শ্রী উজ্জ্বল কুমার রায়

  ০৮ আগস্ট, ২০২৪

মুক্তমত

রবীন্দ্রনাথের পছন্দের পোশাক ধূতি-পাঞ্জাবি

শান্তি নিকেতনে একটি মারাঠি ছেলের গল্প শুনিয়েছেন রসিকপ্রবর সৈয়দ মুজতবা আলী... ‘দেহলী থেকে বেরিয়ে শালবীথি হয়ে গুরুদেব চলেছেন লাইব্রেরির দিকে, পরণে লম্বা জোব্বা, মাথায় কালো টুপি। ভান্ডারে দেখামা এই ছুটলো তাঁর দিকে...। আড়াল থেকে সবাই দেখলে ভান্ডারে গুরুদেবকে কী যেন একটা বললে, গুরু দেব মৃদুহাস্য করলেন, মনে হল যেন অল্প অল্প আপত্তি জানাচ্ছেন। ভান্ডারে চাপ দিচ্ছে। শেষটা গুরুদেবের হাতে কী যেন গুঁজে দিলো। গুরুদেব আবার মৃদুহাস্য ক’রে জোব্বার নীচে হাত চালিয়ে ভিতরের জেবে সেটি রেখে দিলেন।’

মারাঠি বালকের পদবি ভাণ্ডারে, সদ্য এসেছে শান্তি নিকেতনে পড়তে। বেচারা তখনো চিনত আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথকে। সে জানত, পথে ফকির-দরবেশ দেখলে কিছু দান করতে হয়। মায়ের পরামর্শ এটি। তাই একটি ‘আঠান্নি’ সে দান করেছে ‘ফকির’ রবীন্দ্রনাথকে!

মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনায় পড়লেও এই আলখাল্লা বা জোব্বা অনেক দিক থেকে সাহায্য করেছে রবীন্দ্রনাথকে। সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে ‘গুরুদেব’ বা ‘ঋষি’ হয়ে উঠতে, আর ঠাকুরপুজোর মূর্তি হয়ে উঠতে। অথচ এমন নয় যে, চিরকাল এটাই ছিল তার পোশাক; এই বাদশাহী আলখাল্লা এসেছে জীবনের শেষ পর্বে। তার আগে নানা সময়ে নানা পোশাকে দেখা গিয়েছে তাকে। অন্নদাশঙ্কর লুঙ্গি পরতেও দেখেছেন। ১২-১৩ বছর বয়স থেকে আশি বছর বয়স পর্যন্ত তোলা রবীন্দ্রনাথের আলোকচিত্রগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে পোশাকের পরিবর্তন স্পষ্ট চোখে পড়ে। পুত্র রবীন্দ্রনাথের সাক্ষ্যে জানা যায়, সে তালিকায় ছিল পাজামা, ধূতি, পাঞ্জাবি, ট্রাউজার, গলাবন্ধ-কোট, আচকান, চোগা-চাপকান, পরহান, পাগড়ি-টুপি-চাদর ইত্যাদি। কিন্তু পঁচিশে বৈশাখ চিরদিন রবীন্দ্রনাথকে দেখেছে ধূতি-পাঞ্জাবি-উত্তরীয়তে। এমনকি, ইরানে, চীন দেশে, হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে, প্রশান্ত মহাসাগরে ভেসে চলা জাপানি জাহাজে।

তবু ধূতি-পাঞ্জাবিকে বাঙালি পুরুষের মান্য পোশাক বলে চিরকালের তো দাগিয়ে দেননি রবীন্দ্রনাথ। উত্তীর্ণ যৌবনে এসে পাঠান-মোগলের পোশাক ছেড়ে সাধারণ বাঙালির ধূতি-পাঞ্জাবিকে বরণ করলেও মনে হয় এ সময় থেকেই বাঙালি পুরুষের জন্য একটা মান্য পোশাক নির্ধারণ করার অলিখিত দায় নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। সম্ভবত তার একটি কারণ, ইতিমধ্যে তারই মেজবউদি জ্ঞানদানন্দিনী দেবী বাঙালি রমণীর শাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন রমণীয়তা ও শালীন আধুনিকতা। হয়তো আরো একটি কারণ, বড়দা দ্বিজেন্দ্রনাথের ব্যঙ্গ, ‘বিনা কোটটা হ্যাটাটা ধূতি পিরহানে মান রয় না’। বাঙালি রমণীর শাড়ি, নান্দনিকতা ও আভিজাত্য এ পোশাক আমাদের চিরকালের গর্বের ধন; এবং তখনই মনের মধ্যে প্রশ্ন জাগে, তাহলে বাঙালি পুরুষের পোশাক কী? কিংবা আদৌ কোনো নিজস্ব পোশাক আছে কি? ধূতিটুকু মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু পাঞ্জাবি? সে তো বাঙালির নয়, শব্দটির মধ্যেই রয়েছে উত্তর ভারতীয় ছোঁয়া, এসেছে আরো উত্তরের দেশ থেকে।

