মো. রিয়াজ হোসাইন
দৃষ্টিপাত
অণুজীবের অ্যান্টিবায়োটিক অভিযোজনের প্রভাব ভয়ংকর
পবিত্র কোরআনে উল্লেখ আছে, মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি এবং বিচার করার ক্ষমতা তাকে পৃথক করেছে। একজন মানুষের সুস্থ-সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য সুষম খাদ্য এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবনযাপনের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অনেক ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকার পরও লোকজন নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়। এসব রোগের অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে অণুজীব। অণুজীব হচ্ছে অতিক্ষুদ্র জীব, যা স্বাভাবিক চোখের ক্ষমতায় দেখা অসম্ভব। সাধারণত অণুজীবের দৈর্ঘ্য দশমিক মাইক্রোমিটার থেকে কয়েক মাইক্রোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। অর্থাৎ একটি অণুজীবের দৈর্ঘ্য এক মিটারের ১০ লাখ ভাগের একভাগ।
আমাদের সর্বত্র মাটি, পানি ও বায়ুতে নানা ধরনের অণুজীব বিরাজমান। আগ্নেগিরির চুল্লি থেকে এভারেস্টের শৃঙ্গল হয়ে মহাসাগরের অতল গভীরেও অণুজীব রয়েছে। অণুজীবের তালিকায় রয়েছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, অ্যামিবা, মাইক্রোপ্লাজমা, রিকেটশিয়া প্রভৃতি। একজন মানুষ নানাভাবে অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। যেমন : অণুজীবের সংস্পর্শে, অণুজীব আক্রান্ত খাদ্য ও পানীয় গ্রহণের মাধ্যমে, অণুজীব বাহিত বাতাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে প্রভৃতি। বলা বাহুল্য, ক্ষতিকর জীবাণু দ্বারা রোগাক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা নেহাত কম নয়। সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রত্যেক বছর বিশ্বে প্রায় কোটি কোটি লোক অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। আমাদের দৈনন্দিন গ্রহণ করা খাদ্য ও পানীয় বিভিন্ন পন্থায় অণুজীব দ্বারা কলুষিত হতে পারে। যেমন : প্রাণীর সংস্পর্শে, অপরিষ্কার স্থানে রাখলে, অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে, সিদ্ধ খাবার কাঁচা খাদ্যের সংস্পর্শে, আধা সিদ্ধ খাবার সংস্পর্শে প্রভৃতি।
তবে আনন্দের বিষয় অণুজীব সৃষ্ট রোগ (যক্ষ্মা, প্লেগ, নিউমোনিয়া, সিফিলিস প্রভৃতি) থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নানা ধরনের ওষুধ বা অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে। এসব অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের মাধ্যমে সহজেই ওই রোগ থেকে রেহাই পাওয়া যায়। অ্যান্টিবায়োটিক হচ্ছে এক ধরনের সেমি সিনথেটিক ওষুধ যা উপকারী অণুজীব প্রক্রিয়াজাত করার মাধ্যমে তৈরি। অ্যান্টিবায়োটিক ক্ষতিকর জীবাণুকে ধ্বংস এবং বংশবিস্তার বন্ধ করে। সর্বপ্রথম ১৯২৮ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় লন্ডনের সেন্ট মেরি হাসপাতালের অধ্যাপক আলেকজেন্ডার ফ্লেমিং রাসায়নিক সংশ্লিষিত সেফালোসপোরিনের মিশ্রণে ব্যাকটেরিয়ার প্রতিরোধী পেনিসিলিন আবিষ্কার করেন। সেখান থেকেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৪০ সালে পেনিসিলিনের বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হয়। জার্মান বিজ্ঞানী পল আরলিস সর্বপ্রথম আধুনিক অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার করেন। তৎকালীন সময়ে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে কোটি কোটি মানুষের জীবন বেঁচে যায়। পর্যায়ক্রমে আবিষ্কার হয় প্রথম প্রজন্ম থেকে চতুর্থ প্রজন্মের অ্যান্টিবায়োটিক। একসময় ধারণা করা হতো অণুজীবের আক্রমণে আমাদের বোধ হয় আর মৃত্যু হবে না। দুর্ভাগ্য, প্রবহমান সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অণুজীবের কোষের পরিবর্তন ও জিনগত পরিবর্তন সংগঠিত হয়েছে, যা অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে সহনশীল। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীদের মতে, অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে অণুজীবের অভিযোজনের কারণগুলো হলো মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, নির্ধারিত ডোজ সম্পন্ন না করা, ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন, প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন প্রভৃতি।
