রেজাউল করিম খোকন

  ১২ আগস্ট, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

নতুন এক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার সম্ভাবনা

এমন বিজয় বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেননি, এমন পতনও তারা দেখেননি। দাম্ভিকতা, অহমিকা, আমিত্ত্ব, বিরোধী মতের মানুষকে কোনোভাবেই সম্মান মর্যাদা না দিয়ে অপমান-তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার প্রবণতা, চাটুকার পরিবেষ্টিত হয়ে সর্বনাশা সিদ্ধান্ত গ্রহণ শেখ হাসিনাকে ভয়ংকর পতনের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে। নিজের সর্বনাশ ডেকে আনছেন এটি তিনি উপলব্ধি না করে আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন। তার শেষের দিককার কর্মকাণ্ড দেশের সব মানুষকে চরমভাবে বিক্ষুব্ধ করে এক কাতারে নিয়ে এসেছিলেন। তখন শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন স্বেচ্ছাচারী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের অবসান এবং তার বিদায়ের এক দফা দাবিতে পরিণত হয়। যার চূড়ান্ত পরিণতি তার পদত্যাগ এবং দেশে ছেড়ে পলায়ন।

দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে শেখ হাসিনার সব কৌশল ব্যর্থ করে দিয়েছে। তার নির্দেশে যত বেশিসংখ্যক মানুষ হত্যা করা হয়েছে, তত বেশি মানুষ এই আন্দোলনে শামিল হয়েছেন। নারীরা তাদের সন্তানদের সঙ্গে রাস্তায় নেমে আসেন। ছাত্রীরা আরো বেশি এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। তারা বুঝতে পারেন তাদের ভাইদের হত্যা ও নিপীড়ন ঠেকাতে হলে শেখ হাসিনার বিদায় ছাড়া সম্ভব নয়। ফলে ছাত্র আন্দোলন শেখ হাসিনার পতনের এক দফার আন্দোলনে রূপ নেয়। এটি হয়ে উঠে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ছাত্র-জনতার আন্দোলন। ছাত্র আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশের নতুন এক রাজনৈতিক শক্তি প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

শেখ হাসিনা তার ১৮ বছরের শাসনে বাংলাদেশে মানুষের সব ধরনের মৌলিক অধিকার হরণ করেছিলেন। তার শাসনের মূল চাবিকাঠি ছিল ভয় দেখানো। এই ভয় দেখানোর কাজটি করা হতো প্রশাসন, আদালত এবং তার দলের পেটোয়া বাহিনীর মাধ্যমে। ফলে বাংলাদেশের বহু মানুষ ভয়ে অন্যায় শাসনের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। তিনি ভেবেছিলেন দেশের মানুষ তার নিপীড়নমূলক শাসন মেনে নিয়েছে। কিন্তু এ দেশের মানুষ কখনোই তার ফ্যাসিস্ট শাসন মেনে নেয়নি, তারা ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের অপেক্ষায় ছিলেন। ছাত্ররা মানুষের কথা বলার সেই পরিবেশ তৈরি করে দেয়। বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্রটিকে শেখ হাসিনা একটি পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো করে পরিচালনার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষ যে রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক তা তিনি কখনোই মনে করতেন না। তিনি মনে করতেন, তার পিতা ও তার পরিবার এ দেশের মানুষকে একটি রাষ্ট্র এনে দিয়েছে। ফলে গণভবনে বসে এই দেশ শাসন করার একমাত্র এখতিয়ার হচ্ছে তার পরিবারের।

শেখ হাসিনার ১৮ বছরের দুঃশাসনে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, প্রশাসন পরিচালনা ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি পূজার এক অনন্য উদাহরণ তৈরি করেছিলেন। তিনি বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাস চাপা দিয়ে তার বাবা ও পরিবারকে বাংলাদেশের একমাত্র মহানায়ক হিসেবে হাজির করেছিলেন। তার বাবার নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এ নিয়ে এ দেশের মানুষের মধ্যে কারো কোনো দ্বিমত নেই। পৃথিবীর ইতিহাসে চীনের তিয়েন আনমেন স্কোয়ারে ছাত্র আন্দোলনের পরই জীবনহানি সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের এ ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিতীয় বৃহত্তম ছাত্র আন্দোলন বলা যায়। মানুষ হত্যাকাণ্ডের যে দৃশ্যাবলি দেখেছি, নৃশংস ও নির্মমতার দিক দিয়ে তা শুধু মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের হাতে বাঙালি হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেই তুলনা চলে।

