীন নির্বাচন কমিশন এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতার মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব কমাতে এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে। এ ছাড়া জার্মানি ফেডারেল ব্যবস্থার অধীনে স্বাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর মাধ্যমে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া থেকে রাজনৈতিক প্রভাব কমানোর চেষ্টা করে। কানাডা তার জনসেবায় একটি মেধাভিত্তিক পদ্ধতি প্রবর্তন করেছে, যা রাজনীতি-সংক্রান্ত পৃষ্ঠপোষকতা কমানোর চেষ্টা এবং পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে। কানাডার পাবলিক সার্ভিস কমিশন এ প্রক্রিয়া তত্ত্বাবধান করে, যা জনসেবার সততা বজায় রাখতে সহায়ক। ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা অরাজনৈতিকভাবে কাজ করতে ডিজাইন করা হয়েছে। যেমন : ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক (ইসিবি) এবং ইউরোপীয় কমিশন। উদাহরণস্বরূপ ইসিবি মুদ্রানীতি ব্যবস্থাপনার জন্য দায়ী এবং এটি রাজনৈতিক চাপ থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য গঠিত অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের দিকে মনোযোগ দেয়।
যদিও অরাজনৈতিকীকরণ কৌশল কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তনে সহায়ক হতে পারে, এটি সম্পূর্ণরূপে অর্জন করা সহজ কাজ নয়। অনেক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিকীকরণের চেষ্টা এখনো বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনের সমস্যাগুলোর সম্পূর্ণ সমাধান নাও করতে পারে।
বাংলাদেশে আমরা বর্তমানে ছাত্র-জনতার রক্তে অর্জিত স্বৈরতন্ত্র্যমুক্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে নানা চাপের মধ্য দিয়ে এগোতে দেখছি। আমরা আশা করি, সব চাপ-বাধা অতিক্রম করে অন্তর্বর্তী সরকার চলমান বিপ্লবের প্রেক্ষাপটে সফল অরাজনৈতিকীকরণ কৌশল এবং আমাদের সংগ্রামের শিক্ষা গ্রহণ করে বাংলাদেশে সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করা যেতে পারে-
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও প্রশাসন শক্তিশালীকরণ; নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা; নির্বাচন কমিশন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বৃদ্ধি করা। এটি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক হবে এবং রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নিশ্চিত করবে। প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানের দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করা প্রয়োজন।
প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা প্রচার, প্রমাণভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কোভিড-১৯ মহামারি পরিচালনার অভিজ্ঞতা থেকে শেখা প্রমাণিত- প্রমাণভিত্তিক এবং প্রযুক্তিগত ব্যবস্থাপনা কার্যকর হতে পারে। গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোয় বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ ও প্রযুক্তিগত তথ্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। টেকসই উন্নয়ন পরিকল্পনা, অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা বোর্ড গঠন করা, যা রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবে।
সিভিল সোসাইটি এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ, সিভিল সোসাইটির শক্তিশালী ভূমিকা, সিভিল সোসাইটি সংস্থাগুলোর ভূমিকা বৃদ্ধি এবং তাদের অধিক সম্পদ ও স্বায়ত্তশাসন দেওয়া উচিত। সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিদের সরকারি নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। সিভিল সোসাইটি ও ছাত্রদের অংশগ্রহণে সামগ্রিক উন্নয়ন এবং সংস্কার প্রক্রিয়া আরো স্বচ্ছ ও প্রতিনিধিত্বশীল হবে।
