মো. সামছুল আলম
মতামত
দেশে মাছ সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই
বর্তমানে বিশ্বের কয়েকটি দেশের যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতির পাশাপাশি দেশীয় কিছু অসাধু, অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ী আর শক্তিশালী সিন্ডিকেটের বেড়াজালে প্রাণিজ আমিষের সেক্টর প্রায় জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাতে করে দেশে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য আমিষ তথা প্রোটিন গ্রহণ রীতিমতো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। কিন্তু এর মধ্যেও আশার বাণী জেগে ওঠে এই কথা ভেবে, আমাদের দেশে বর্তমানে সর্বস্তরের মানুষ সহজলভ্য উপায়ে আমিষ গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছে মৎস্য খাত থেকে। তাই বর্তমানে দৈনিক মাথাপিছু মাছ গ্রহণের পরিমাণ ৬০ গ্রামের বিপরীতে দাঁড়িয়েছে ৬৭ দশমিক ৮০ গ্রাম (জনপ্রতি বার্ষিক ২৩ দশমিক ৭২ কেজি চাহিদার বিপরীতে ২৫.০০ কেজি) (তথ্য সূত্র : মৎস্য অধিদপ্তর)
আগে একটা ধারণা ছিল, জেলেরাই শুধু মাছ চাষ করবেন এবং তারাই মাছ বিক্রি করে জীবনধারণ করবেন, সেই প্রচলিত ধ্যান-ধারণা এখন আর নেই। এখন অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতী ব্যাংক থেকে ঋণ এবং যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর ও মৎস্য অধিদপ্তর থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে গ্রামীণ কিংবা শহরতলির জলাশয় এবং পুকুর, নালা, ডোবায়, ধানের জমি এমনকি শহরের ছাদে (বায়োফ্লক, রাস) হরেক রকম পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরনের মাছ চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। তারা এখন এই ক্ষেত্রে উদ্যোক্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। এর সঙ্গে পরিবারের নারী সদস্যরা সম্পৃক্ত হওয়ায় সমন্বিত প্রক্রিয়ায় মাছ চাষাবাদ করা হচ্ছে। এতে করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টি চাহিদাপূরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমোচন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, আর্থসামাজিক উন্নয়ন এবং নারীর ক্ষমতায়নের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে।
নানা যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে দেশ আজ মাছ উৎপাদনে শুধু স্বয়ংসম্পূর্ণতাই অর্জন করেনি বরং দেশের চাহিদা মিটিয়ে মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য পৃথিবীর ৫২টির অধিক দেশে রপ্তানিও করছে। এ ছাড়া মৎস্য খাত এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও নানা রেকর্ড অর্জন করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার-২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী মিঠাপানির মাছ আহরণে বাংলাদেশ চীনকে টপকে বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে এসেছে। দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২২-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী চীনের মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদন ছিল ১ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন এবং অবস্থান ছিল বিশ্বে দ্বিতীয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১ দশমিক ২৫ মিলিয়ন টন এবং অবস্থান ছিল বিশ্বে তৃতীয়। বিগত দুই বছরে বাংলাদেশের মিঠাপানির মৎস্য উৎপাদন ১ দশমিক ২৫ মিলিয়ন টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১ দশমিক ৩২ মিলিয়ন টনে উন্নীত হয়েছে। পক্ষান্তরে চীনের উৎপাদন ১ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন থেকে কমে ১ দশমিক ১৬ মিলিয়ন টন হয়েছে। ফলে দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকোয়াকালচার ২০২৪-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ চীনকে টপকে দ্বিতীয় অবস্থানে উন্নীত হয়েছে, এটি দেশের জন্য একটি অভাবনীয় সাফল্য। এ ছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থানের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে, ক্রাস্টাশিয়ান্স উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম এবং সামুদ্রিক মাছ আহরণে ১৪তম এবং তেলাপিয়া উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ ও এশিয়ায় তৃতীয় স্থান অধিকার করে বাংলাদেশ। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পর ২০১৬-১৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪০ লাখ ৫০ হাজার টনের বিপরীতে ৪১ লাখ ৩৪ হাজার টন উৎপাদিত হয়। ফলে তখন থেকেই বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়।
