মো. তাহমিদ রহমান

  ১২ আগস্ট, ২০২৪

মুক্তমত

মায়ানসংখ্যা পদ্ধতির মায়াজাল

আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে ২৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বর্তমান লাতিন আমেরিকায় মায়ান নামক মহাপরাক্রমশালী এক জাতিসত্তা বসবাস করত। হন্ডুরাস, গুয়াতেমালা, এলসালভেদরের উত্তরাংশ, সেন্ট্রাল মেক্সিকো, চিয়াপাসসহ প্রায় এক হাজার কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বসতি গড়ে তুলেছিল মায়ানসভ্যতার মানুষ। সমসাময়িককালে অন্যান্য ভৌগোলিক অঞ্চলের মানুষ যখন আবাসস্থল কীভাবে গড়তে হয়, তা জানত না, ঠিক সেই সময় জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে গিয়ে স্থাপনা প্রতিষ্ঠা করে ফেলে মায়ানরা, যা বর্তমান মানুষের কাছে একটি বিস্ময়ের ব্যাপার। ইউরোপ যখন অন্ধকার যুগে নিমজ্জিত, ঠিক সে সময় লাতিন আমেরিকায় বিকাশ লাভ করে মায়ানসভ্যতা। বর্তমান মেক্সিকানরা হচ্ছে মায়ানদের উত্তর পুরুষ।

মায়ানদের শাসন ব্যবস্থাপনায় সব রাজ্যই ছিল নগররাজ্য। ইউকাতানের চিচেন ইতসাই ছিল মায়ানসভ্যতার রাজধানী। জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেসব প্রাচীন সভ্যতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে, তাদের মধ্যে ব্যতিক্রম হলো মায়ানসভ্যতা। মায়ানসভ্যতা বিশ্বের কয়েকটি সভ্যতার মধ্যে একটি, যারা স্বাধীনভাবে একটি অবস্থানগত সংখ্যা পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছিল। লাতিন আমেরিকার এই সভ্যতাটি সম্পর্কে এশিয়া, ইউরোপ ও আফ্রিকার মানুষ জানতে পেরেছে মাত্র ৫০০ বছর আগে। মায়ানসভ্যতা সম্পর্কে লোকোমুখে অনেক রহস্যময় কাহিনি প্রচলিত থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে মায়ানসভ্যতা পরিচিতি লাভ করে তাদের দিনপঞ্জিকার কারণে। অবাক করার বিষয় হলো, মায়ান দিনপঞ্জিকায় ২০১২ খ্রিস্টাব্দের পর আর কোনো বর্ষ ছিল না।

মায়ানরা বিশ্বাস করত ২০১২ খ্রিস্টাব্দের পর পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে। যদিও এ ধারণার সঙ্গে অনেক গবেষক দ্বিমত পোষণ করেছেন। এত কিছুর পরও সব গবেষক এ বিষয়ে একমত যে মায়ানসভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল স্বতন্ত্রভাবে। প্রাক-কলম্বিয়ান মায়ানসভ্যতার মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিটি গণনার জন্য ভিজেসিমাল সিস্টেম ব্যবহার করেছিল। এই সংখ্যা পদ্ধতি মূলত ছিল ২০ এবং ৫-ভিত্তিক অবস্থানিক এক ধরনের সংখ্যা পদ্ধতি। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে দশের পরিবর্তে ২০-এর ওপর ভিত্তি করে এর সব গাণিতিক কার্যক্রম সম্পাদন করা হতো। আমাদের প্রচলিত গাণিতিক সিস্টেমে ১,১০,১০০, এবং ১০০০-এর পরিবর্তে মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে ১, ২০, ৪০০, ৮০০০ এবং ১৬০,০০০ ব্যবহার করা হতো। এর চেয়েও অবাক করার বিষয় হলো, মায়ানরা শূন্যের জন্য আলাদা প্রতীক ব্যবহার করত। ০, ১ ও ৫ এই তিনটি সংখ্যার জন্য তারা শুধু আলাদা প্রতীক ব্যবহার করত। সেদিক থেকে চিন্তা করলে মায়ানরা আধুনিক সংখ্যা পদ্ধতির খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিল।