স্বচ্ছ এবং ন্যায়সংগত নির্বাচন নিশ্চিতকরণ; নির্বাচনী আইন সংস্কার; নির্বাচন প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বাড়ানোর জন্য নির্বাচনী আইন সংস্কার করা প্রয়োজন। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করা উচিত। নির্বাচন তদারকির জন্য স্বতন্ত্র পর্যবেক্ষক সংস্থা গঠন করা উচিত।
জনসাধারণের অংশগ্রহণ এবং সরাসরি গণতান্ত্রিক প্রচার; সরাসরি গণতন্ত্রের উন্নয়ন; রেফারেন্ডাম বা জনপরামর্শের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জনসাধারণের অংশগ্রহণ বাড়ানোর ব্যবস্থা প্রবর্তন করা উচিত। এটি সরকারি নীতির প্রতি জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি করবে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি, যাতে তারা স্বচ্ছ ও কার্যকরভাবে মতামত প্রকাশ করতে পারে।
দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং জবাবদিহি বৃদ্ধি, দুর্নীতিবিরোধী কাঠামো শক্তিশালীকরণ এবং প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। স্বাধীন তদন্ত ও দুর্নীতির মামলা পরিচালনার জন্য দুদক পুনর্গঠন বা বিশেষ সংস্থা গঠন করা প্রয়োজন। দুর্নীতি প্রতিরোধে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন ব্লকচেইন প্রযুক্তি, ট্রান্সপারেন্সি উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রশাসনিক কার্যকারিতা উন্নত করতে সহায়ক। দলের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও গণতান্ত্রিক এবং নেতৃত্বের মেয়াদ সীমিত করা জরুরি। দলের অর্থনৈতিক লেনদেন ও দান-পণ সম্পর্কিত তথ্য প্রকাশ এবং প্রশাসনিক রিপোর্টিং নিশ্চিত করতে হবে। সংগঠনগত সংস্কারের জন্য দলের নীতিমালা আপডেট এবং একটি সুষম কাঠামো গঠন করতে হবে। নেতৃত্ব ও প্রশাসনিক দক্ষতা উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম চালু করা উচিত। জনসাধারণের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য মৌলিক যোগাযোগ পদ্ধতি গঠন এবং দলের সংস্কৃতি পরিবর্তনে একটি উন্নয়ন পরিকল্পনা তৈরি করা প্রয়োজন। আইনি ও সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক কার্যক্রম নিশ্চিত করে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ভূমিকা শক্তিশালীকরণ, বর্তমান বৈপ্লবিক পরিবর্তনগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের উদ্ভাবনী চিন্তাভাবনা, নেতৃত্ব ও দক্ষতার বিকাশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কার্যকর প্রোগ্রাম ও প্রকল্পের ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের বিভিন্ন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করা, সুযোগ দেওয়া ও সহযোগিতা করা প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা প্রদান, নৈতিক মূল্যবোধ গড়ে তোলা এবং একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা জরুরি। এ ছাড়া উদ্ভাবনী প্রকল্প ও স্টার্টআপ উদ্যোগের জন্য ফান্ডিং ও সহায়তা নিশ্চিত করা এবং ব্যক্তিগত ও পেশাদারি দক্ষতা উন্নয়নের প্রশিক্ষণ দেওয়া উচিত। এসব উদ্যোগ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের আন্তর্জাতিক মানে উন্নত; নৈতিক, শান্তিপূর্ণ ও গুণগত শিক্ষা নেতৃত্বের বিকাশ নিশ্চিত করতে সহায়ক হবে এবং তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম করবে।
আমাদের দেশে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের অভিজ্ঞতা এবং আন্তর্জাতিক উদাহরণগুলো পর্যালোচনা করে আমরা আশা করতে পারি, এই নতুন প্রজন্মের উদ্যোগ ও সংগ্রামের প্রেক্ষিতে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে একটি স্বচ্ছ, সুষ্ঠু এবং উন্নত গণতান্ত্রিক কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে। এটি নিশ্চিত করবে যে বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথপ্রদর্শকই নয় বরং বৈশ্বিক মানদ-ে উন্নত, শান্তিপূর্ণ এবং নৈতিক শিক্ষা অর্জনের ক্ষেত্রেও নেতৃত্ব দেবে।
লেখক : উন্নয়নকর্মী
"