মৎস্য খাতে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর সফল বাস্তবায়ন এবং মৎস্য অধিদপ্তর ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট সব দপ্তর/সংস্থার অক্লান্ত প্রচেষ্টার ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরে মৎস্য উৎপাদন হয়েছে ৪৯ দশমিক ১৫ লাখ টন। এর মধ্যে বিশেষ করে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইলিশের উৎপাদন হয়েছে ৫ দশমিক ৭১ লাখ টন, যা একক প্রজাতি হিসেবে মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ। এ ছাড়া বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ প্রথম ও রোল মডেল। ইলিশ জাতীয় জীবনের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছে। জিডিপিতে ইলিশের অবদান শতকরা ১ ভাগের বেশি। কর্মসংস্থানের হিসাবেও দেখা যায়, বর্তমানে প্রায় ৭ লাখ মানুষ প্রত্যক্ষভাবে এবং ২০-২৫ লাখ মানুষ পরোক্ষভাবে ইলিশ সম্পদের সঙ্গে জড়িত। এ ছাড়া ১৭ আগস্ট ২০১৭ পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর, বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে বাংলাদেশি পণ্য হিসেবে বিশ্ব স্বীকৃতি অর্জনের কথা ঘোষণা করে।
জাতীয় মাছ ইলিশের অভূতপূর্ব অর্জনে ও সামুদ্রিক মাছের নিরাপদ প্রজনন ও উৎপাদনবৃদ্ধিতে যেসব কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কার্যক্রম হচ্ছে; বঙ্গোপসাগরে ইলিশসহ অন্যান্য মাছের প্রজনন নিরবচ্ছিন্ন করার জন্য প্রতি বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত ৬৫ দিন বঙ্গোপসাগর ও উপকূলীয় ১৪ জেলায় মাছ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এ সময় জেলেদের মাসিক ৪০ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা (চাল) দেওয়া হয়। এ ছাড়া মা ইলিশ রক্ষার্থে প্রতি বছর অক্টোবর মাসে ২২ দিন সারা দেশে সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এ সময় ২২ দিনের জন্য ২৫ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা (চাল) দেওয়া হয়। তা ছাড়া জাটকা নিধন প্রতিরোধ কার্যক্রম বাস্তবায়নে ইলিশের অভয়াশ্রমগুলোয় চার মাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে। এ সময় মৎস্য আহরণে বিরত মৎস্যজীবী ও জেলেদের মাসিক ৪০ কেজি হারে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়। পাশাপাশি মাছ ধরা বন্ধকালে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১২,২৬,৮১৮টি জেলে পরিবারকে প্রায় ৯৮,৩৬২.৫৫ টন খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসেবে দেওয়া হয়েছে এবং গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ডিসেম্বর/২০২৩ পর্যন্ত ১২,৫৩,৭৭১টি জেলে পরিবারকে ৫২,৬২৪.৭৪ টন খাদ্যশস্য ভিজিএফ হিসেবে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মৎস্যসম্পদ রক্ষায় প্রতি বছর জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাসে চার ধাপে ৩০ দিন ক্ষতিকর কারেন্ট জাল ধ্বংসে কম্বিং অপারেশন পরিচালনা করা হয়। এ ছাড়া জেলে নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান প্রকল্পের আওতায় ১৬ লাখ জেলের নিবন্ধন করা হয় এবং ১৪ লাখ জেলের মাঝে নিবন্ধন কার্ড বিতরণ করা হয়। তা ছাড়া বর্তমানে রাজস্ব খাতের আওতায় জেলেদের নিবন্ধন হালনাগাদ করা হচ্ছে এবং ডিসেম্বর ২০২৩ পর্যন্ত নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১৮,০১,৩৭৭ জন। শিগগিরই দেড় লক্ষাধিক জেলের মাঝে কার্ড বিতরণ করা হবে।
এ ছাড়া বিগত দুই বছরে মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে ইলিশ, দেশি প্রজাতির মাছ (পাঙাশ, বোয়াল, আইড় ও অন্যান্য ছোট মাছ) এবং কার্পজাতীয় মাছ। এ ছাড়া বদ্ধ জলাশয়ে চাষের মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়। চাষের মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশ টানা পাঁচ বছর ধরে বিশ্বে ৫ম স্থান ধরে রেখেছে। মাছ চাষ নিবিড়করণে মাছের খামার যান্ত্রিকীকরণ; প্রজাতি বহুমুখীকরণ; জলবায়ুসহনশীল মাছ চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ; চাহিদার নিরিখে সময়োপযোগী মাছ চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণ; হ্যাচারিতে গুণগত মানসম্পন্ন পোনা/রেণু উৎপাদন; চাষি ও উদ্যোক্তাদের নিয়মিত ট্রেডভিত্তিক প্রশিক্ষণ প্রদানসহ মাছ চাষের উপকরণ বিতরণ; রোগ নিয়ন্ত্রণে ডিজিস সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম জোরদারকরণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে এ অর্জনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। তা ছাড়া দেশে মাছ উৎপাদনের যে ধারা চলমান রয়েছে, তা আগামীতে দেশে মাছ সংকটের কোনো আশঙ্কা নেই।
লেখক : গণযোগাযোগ কর্মকর্তা
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ তথ্য দপ্তর, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়
"