মো. তাহমিদ রহমান
দৃষ্টিপাত
দ্রুত সচল হোক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
মানবসম্পদ নির্মাণের অন্যতম কৌশল হলো শিক্ষা। একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের উদ্দেশ্যেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নির্ধারিত হয় শিক্ষাক্রম ও শিক্ষাকৌশল। অনিশ্চয়তার ভবিষ্যৎকে সহজ করে সততা, নিষ্ঠা, আত্মসচেতনতা ও সাহসিকতার সঙ্গে মানিয়ে নিতেই মানুষ শিক্ষার শক্তিতে বলীয়ান হয়। সাম্প্রতিক অতীতে প্রাকৃতিক এবং মনুষ্যসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে শিক্ষাব্যবস্থা অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে এবং কাঙ্ক্ষিত ফল লাভের ক্ষেত্রে বিভিন্ন বাধার সম্মুখীন হয়েছে। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে টানা ১৭ মাস বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার শুরুর দিকে সরকার সংসদ টেলিভিশনের প্রোগ্রাম ‘আমার ঘর, আমার স্কুল’ এবং মোবাইল ফোন ব্যবহার করে শিক্ষাকার্যক্রম চালুর উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সামগ্রিক পরিকল্পনার অভাব ছিল সুস্পষ্ট।
প্রান্তিক অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের টেলিভিশন সেট এবং মোবাইল ডিভাইস-ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় মাত্র ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী এতে উপস্থিত থাকতে পেরেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় তিন বছর ধরে সেই অচলায়তন সারিয়ে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় বার্ষিক মূল্যায়ন ছাড়াই পরবর্তী শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের উন্নীত করা হয়। কোনো পরীক্ষা না নিয়েই ‘অটোপাস’ নামে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করা হয়। এরূপ বিবিধ কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে শিখন ঘাটতি রয়ে গেছে। মহামারির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়েছে। গত কয়েক বছরে শিক্ষায় যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে, তা পূরণে আন্তরিক কোনো সরকারি উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়। বিভিন্ন কারণে শিক্ষায় যখন নাজেহাল অবস্থা ঠিক তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে পরপর কয়েকটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়।
তীব্র দাবদাহ ও বন্যার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটির তালিকায় শীতকালীন যে বন্ধ রাখা হয়েছে, সেখানে সংস্কার এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। বর্ষাকালে সৃষ্ট বন্যায় প্রতি বছর একটা দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়, তাই শীতকালীন ছুটির ব্যবস্থাটি সংস্কার করে বর্ষাকালে নিয়ে এলে বার্ষিক শিক্ষার শিখন ঘাটতি কিছুটা পুষিয়ে আনা যাবে। মাধ্যমিক স্তরে গত বছর শুরু হওয়া নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা এখনো পরিপূর্ণ রূপে অভিযোজিত হতে পারেনি। প্রণীত নতুন শিক্ষাক্রম শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবক সমাজ- কেউই মন থেকে গ্রহণ করেনি। তার ওপর নতুন শিক্ষাক্রমে সব পরীক্ষার আগে ইন্টারনেটে প্রশ্ন ও উত্তর ফাঁস এখন যেন ওপেন সিক্রেট হয়ে দাঁড়িয়েছে! মহামারি-পরবর্তী প্রভাব পাবলিক পরীক্ষায় এখনো বিদ্যমান। এসএসসি পরীক্ষা পূর্ণাঙ্গ সিলেবাসে অনুষ্ঠিত হলেও এইচএসসি পরীক্ষা এবারও অনুষ্ঠিত হচ্ছে সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ১ জুলাই থেকে সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয় স্কিম’ বাতিলের দাবিতে শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সর্বাত্মক কর্মবিরতির কারণে বন্ধ হয়ে যায় ক্লাস ও পরীক্ষা।
গুচ্ছভুক্ত ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি কার্যক্রম এখনো শেষ হয়নি। গুচ্ছ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক ভর্তি পরীক্ষা এখনো অনুষ্ঠিতই হয়নি। বন্ধ হয়ে আছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কলেজগুলোয় ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের স্নাতক (পাস) ভর্তির কার্যক্রম। স্নাতক শিক্ষাজীবন শুরুর আগেই শিক্ষার্থীরা তাদের মূল্যবান একটি বছর কর্মজীবনে যুক্ত হওয়ার সীমারেখা থেকে হারিয়ে ফেলল। কোটা সংস্কারের আন্দোলনের ফলে স্থগিত করা হয়েছে মাধ্যমিক পর্যায়ের ষাণ¥াসিক পরীক্ষা। স্থগিত হয়ে গেছে ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের একাদশ শ্রেণির ভর্তি কার্যক্রমও। চলমান এইচএসসি পরীক্ষা স্থগিত করে শিক্ষা বোর্ডসমূহ নতুন করে রুটিন প্রকাশ করেছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে নতুন রুটিনে পরীক্ষা গ্রহণ কতটুকু সম্ভব হবে তা নিয়েও কর্তৃপক্ষ সন্দিহান। একের পর এক অনাকাঙ্ক্ষিত কারণে দীর্ঘ হচ্ছে শিক্ষার ক্ষত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যবস্থা মূলত ‘শিক্ষা ও চিকিৎসার’ সমন্বিত ব্যবস্থাপনা।
দীর্ঘ মেয়াদে বিশেষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ থাকলে প্রতিবন্ধিতাবৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ওপর বিরূপ প্রভাব প্রতিফলিত হয়। সরকারের অদূরদর্শী সিদ্ধান্তের কারণে আরো একটি বড় ধাক্কা পেল আমাদের শিক্ষা খাত। নিরাপত্তা পরিস্থিতি বিবেচনায় গত ৫ আগস্ট থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয় এবং পরে জনগণের আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশের ক্ষমতা বুঝে নিয়েছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান। রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে। দেশের চলমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ফিরে আসুক। একটি সম্ভাবনাময়, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, স্বল্পোন্নত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অব্যাহত থাকুক বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা। ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বৈষম্য, বঞ্চনা মুক্ত হয়ে দেশে বিরাজ করুক সুখ, শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধি। শিক্ষার অগ্রগতি অব্যাহত থাকুক। সংবিধানের আলোকে সব নাগরিকের জন্য নিশ্চিত হোক আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সাম্য ও সুবিচার।
লেখক : প্রভাষক (তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ)
নূরুল আমিন মজুমদার ডিগ্রি কলেজ, লাকসাম, কুমিল্লা
"