সাভারের কাছে পুলিশের আর্মার্ড পারসোনাল কেরিয়ার অথবা এপিসির ওপর থেকে গুরুতর আহত একজন শিক্ষার্থীকে পুলিশ সদস্যরা যেভাবে রাস্তার ওপর ফেলে দিয়েছে, তা দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেছি। শিক্ষার্থীটি হয়তো গুলি অথবা পুলিশের পিটুনি খেয়ে মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন। রাস্তায় পড়ার পর আহত শিক্ষার্থীটিকে নড়াচড়া করতে দেখা গেছে। তিনি টেনে টেনে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। পুলিশ শিক্ষার্থীটিকে ছুড়ে ফেলেই শান্ত হয়নি। পশুর মতো টেনেহিঁচড়ে রাস্তার মাঝ বরাবর নিয়ে যায়, তারপর সড়ক ডিভাইডারের ওপর দিয়ে রাস্তার ওপর পাশে আছাড় মেরে ছুড়ে ফেলে। ততক্ষণে ছেলেটি মরেই গেছে। আহত শিক্ষার্থীকে এভাবে মেরে ফেলার দৃশ্যটি এখনো নেট দুনিয়ায় ভেসে বেড়াচ্ছে। দুনিয়ার যে কেউ এ নির্মম দৃশ্য দেখে নিজেকে স্থির রাখতে পারবেন না। শিক্ষার্থীটি তো আহত ছিলেন, পুলিশের উচিত ছিল এমন পাশবিক আচরণ না করে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া।

জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী, যুদ্ধক্ষেত্রেও আহত শত্রুকে চিকিৎসা দেওয়া রেওয়াজ আছে। এটি যুদ্ধক্ষেত্রও নয়। শিক্ষার্থীটির হাতে কোনো মারণাস্ত্রও ছিল না। তাহলে এমন করে তাকে মেরে ফেলা হলো কেন? আরো একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পুলিশের তাড়া খেয়ে একজন তরুণ রামপুরার একটি নির্মাণাধীন ভবনে জালানার কার্নিশে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নেন। পুলিশের একজন সদস্য তার পিছু পিছু এসে দেখতে পেয়ে খুব কাছ থেকে তিন থেকে চারটি গুলি করে মারাত্মকভাবে জখম করে চলে যায়। আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করেছি, তার পরপরই অন্য একজন পুলিশ সদস্য এসে আরো কয়েক রাউন্ড গুলি করে তরুণটির মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যান, যা ছিল খুবই নির্মম ও বর্ণনাতীত।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শিশুমৃত্যুর হার দেখে জাতিসংঘের শিশু ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। প্রশ্ন উঠেছে, আইনবহির্ভূতভাবে একে সিরিজের অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার নিয়ে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও এসব অস্ত্রের বেআইনি ব্যবহার নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। অথচ এসব অস্ত্র পুলিশের ব্যবহারের জন্য অন্তর্ভুক্ত করা ঠিক হয়নি। কারণ প্রাণঘাতী অস্ত্র কখনো নিরস্ত্র মানুষের বিক্ষোভ দমনে ব্যবহার করা হয় না। মানুষের কোনো রাজনৈতিক পরিচয় পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। অথচ সরকার ও পুলিশের তরফ থেকে সহিংসতায় রাজনৈতিক দলের সংশ্লিষ্টতার কথা বারবার বলা হলেও বেশিরভাগ সাধারণ মানুষই গ্রেপ্তার হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী এবং সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের সংখ্যাই বেশি।

