এ কে এম শাহনাওয়াজ
মতামত
‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’
নানা আবর্জনায় অনেককাল ধরে কলুষিত হচ্ছিল স্বদেশ। সুস্থ জনকল্যাণকামী রাজনীতি আমরা খুঁজে পাইনি। সুশাসন ছিল অধরা। ক্ষমতাসীনরা দলীয়করণের কাঠিন্যে নিজেদের মধ্যে একটি অচলায়তন তৈরি করে রেখেছিলেন। ফলে গণমানুষের দল আওয়ামী লীগ অনেকটা গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। দলীয় নেতা-নেত্রীরা নিজ দলীয় গণ্ডিটিকেই তাবৎ বাংলাদেশ মনে করছিলেন। তাই সাধারণ মানুষের পালস বোঝার চেষ্টা করেননি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভাবনীয় উন্নয়ন করেছেন এ দেশে, তা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু সাধারণ মানুষের নিত্যদিনের কষ্ট বোঝার চেষ্টা করেননি তিনি।
আমরা আমাদের লেখায় বহুবার বলার চেষ্টা করেছি হাজার উন্নয়ন করলেও মানুষ যাপিত জীবনের কষ্ট বা আনন্দটিকেই বেশি মনে রাখে। সুতরাং পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ, ফ্লাইওভার নির্মাণ করা, যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন করার পরও মানুষ যখন বাজারে গিয়ে সংসারের হিসাব মেলাতে পারে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ শিক্ষার্থী যখন ছাত্রলীগের নির্যাতনে বিপন্ন বোধ করে এবং দলীয় নেতৃত্বের কাছ থেকে প্রতিকার পায় না; মেধাবী ফলাফল করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী শিক্ষার্থী যখন দেখে তাকে টপকিয়ে দল পরিচয়ে পেছনের সারির কেউ শিক্ষক হয়ে যায়। দলীয় বিচারে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন বিন্যাস করে উচ্চশিক্ষার পীঠস্থানে জ্ঞানচর্চার গতিকে শ্লথ করে দেয়।
রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্নীতিতে চারপাশ ছেয়ে যায়। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নির্বাচনী গণতন্ত্রকে বিপন্ন করে তখনই আবর্জনায় আকীর্ণ হয়ে পড়ে চারপাশ। এ আবর্জনা দূর করতে সরকার কোনো উদ্যোগ না নিলে মানুষ তো একসময় মুখ ফিরিয়ে নেবেই। ‘অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’ আওয়ামী লীগের মতো ঐতিহ্যবাহী বড় দলের এমন হোঁচট খাওয়ার পেছনে কোনো দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র আছে কি না আমরা জানি না। তবে কর্মের দায় তো নিতেই হবে।
কর্মফল এড়ানো খুব কঠিন। দুদিন আগেও ভাবতাম বিপন্ন গণতন্ত্রের এ দেশে কীভাবে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে! কোনো আলো দেখা যাচ্ছিল না। তখনই ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে মনে সাহস আসত এই ভেবে যে যখন সব সম্ভাবনা অন্ধকারে তলিয়ে যায়, তখন ইতিহাসই নায়ক নির্বাচন করে দেয়। না হলে ১০০ বছর অরাজকতায় ছেয়ে যাওয়া বাংলার রাজনৈতিক অঞ্চলে যখন ঘোরতর অন্ধকার, তখন অচেনা গোপাল এসেছিলেন ত্রাতার ভূমিকায়। আবার বাংলা ঘুরে দাঁড়ায়। ৪০০ বছরের সমৃদ্ধ শাসন উপভোগ করে বাঙালি। তেমনি অরাজনৈতিক শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন একটি বড় পরিবর্তন এনে দিল। নিজেদের দাবি আদায় ছাড়া বড় কোনো প্রত্যাশা নিয়ে আন্দোলন শুরু হয়নি। কিন্তু নানা ঘটনার ঘনঘটা আন্দোলন নিয়ে যায় অনেক দূর। একটি সাধারণ দাবি-দাওয়ার আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। সরকার পতন ঘটায়। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক অবয়বটিই আমাদের কাছে আশার বিষয়। সততাকে দৃঢ় রেখে এই বিপ্লবীদের সতর্ক অবস্থান নীতিনির্ধারকদের দেশপ্রেমিক করে তুলতে পারে।
আমরা এখন আশায় বুক বাঁধছি একটি আবর্জনামুক্ত শুচিশুভ্র বাংলাদেশ দেখতে। কিন্তু তেমন করে দেশকে খুঁজে পেতে হলে বড় বড় চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করতে হবে। আশার কথা, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের সভায় কোটা আন্দোলনের সমন্বয়ক কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। শুধু কোটা সংস্কার আন্দোলন নয়, এই তারুণ্যের নেতৃত্বে একটি গৌরবজনক বিপ্লবও ঘটে গেল।
এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান কাজ থাকবে নির্বাচন আয়োজন করা। সেই লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হবে, এটিই আমাদের প্রত্যাশা। অনেক দিন পর একটি প্রকৃত নির্বাচন দেখার অধীর অপেক্ষা করছি আমরা। এর আয়োজন করতে একটু বেশি সময় লাগলেও তা দেওয়া উচিত। সুন্দরভাবে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হারানো গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পথ রচিত হবে বলেই আমাদের বিশ্বাস। তবে আমরা মনে করি, মাঝখানের কয়েকটি মাস সরকারের রুটিন কাজগুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মাঝখানে বন্ধ হয়ে যাওয়া এইচএসসি পরীক্ষা সুসম্পন্ন করা এখন জরুরি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেসব উপাচার্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষকের ক্ষোভ আন্দোলনে রূপ নিয়েছিল, অথচ আওয়ামী লীগ সরকার দলীয় আনুগত্যের কারণে ভিসি পরিবর্তন করেনি। এই আলোকে ভিসি ও তাদের প্রশাসনকে এখনই পরিবর্তন করতে হবে। না হলে শিক্ষার সার্বিক ক্ষতি হতে থাকবে।
অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা বিধানের পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে, যাতে নির্বাচিত সরকার পরবর্তী নীতিনির্ধারণে সহায়তা পায়। দুদকের হাতে থাকা দুর্নীতির চলমান তদন্তগুলো যেন থেমে না যায়। নতুন নির্বাচিত সরকার আসার আগে ঋণখেলাপিদের বিস্তারিত তালিকা করে ফেলা জরুরি, যাতে নির্বাচিত সরকার খেলাপি ঋণ ফিরিয়ে আনার দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে বড় বাধা থাকবে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের দল পরিচয়। কারণ নানা দলেরই ঋণখেলাপি রয়েছে। আমাদের আশার আলো, বিপ্লবী শিক্ষার্থীরা এদিকে নিশ্চয়ই নজর রাখবেন।
খুব জরুরি প্রয়োজন আমলাতন্ত্রে সংস্কার আনা। গত ১৫ বছরে সরকারকে নিরাপদে রাখতে এবং নির্বাচনী গণতন্ত্র নষ্ট করায় আমলাদের সুবিধাবাদী অংশ বড় ভূমিকা রেখেছে। বিনিময়ে আমলাতন্ত্র সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী গোষ্ঠী হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। এর পথ ধরে আমলাতন্ত্র দুর্নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। খুব কঠিন যদিও, তবু বলব কীভাবে দেশপ্রেমিক এবং জনকল্যাণকামী আমলাদের দৃঢ় অবস্থানে আনা যায় সে ব্যবস্থা অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্য দিয়েই শুরু করতে হবে। সচিবালয়ের অচলায়তন ভাঙতে না পারলে রাষ্ট্রের প্রশাসন জনকল্যাণকামী এবং দুর্নীতিমুক্ত হতে পারবে না।
দেশের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য রক্ষার দায়িত্ব নেওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দলীয়করণের কারণে অথর্ব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়ে পড়েছে। এ ক্ষেত্রে আমি বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর- এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কথা বলছি। জাতির অহংকার সংরক্ষণ ও ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করবে এসব প্রতিষ্ঠান। কিন্তু দলীয়করণের বদ্ধ কুঠরিতে থেকে এসব প্রতিষ্ঠান কাম্য ভূমিকা রাখতে পারছে না।
শিক্ষাকে যদি জাতির মেরুদণ্ডই ভাবি, তবে নির্বাচিত সরকারের জন্য একটি লাগসই পথনির্দেশনা দিয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকেই। জাতির দুর্ভাগ্য শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনায় বেশির ভাগ সময়ে আমরা কোনো শিক্ষাবিদকে পাইনি। শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিজ্ঞ মানুষ ছাড়া শিক্ষাব্যবস্থার নানা গতি-প্রকৃতি ও সূক্ষ্ম বিষয়গুলো বুঝে নীতিনির্ধারণ করা কঠিন। দলান্ধ সচিবদের বুদ্ধিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চালাতে গিয়ে আমাদের শিক্ষার বেহাল অবস্থা তো আমরা দেখেছি। আওয়ামী লীগ আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনার গুরুত্ব বিবেচনা করা হয়নি। প্রথমে মন্দের ভালো হিসেবে নাহিদ সাহেবকে মন্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলাম। অতঃপর ঘোর অন্ধকারে পড়তে হলো। শিক্ষা মন্ত্রণালয় পরিচালনার মতো কোনো মেধার প্রকাশ দেখিনি ডা. দীপু মনির কাছ থেকে। মন্ত্রণালয় ও এনসিটিবি-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে এই মন্ত্রীর আর্থিক দুর্নীতির সাতকাহন শুনে বিস্মিত হয়েছি। কারিকুলাম আধুনিকায়নের নামে টাকা হরিলুট হয়েছে। দলীয় তকমার অযোগ্য বিশেষজ্ঞ দিয়ে কারিকুলাম তৈরি ও গ্রন্থ প্রণয়ন করতে গিয়ে লেজেগোবরে করে ফেলা হয়েছে স্কুলশিক্ষা। সাবেক প্রধানমন্ত্রী কোন যোগ্যতায় দেশের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণাবর্জিত নওফেল সাহেবকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ মন্ত্রী বানালেন, ভেবে বিস্মিত হতে হয়েছে। আমরা মনে করি, দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থাকে বাঁচাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও এর সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও দপ্তরগুলো যতটা সম্ভব দুর্নীতিমুক্ত করে একটি যৌক্তিক অবস্থানে নিয়ে আসার বিষয়টি নীতিনির্ধারক মহলকে ভাবতে হবে।
আসলে সব ক্ষেত্রে আমাদের অতৃপ্তি এত বেশি ছিল যে এখন নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আমরা অনেক বেশি প্রত্যাশার অর্গল খুলে দিয়েছি। অন্তত এটুকু প্রত্যাশা করতে পারি, আবর্জনা আক্রান্ত চারপাশ কিছুটা হলেও শুচিশুভ্র হোক।
লেখক : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
"