তবে যোগ, বিয়োগসহ অন্যান্য গাণিতিক কার্যক্রম সম্পাদনের জন্য মায়ানসংখ্যা পদ্ধতি খুব একটা সুবিধার ছিল না। মায়ানরা লেখাকে দেবতার কাছ থেকে পাওয়া একটি পবিত্র উপহার বলে মনে করত। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতি একপ্রকার অভিজাত শ্রেণি দ্বারা সংরক্ষিত ছিল বলে সাধারণ মায়ানরা লিখতে ও পড়তে পারত না। অভিজাত শ্রেণি এই মর্মে বিশ্বাসী ছিল যে তারা সরাসরি দেবতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তারা মনে করত, দেবতা ও সাধারণ মানুষের মধ্যে তারা মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত লেখার পদ্ধতিটি আংশিকভাবে হায়ারোগ্লিফিক ছিল, কারণ এটি অক্ষরের পরিবর্তে পরিসংখ্যান ব্যবহার করত। সিলেবল ও আইডিওগ্রামের ধ্বনিগত প্রতীকগুলোর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছিল মায়ানসংখ্যা পদ্ধতি। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতির লিপিগত পাঠোদ্ধার করা অত্যন্ত জটিল ও দুরূহ কাজ।

স্প্যানিশ যাজকদের আদেশে তিনটি ছাড়া অবশিষ্ট মায়ান কোডগুলো পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতির পাঠোদ্ধারে যে কোডগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে, সেগুলো হলো ড্রেসডেন কোডেক্স, প্যারিস কোডেক্স এবং মাদ্রিদ কোডেক্স। মায়ানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ ছিল এবং তাদের পর্যবেক্ষণ ছিল নির্ভুল। সমসাময়িক সভ্যতাগুলোর মধ্যে অন্যদের চেয়ে মায়ানরা জ্যোতির্বিজ্ঞানে অনেক দূর অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল। কোনো ধরনের যন্ত্রপাতি ব্যবহার না করেই তারা চাঁদ এবং গ্রহের গতিবিধির নির্ভুল পর্যবেক্ষণ করে দিতে পারত। সৌর বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপে ইউরোপের তুলনায় মায়ানসভ্যতা বেশি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে গাণিতিক ক্রিয়া-কলাপের চেয়ে সময় পরিমাপকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এজন্য মায়ানসংখ্যা পদ্ধতির বেশির ভাগ নিদর্শন দিন, মাস এবং বছরের সঙ্গে সম্পর্কিত দিনপঞ্জিকায় পাওয়া যায়। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে সংখ্যাগুলো বিশের মধ্যে গোষ্ঠীভুক্ত করা হয়েছে। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতি যে তিনটি প্রতীক নিয়ে গঠিত তার মধ্যে প্রথমটি হলো একটি শেলসেপ (?), যা দ্বারা শূন্যকে প্রকাশ করা হয়, দ্বিতীয়টি একটি বিন্দ (.), যা দ্বারা ১-কে প্রকাশ করা হয়, তৃতীয় প্রতীকটি একটি দণ্ড বা বার (-), যা দ্বারা পাঁচকে প্রকাশ করা হয়। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতির প্রতিটি স্তরে বিশটি বিন্দুতে পৌঁছাতে হয়। মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে এক-কে একটি বিন্দু দ্বারা, দুইকে দুটি বিন্দু দ্বারা তিন-কে তিনটি বিন্দু দ্বারা, চার-কে চারটি বিন্দু দ্বারা প্রকাশ করা হয়। পাঁচ প্রকাশের জন্য একটি আনুভূমিক বার চিহ্ন ব্যবহার করা হয়। ১ থেকে ১০০ পর্যন্ত দশমিক সংখ্যাগুলো মায়ানসংখ্যা পদ্ধতিতে প্রকাশ করতে বিন্দু চারবারের বেশি পুনরাবৃত্তি করা হয় না। ১ থেকে ১৯ পর্যন্ত মায়ান সংখ্যাগুলোকে প্রাচীনকালে প্রাপ্ত শিলালিপিতে করে উপস্থাপন করা হলো।

লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ)

নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close