শাহীদ কামরুল

  ১১ আগস্ট, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ইতিহাসের সাহসী প্রজন্ম

আমরা ছোটবেলায় যেসব গান শুনে বড় হয়েছি, তা মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের প্রাণের মূল্যকে এমন এক ঋণ হিসেবে উপস্থাপন করত, যা কোনো দিন শোধ হওয়ার নয় (তোমাদের এই ঋণ কোনো দিন শেষ হবে না)। সার কথা হলো- তোমাদের প্রাণের মূল্য আমরা কোনো দিনই দিতে পারব না। মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশের ওপর অনন্ত মালিকানা দাবি করে গণতন্ত্রকে সামন্ততন্ত্রে পরিণত করার চর্চাটা এ ধরনের তত্ত্বে নিমগ্ন থাকা একটা সমাজেই বিকশিত হয়েছিল এবং হয়ে আসছিল। তবে ছাত্রদের এই আন্দোলন এরই মধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে যে ওই যুগটি শেষ হতে চলেছে।

আমরা একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছি। লাখো শহীদের রক্তের মূল্য না চুকিয়ে পার পাওয়া যাবে না। আর এই মূল্য চোকানোর অর্থ হলো বাংলাদেশটাকে একনায়কের কাছ থেকে নিয়ে জনগণের হাতে কর্তৃত্ব প্রদান করা।

দেশের সব মানুষের সমান মানবিক মর্যাদা, সবার জন্য ন্যায়বিচার ও মৌলিক অধিকার লাভের দিক থেকে সাম্য প্রতিষ্ঠা করাই হলো মুক্তিযুদ্ধের চেতনা।

কোটা সংস্কার আন্দোলন সামন্তবাদ আর বৈষম্যের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকেই শক্তিশালী করেছে। মনে রাখা দরকার বলে মনে করি যে বাংলাদেশ কোটায় স্বাধীন হয়নি। লাখো প্রাণের বিনিময়ে যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। চাকরিটাও যাতে কোটায় না হয়। মেধা আর যোগ্যতার লড়াই করেই চাকরিটা যেন হয়- এটাই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শিক্ষা।

মানবিক মর্যাদা কথাটার অর্থ হলো সব মানুষের মর্যাদা তথা মূল্য সমান। কারো প্রাণের মূল্য অন্য কারো প্রাণের মূল্যের চেয়ে কম বা বেশি নয়। কিন্তু এই দুনিয়ার একটা নিষ্ঠুর বাস্তবতা হলো যে বাস্তবে সবার প্রাণের মূল্য সমান ধরা হয় না। আজকের সারা দুনিয়ার দিকে তাকালেই তা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়।

দুনিয়ার সবচেয়ে কম দামি হলো বাংলাদেশের মানুষের প্রাণ। বস্তুত প্রাণের মূল্য এখনো নির্ধারণ করেন প্রাণের অধিকারীরাই। আপনি আপনার প্রাণের মূল্য যত কম দেবেন, অন্যরাও আপনার প্রাণকে ততই কম মূল্য দেবে। এটাই এই জুলুমের দুনিয়ার নিয়ম। সুতরাং নিজেদের প্রাণের উচ্চমূল্য নির্ধারণের কোনো বিকল্প নেই। নিজের প্রাণের ওপর সর্বোচ্চ মূল্য নির্ধারণ করুন।

ইতিহাসের সাহসী প্রজন্ম আমার মনে হয়, কোটা আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’ বলা হয়েছে, এর জের ধরে তারা নিজেদের ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার’ বলেছেন। পরে তারা নাকি স্লোগান সংশোধন করেন। কিন্তু এর আগে ঘটনা ঘটে গেছে।

এই ইস্যু আওয়ামী লীগ সরকার রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ ন্যারেটিভের লেন্স ঠিক রাখতে। এইটারে একটা চশমা হিসেবে দেখেন। তারা এই চশমা জনগণের সামনে দিয়ে রেখেছে। সময়ের সঙ্গে, দেশ শাসনের অব্যবস্থাপনায় এতে ধুলাময়লা জমে। তখন টিস্যু দিয়ে কাচ সাফ করতে হয়। এই টিস্যু দিয়ে সাফ করাটাই হলো নতুন করে কোনো ইস্যু ধরে আবার প্রসঙ্গটাকে আনা ও বলা আমরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তি আর বিপক্ষরা রাজাকার।

কোটা আন্দোলনে রাজনৈতিক প্রভাব অবশ্যই ছিল। বিএনপি-জামায়াতপন্থি ছাত্রছাত্রীরা এতে বেশি সমর্থন দিতে পারেন এবং এতে কোনো সমস্যা নেই। ইভেন, বিএনপি-জামায়াত নিজেদের ফায়দার জন্য ইন্ধন দিলেও সমস্যা নেই। স্ট্র্যাটেজি হিসেবে তাদের জন্য এটা কেমন লাভজনক তা ভিন্ন আলাপ।

