ফাতিমা পারভীন

  ০৭ আগস্ট, ২০২৪

মুক্তমত

প্রতিটি ঘরে একজন ন্যায়পরায়ণ ‘মা’ প্রয়োজন

আর দশজনের মতো আমি শহরে জন্ম নিয়ে বেড়ে উঠিনি। উপকূলীয় এলাকায় আমার জন্ম। আমার মা অতি শিক্ষিত ছিলেন না, নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হতে পেরেছিলেন, আমার নানা ভাইয়ের কারণে। এরপর একাধিক সন্তান লালনপালনের মহান দায়িত্ব পালন করেন আমার মা। যদিও আমার মায়ের মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই বিয়ে হয়েছিল। তখনকার সময়ে পণ দিয়ে বিয়ে হতো। আমার মায়েরও পণে বিয়ে হয়। তখনকার সময়ে ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পরিবারের বিয়েগুলো এমন করে সম্পাদন হতো। মেয়েদের পণ (নগদ অর্থ কিংবা সম্পদ সম্পত্তি) দিয়ে বিয়ে করতে হতো।

আমার মায়ের জ্ঞান ও বিচক্ষণতার সঙ্গে যার পরিচয় হয়নি, তাকে বোঝাতে পারব না আমার মা সম্পর্কে। মেয়েশিশু হয়ে পৃথিবীতে আসার পর এক অন্যরকম উদাসীনতার মধ্যে বড় হতে হয়েছে আমাকে। আমার প্রতি নেতিবাচকতা, নিষ্ঠুরতা, শঠতা আর প্রতারণা আমাকে খুব বেশি আড়াল করেও রাখতে পারেনি। বরং এসবের আড়ালে আশ্রয়গ্রহণ করে মানুষ হতে চেষ্টা করেছি। চাইলেই জীবনের কিছু বাস্তবতা ও নিয়তির নির্মমতা উপেক্ষা করা যায় না। শিশুকাল থেকেই ডিপ্রেশনে ভুগতাম। বড় হয়ে আকাশে উড়ব এ চেতনায় উজ্জীবিত ছিলাম। উপকূলীয় এলাকায় বিদ্যুৎ ছিল না, চলাচলের জন্য পাকা রাস্তা কিংবা গাড়ি ছিল না। জেলা, বিভাগ, রাজধানীতে যেতে ছোট একটি লঞ্চ ছিল। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী এতটুকু বুঝতাম; কিন্তু যাওয়ার পথ জানতাম না, অর্থাৎ পিছিয়ে পড়া নারী জনগোষ্ঠীর একদম পেছনের সারির শেষ মানুষটি ছিলাম আমি।

এ কথা ভেবে আজ দুঃসময়গুলোর কথা মনে করে হতবাক হই। বিষখালী নদী ছিল আমাদের বাড়ির খুব কাছে, মনে পড়ে একাকী নদীর তীরে বসে কত জোয়ার-ভাটার জল দেখেছি, কত ঢেউ গুনেছি। ওই নদী আমাকে অনেক উদার হতে শিখিয়েছে চারপাশের কার্পণ্য ও কষ্ট ভুলিয়ে দিয়েছে। নদীতীরে ঢেউয়ে ভিজতাম, ভালো লাগত। জমে থাকা বালু দিয়ে হরেক রকম ঘরবাড়ি তৈরি করতাম। বালু দিয়ে তৈরি ঘরগুলো দেখতাম নীরবে। ভালো লাগা ছিল বেশ। নিজের হাতে তৈরি করা ঘরগুলো যখন নদীর ঢেউয়ের পানিতে ভেঙে ফেলত, তখন মন খারাপের দেশে চলে যেতাম। তখনই বুঝেছিলাম জীবনটাও ঠিক এমনই, গড়ে আবার ভাঙে; ভাঙে আর সহজে গড়ে ওঠে না। জীবন সত্যিই রহস্যাবৃত।

হয়তো আজও মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি, তাই বলে যে একদম অমানুষ হয়ে যায়নি, তা-ও খুব বুঝতে পারছি। দশ বছর একাধারে স্থানীয় সরকারের ক্ষমতায় ছিলাম। হাজারো নারীর ঘর বেঁধে দিয়েছি, শত শত মানুষকে মামলামুক্ত করতে সক্ষম হয়েছি। এসবের পেছনে একজন মানুষের খুব সহযোগিতা ছিল, তিনি আমাকে শাসনে-ভাষণে রাখতেন ছোটবেলায়, তিনি হলেন আমার মা।