প্রথম দিকে মানুষজন শুধু ক্যানসার কিংবা বড় কোনো অস্ত্র পাচারের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করত। বর্তমানে সেই চিত্র ভিন্ন সামান্য কারণেও লোকজন অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করছে। এর অন্যতম কারণ বাজারে অ্যান্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতা। মানবদেহে অণুজীবের অ্যান্টিবায়োটিক অভিযোজনের প্রভাব নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। ফলে, অণুজীব ধারা সংগঠিত সামান্য জ্বরেও মানুষের মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটতে পারে। প্রত্যেক বছর বিশ্বে লাখ লাখ লোকজন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যাস বা অণুজীবের অভিযোজনের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। এ ছাড়া আইসিউয়ে ৮০ শতাংশ লোকজন অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল অভিযোজনের কারণে মৃত্যুবরণ করছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সের কারণে ২০৫০ সালে বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়বে ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ২০১৫ সাল থেকে প্রত্যেক বছর ১৮ থেকে ২৪ নভেম্বর অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ পালন করে আসছে। শুধু যে মানুষের ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে ঠিক এ রকমটা নয়। গৃহপালিত প্রাণী যেমন গরু, মহিষ, ছাগল, হাঁস এবং মুরগির ক্ষেত্রেও অধিক উৎপাদনের আশায় নির্বিচারে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহৃত হচ্ছে। বেশির ভাগ প্রাণীর ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোনো ডোজ অনুসরণ এবং প্রাণিচিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া হচ্ছে না। ফলে প্রাণীর দেহেও অ্যান্টিবায়োটিক অভিযোজন অণুজীব তৈরি হচ্ছে, যা প্রাণিসম্পদ উন্নতির জন্য বড় হুমকি।
এ ছাড়া প্রাণী এবং মাৎস্যের খাদ্যে ব্যবহৃত অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক মাটি ও পানির সংস্পর্শে আসছে। সেখানে বসবাসকৃত অণুজীবের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক অভিযোজনের ক্ষমতা তৈরি হচ্ছে। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় হলো, অ্যান্টিবায়োটিকের অভিযোজিত অণুজীব এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণী এবং এক মানুষের দেহ থেকে অন্য মানুষের দেহে স্থানান্তিরিত হতে পারে। এর অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে আক্রান্ত ব্যক্তি বা প্রাণীর সংস্পর্শে খাদ্য ও পানীয়। আবার অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যাস আক্রান্ত প্রাণী, মাৎস্য এবং কৃষি পণ্য ভক্ষণের মাধ্যমেও স্থানান্তরিত হতে পারে। অর্থাৎ একজন নির্দোষ ব্যক্তিও অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যাসের ভয়াল থাবার শিকার হতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে অভিযোজিত অণুজীবের প্রভাব নিঃসন্দেহে ভয়ংকর। কারণ শিশুদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা অতি নগণ্য। অ্যান্টিমাইক্রোবিয়ালের রেজিস্ট্যাসের কারণে ভবিষ্যতে বড় ধরনের অস্ত্রোপাচার হুমকির মুখে পড়বে, যা সহজেই অনুমেয়। সুতরাং আমাদের সবাইকে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে :
১. প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করা যাবে না, ২. ডাক্তারের নির্দেশনা অনুসারে অ্যান্টিবায়োটিক কোর্স সম্পূর্ণ করতে হবে, ৩. মাত্রাতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে, ৪. অ্যান্টিবায়োটিকের সহজলভ্যতা বন্ধ করতে হবে, ৫. প্রাণী ও মাৎস্য খাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, ৬. সংক্রমণের হার হ্রাস করতে হবে, ৭. অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যাস প্রতিরোধে উন্নত গবেষণা এবং অন্যকে সচেতন করতে হবে।
লেখক : শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
"