স্ট্র্যাটেজিক গেমে আপনি যে চাল দেবেন, আপনার প্রতিপক্ষ কী চাল দেবে, এরপর আপনি কী করবেন, অন্তত এই পর্যন্ত আগেই ভেবে নিতে হয়। ভালো স্ট্র্যাটেজিস্ট আরো অনেক দূর পর্যন্ত ভাবেন। রাজনীতি একটা ফ্লুয়িড স্ট্র্যাটেজিক গেম। এখানে নানা পার্টি ও নানা ইনফ্লুয়েন্স যুক্ত থাকায় বাস্তবতা নানা রূপ ধারণ করে। তখন অবস্থা বুঝে দ্রুত চাল দিতে হয়, চাল পাল্টাতে হয় এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির সুবিধা নিতে হয়। রাজনীতি করতে করতে অভ্যস্ত যারা, তারা এ রকম পরিস্থিতি আগে থেকেই মোকাবিলা করে আসছেন, তাই তারা দ্রুত ভালো চাল দিতে পারেন । অন্যদিকে প্রতিপক্ষ অনভিজ্ঞ হলে তো কথাই নেই।

নিতান্ত শিশু না হলে আপনি বুঝবেন ছাত্রছাত্রীরা যে বলছিল, তুমি কে আমি কে, রাজাকার রাজাকার, ওইটা ব্যঙ্গাত্মক। তারা নিজেদের বলেনি আমি গর্বিত রাজাকার। তারা রেসপন্স হিসেবে ব্যঙ্গার্থে বলেছে। কিন্তু গৃহীত হয়েছে আক্ষরিক অর্থে। ‘দ্য ইনসাইডার’ ফিল্মে সম্ভবত এই কথা ছিল। অনেক আগে দেখা তাই বাক্যটা ভুলে গেছি, কিন্তু মেসেজটা মনে আছে।

প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের কথা বলি। বিএনপি-জামায়াতকে এতটাই দুর্বল করে ফেলা হয়েছে যে ছাত্রছাত্রীরা সব আওয়ামী দলীয় ক্যাডার এবং সরকারি বাহিনীগুলোকে ধরাশায়ী করার পরও তারা মাঠে নামতে পারেনি, দূর থেকে ভাসা ভাসা সাপোর্ট ছাড়া এবং রাজনৈতিকভাবে দূরদর্শিতার প্রমাণও দেখাতে পারেনি। উভয় দলই বসে ছিল কখন দেশের মানুষ গণ-অভ্যুত্থান ঘটাবে। সরকার হয়তো ভেবেছিল এ আন্দোলনটা দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরের ব্যর্থতা আড়াল করা যাবে, কিন্তু ঘটেছে উল্টোটা।

সরকার এ আন্দোলনটিকে ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন বা বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের মতো প্রথমে তেমন কোনো কেয়ার করেনি, সরকার ভেবেছিল আগের আন্দোলনগুলোর মতো এটাকেও দমন করতে পারবে, কিন্তু সরকারের নীতিনির্ধারকরা

এটা বুঝতে ভুল করেছে যে সরকারের প্রতিপক্ষ

আবার কিন্তু ১৮ সালের আন্দোলনকারী কিংবা বিএনপি-জামায়াত নয়, বরং ২০২৪ সালের বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে সাহসী প্রজন্ম।

আর এই প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা ২০১৮ সালের কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন করে অনেক পরিপক্ব হয়েছে এবং অভিজ্ঞতা সঞ্চার করেছে। যার কারণে এরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে অকপটে জীবন দিয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলন দমন করতে গিয়ে এই রেজিমের খাতায় এমন এক কালিমা লেপন হলো, যা সাফ করা অসম্ভব। ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগ আর রাজনীতি করতে পারবে কি না, আমি যথেষ্ট সন্দিহান। সারা দেশে যে সফল ছাত্র অভ্যুত্থান ঘটে গেল, দেশের প্রতিটি সেক্টরে তার

প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। দেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীরা আজ একযোগে এই সরকারের বিরুদ্ধে নিজেদের নৈতিক অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে।

আসলে বাংলাদেশে যে একটা সফল ছাত্র-জনতার বিপ্লব ঘটে গেল। এটাতে আমি আশ্চর্য হইনি। কারণ দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশে এমন একটা অবস্থা বিরাজ করছিল। উনসত্তর থেকে একাত্তরের ব্যবধান মাত্র তিন বছর। ডিজিটাল যুগে আমাদের এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হয়নি, বাংলাদেশের জনগণ আসলেই একটি গণ-অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল, যা অবশেষে ৫ আগস্ট ২০২৪ ছাত্র-জনতার বিপ্লবে রূপ নিল। এই বিপ্লবটা কিন্তু পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটা বিপ্লব। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে এখন আর স্বাভাবিকভাবে রাজনীতি করারও কোনো উপায় নেই।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, গবেষক ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close