বাঙালি পুরুষের পোশাকের দৈন্য প্রথম ধরা পড়েছিল দ্বারকানাথ- রামমোহনের মতো নবজাগ্রতদের কাছে। উনিশ শতকে সে পোশাকের ত্রিমুখী বিবর্তন চোখে পড়ে। একটি কোট-প্যান্ট ইত্যাদি সাহেবি পোশাক, আরেকটি ধূতি-চাদরে মোড়া বাঙালির পোশাক, অন্যটি আফগানিস্তান-তুরস্ক থেকে আসা মুসলমানি পোশাক। আর এখন চলছে এসবের মিলিজুলি সংস্করণ। কয়েক দশক আগেও ধূতির ওপরে কোট পরা বাঙালি দেখা যেত, কিংবা মুসলমানি পাজামার সঙ্গে ইউরোপীয় শার্ট। গেঞ্জি-বারমুডা এসেছে হালে। তবু পাঞ্জাবির সঙ্গে ধূতি বা পাজামা থাকলেই বাঙালি পুরুষের মোটামুটি মান্য পোশাক বলে ধরে নেওয়া হয়। অথচ ধূতি-পাঞ্জাবির এই সমন্নয়টি কিন্তু দো-আঁশলা। পাজামার তো কথায় নেই। পাঞ্জাবি এসেছে উওর-পশ্চিম ভারত থেকে বা আরো বেশি উত্তর-পশ্চিমে ভারত সীমার বাইরে ইরান-আফগানিস্তান থেকে। এটা জানতেন ঠাকুর পরিবারের আলোকপ্রাপ্ত পুরুষরা। তাই পাঠান-মোগল পোশাকের সঙ্গে খানিকটা ইউরোপীয় স্টাইল মিশিয়ে তার ওপরে বাঙালির চাদর কাঁধে তুলে নিয়ে সমন্নয়বাদী হয়েছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। এমনকি রবীন্দ্রনাথও। কিন্তু তৃপ্তি আসেনি এবং একে চূড়ান্ত বলেও মানতে পারেননি। তাই পোশাক বদল করেছেন বারবার। কিন্তু, পঁচিশে বৈশাখে জন্মদিনের উৎসবে ধূতি-পাঞ্জাবিতেই সবচেয়ে বেশি স্বচ্ছন্দ ছিলেন। আনুষ্ঠানিকভাবে তার জন্মদিন প্রথম পালিত হয় ২৭ বছর বয়সে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্যি যে, ২৫-২৬ বছর বয়স পর্যন্ত ঠাকুরবাড়ির এই কনিষ্ঠ পুত্রটির জন্মদিন উদযাপনের কোনো খবর পাওয়া যায় না। মা বা অতি প্রিয় দুই বউদি, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী ও কাদম্বরী দেবী, কেউই বালক রবীন্দ্রনাথের সামনে প্রদীপ জ্বালিয়ে পায়েশের বাটি এগিয়ে দিয়েছেন, এমন কোনো খবর- ছবি নেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সে দায়িত্ব প্রথম নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন অনুজ দুই ভাগনে-ভাগনি, সরলা দেবী ও জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল। জীবনের ঝড়াপাতা গ্রন্থে সরলা দেবী লিখেছেন, ‘রবীমামার প্রথম জন্মদিন উৎসব আমি করাই।... অতি ভোরে... তাঁর ঘরে তাঁর বিছানার কাছে গিয়ে বাড়ির বকুল ফুলের নিজের হাতে গাঁথা মালা ও বাজার থেকে কিনে আনা বেলকুলের মালার সাথে অন্যান্য ফুল ও একজোড়া ধূতি চাদর তাঁর পায়ের কাছে রেখে প্রণাম করে তাঁকি জাগিয়ে দিলুম। এই ধূতি-চাদরই ছিল তাঁর জন্মদিনের প্রিয় পোশাক।’

বৃদ্ধ বয়সে সেই বিখ্যাত জোব্বার পাশাপাশি এই ধূতি-চাদরই অঙ্গে তুলে নিতেন পঁচিশে বৈশাখে।

লেখক : প্রবন্ধকার

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close