সরকারের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত বৈষম্যবিরোধী এ আন্দোলনকে এতদূর টেনে এসেছে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কবি-লেখক, অভিনয়শিল্পীসহ শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরাও তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী এমন অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন? এর পেছনে সাবেক সরকারের নেওয়া কিছু ধারাবাহিক পদক্ষেপ এমন অস্থির পরিস্থিতি তৈরির জন্য দায়ী। প্রথমেই যে মারাত্মক ভুলটি করেছে তা হলো, অস্ত্রধারী ছাত্রলীগ ক্যাডার ও পুলিশ দিয়ে জোরপূর্বক আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা। ফলে রংপুরের আবু সাঈদসহ ছয়জন শিক্ষার্থীর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এ মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য নেট দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই আন্দোলন অন্যদিকে মোড় নিতে শুরু করে। শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের পাশাপাশি সরকারের কাছে নতুন করে ৯ দফা দাবি পেশ করে। দ্বিতীয়ত, আন্দোলন চলাকালে ঢাকার বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীসহ আরো অধিকসংখ্যক মানুষ নিহত হয়েছেন। অথচ সরকার মৃত্যুর ঘটনায় তেমন গুরুত্ব না দিয়ে, স্থাপনা ধ্বংসের বিষয়গুলো বেশি হাইলাইট করে বক্তৃতা ও বিবৃতি দেওয়া শুরু করে, যা আন্দোলনকারীদের মনে আরো ক্ষোভের সৃষ্টি করে।

তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি আহতদের দেখতে না গিয়ে, প্রথমেই গেলেন ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থাপনা পরিদর্শনে, যা শিক্ষার্থীসহ দেশের সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখেনি। এ নিয়ে নেট দুনিয়ায় তীব্র সমালোচনাও হয়। যদিও পরদিন শেখ হাসিনা আহত ব্যক্তিদের দেখতে হাসপাতালে যান। কিন্তু ততক্ষণে যা ক্ষতি হওয়ার তাই হয়ে গেছে। চতুর্থ, শিক্ষার্থীদের পেশ করা ৯ দফা দাবি নিয়ে আলোচনার পরিবেশ সৃষ্টি না করে সরকার উল্টো বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কারীদের হেফাজতের নামে ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে গেছে। তারপর সমন্বয়কারীদের নিয়ে ডিবি অফিসে যা হয়েছে তা বরং আন্দোলনকারীদের আরো উসকে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালতও হেফাজতের বিষয়টি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেন। পঞ্চমত, হত্যাকাণ্ডের মামলাগুলো নিয়ে পুলিশ যা করেছে, তা নিয়ে সরকারের আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে মানুষের ভেতর সন্দেহের দানা বেঁধেছে।

রংপুরের সর্বাধিক আলোচিত আবু সাঈদসহ দেশের অন্যান্য স্থানের হত্যাকাণ্ডের এজাহারে পুলিশের গুলি করার কথা উল্লেখ না করে, এসব হত্যাকাণ্ডের দায় তৃতীয়পক্ষের ওপর চাপানোর যে চেষ্টা চলেছে, তা জনগণকে খেপিয়ে তুলেছে। অবশ্য পরে এ হত্যার দায়ে একজন এসআই ও একজন কনস্টেবলকে বরখাস্ত করা হয়। যেসব ছাত্রলীগ ও যুবলীগের অস্ত্রধারী নেতাকর্মীদের নাম ও ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে, তাদের গ্রেপ্তার করে আইনি কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের মন্ত্রীরা শিক্ষার্থীদের হয়রানি করা হবে না মুখে বললেও দেশের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর আক্রমণ করেছে। ফলে, সরকারের ওপর থেকে জনগণের আস্থা চলে যায়। দেশের নাগরিকরা আর শেখ হাসিনা সরকারের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি। এরই ধারাবাহিকতায়, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির প্রতিবাদী মানুষ একে একে আন্দোলনে গিয়ে যোগ দিয়েছেন। ক্ষমতা স্থায়ী নয়। জোর করে ক্ষমতায় আসা যায়, অনেক দিন থাকাও যায়। কিন্তু একসময় বিদায় অনিবার্য হয়। জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হতে হয়। শেখ হাসিনার করুণ বিদায়ের মধ্য দিয়ে তা আরেকবার প্রমাণ হলো।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার, কলাম লেখক

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close