মেয়েশিশুদের কালেভাদ্রেই পরিবারে অধিকার আসে। আদর-যত্ন বলতে একালের মেয়েশিশু যা পায়, এ রকম নয়। পরিবারে একমাত্র ভাইয়ের খুব কদর দেখে মনে মনে চাইতাম ঘুম থেকে উঠেই যেন ছেলেশিশু হয়ে যাই। প্রতিদিন সকালে নিজেকে খুব অসহায় লাগত। মনে হতো মা ভাইকে বেশি ভালোবাসেন। আমরা অনেক ভাইবোন ছিলাম, তাই সবার প্রতি খেয়াল রাখা একজন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। এ কথাটা সহজে বুঝতে চাইতাম না। সেদিনের মায়ের প্রতি সেই অভিমান থেকে আজ বেশ বুঝতে পারছি মায়ের কতখানি চেষ্টা ছিল আমাদের মানুষ করতে। আর তা বোঝার একমাত্র কারণ হলো আজ আমিও একজন ‘মা’।

ছোটবেলায় আমি একটু ঘুমণ্ডকাতুরে ছিলাম, সেজো বোন আমাকে চিমটি কেটে ঘুম থেকে ওঠাল। আমাকে চিমটে কাটার সময় হয়তো শব্দ করেছিলাম, তাই মায়ের ঘুম ভেঙে যায়; কিন্তু আমরা টের পাইনি। মা ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী। তিনিও চুপিচুপি উঠেছেন, কী করবে গভীর রাতে তার দস্যি মেয়েরা দেখার জন্য। মহাযজ্ঞটি সমাপ্ত করতে উদ্যত হলাম আমাদের তিন বোনের ওপরে অর্পিত দায়িত্বের ব্যবস্থা করতে। আমাদের বোনদের কাণ্ডটি মা দূর থেকে দেখেছিলেন আর রাগে জ্বলছিলেন। মা ইচ্ছা করলেই আমরা যখন রান্নাঘর থেকে খড়ি আর খেজুরগাছের রস নামাচ্ছিলাম, তখনই ব্যবস্থা নিতে পারতেন। কিন্তু তিনি শেষ না দেখে ছাড়বেন না। পাঁচটি খেজুরগাছের রস সংগ্রহ করেছিল দুই বোন, আমি ছিলাম পাহারায়, রস দেখে হেসেছিলাম আনন্দে। আমার হাসার জন্য চড় খেতে হয়েছিল বোনের হাতে।

আনন্দের পরে যা হওয়ার তা-ই হলো। অভিমানী আমি নালিশের জন্য রওনা হতেই আমাকে টেনে নিয়ে ফিসফিস করে মায়ের শাসনের কথা মনে করিয়ে দেয় অন্য বোন। অনেক কষ্ট করে তিন বোন মিলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিসের একটি ভাঙা রুমের মধ্যে খড়ি, খেজুর রস নিয়ে গেলাম। রসের পরিমাণ দেখে সবার চোখ মাথায়, যেন ডাকাতি করে ফিরেছি। রস পাতিলে রাখতেই ধড়াম করে আমাদের পিঠে কে যেন লাঠি দিয়ে খুব জোরে আঘাত করলেন। প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি, পরে মায়ের দরাজ কণ্ঠ ও বকুনিতে আমরা তিন বোন ছাড়া সবাই লাপাত্তা। অবশেষে বুঝলাম এতক্ষণে সুশাসন কর্তা জননী আমার শীতের এ রাতে তার দস্যু কন্যাদের দেখার জন্য কত অধ্যবসায় চালিয়েছেন।

সেই ঘটনা আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা না দিলেও আজ বুঝতে পারি, সেদিনের মায়ের শাসন আমাকে কতটা শিক্ষা দিয়েছিল। অন্তরে মানবিকতার হৃদয়বৃত্তি জাগ্রত করেছিল। পাপ-পুণ্য ও ন্যায়পরায়ণতার শিক্ষা দিয়েছিলেন সেদিন আমার ন্যায়পরায়ণ মা।

লেখক : নারী ও শিশু অধিকারকর্মী

fatimaparvin2013@gmail

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close