ড. মিফতাহুর রহমান
মতামত
নতুন সরকারের উচিত কিছু সংস্কার সাধন
সম্প্রতি সংঘটিত অশান্তির প্রাথমিক কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল সরকারি চাকরির বিতর্কিত কোটাব্যবস্থা। সরকারের প্রতিক্রিয়া সময়োপযোগী না হওয়ায় এবং বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, গ্রেপ্তার এবং ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটসহ বিক্ষোভের প্রতি সরকারের প্রতিক্রিয়া সমস্যা আরো তীব্র করে তোলে। এই প্রেক্ষাপটে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে!
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করার জন্য বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাসহ গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। নির্বাচনী প্রক্রিয়া এবং আইনের শাসনের প্রতি জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে এ সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়াই কাজ করতে হবে। রাজনীতিতে তরুণ নেতা ও পেশাজীবীদের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা অপরিহার্য। এটি রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং মেন্টরশিপ সুযোগ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে অর্জন করা যেতে পারে, যা শাসন, নৈতিকতা ও জনসেবাকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
নির্বাচনী সংস্কার বাস্তবায়নে অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচনী ব্যবস্থার সংস্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম, প্রচারণার অর্থের কঠোর নজরদারি এবং ভোটার ও প্রার্থীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মতো পদক্ষেপগুলো নির্বাচন পরিস্থিতিকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করতে পারে।
নাগরিক সম্পৃক্ততাকে উৎসাহিত করতে নাগরিকদের তাদের অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষা এবং সচেতনতামূলক কর্মসূচির মাধ্যমে ক্ষমতায়ন করা অধিকতর সক্রিয় ভোটারদের উৎসাহিত করতে পারে। যুবকদের মধ্যে নাগরিক কর্তব্যবোধ গড়ে তোলার জন্য নাগরিক শিক্ষাকে জাতীয় পাঠ্যক্রমে একীভূত করতে হবে।
দুর্নীতি মোকাবিলায় জিরো টলারেন্স নীতি প্রয়োগ করতে হবে। দুর্নীতিবিরোধী আইন শক্তিশালী করা, সরকারি লেনদেনে স্বচ্ছতা বাড়ানো এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জবাবদিহির মাধ্যমে দুর্নীতিকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
রাজনৈতিক সংলাপকে উৎসাহিত করতে রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারের মধ্যে সংলাপের জন্য প্ল্যাটফরম স্থাপন বিভাজন দূর করতে এবং ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা ও সহযোগিতার সংস্কৃতিকে উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। স্বল্পমেয়াদি রাজনৈতিক লাভের চেয়ে জাতির দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে আমরা অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ ও কার্যকর রাজনৈতিক ব্যবস্থা তৈরি করতে পারি।
প্রাথমিক দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট এক রূপান্তরের দিকে যাচ্ছে। বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তরণে সরকার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের বিকল্প নেই। এটি উত্তেজনা কমাতে এবং সহযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে সাহায্য করবে বলে মনে করি। এ ক্ষেত্রে গঠনমূলক আলোচনার সুবিধার্থে নিরপেক্ষ তৃতীয়পক্ষের মধ্যস্থতাকারীদের অন্তর্ভুক্ত করাটা কাম্য, যেমন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা সুশীলসমাজ।
অবিলম্বে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করাটা সমীচীন বলে আমার ব্যক্তিগত অভিমত। অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ হতে পারে উত্তেজনা প্রশমনের মহৌষধ বা একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পদক্ষেপ। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় স্বাধীন নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করার অনুমতি দেওয়া প্রয়োজন। নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়াতে নির্বাচনী সংস্কার প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা, নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা এবং জালিয়াতি রোধে প্রযুক্তি ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
শিক্ষার্থী এবং সুশীলসমাজের উদ্বেগগুলো গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন বলে আমার অভিমত। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করাটা হবে দেশের ভবিষ্যৎ উন্নয়নে অত্যন্ত দূরদর্শী পদক্ষেপ। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রধান গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার বিকল্প নেই। এটি গণতন্ত্র ও আইনের শাসন এবং সরকারের অঙ্গীকারের প্রতি জনগণের আস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা এবং সাংবাদিকদের হয়রানি ও সহিংসতা থেকে রক্ষার পদক্ষেপ জরুরি।
মানবাধিকার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত জরুরি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সুরাহা করা এবং যেকোনো অসদাচরণের জন্য জবাবদিহি নিশ্চিত করা- এটি সরকার ও জনগণের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে সহায়ক হতে পারে। সব নাগরিক, তাদের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা নির্বিশেষে ন্যায্য ও ন্যায়সংগত আচরণ করাটা নিশ্চিত করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত রাখা অত্যন্ত জরুরি।
অর্থনৈতিক সংস্কার এবং সমাজকল্যাণের সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ এখন বাঞ্ছনীয়। বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের মতো সামাজিক অসন্তোষের মূল কারণগুলো মোকাবিলা করে এমন অর্থনৈতিক সংস্কার বাস্তবায়ন করার উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। রাজনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সহায়তা এবং পুনর্বাসন কর্মসূচি প্রদান করা, সামাজিক বিভাজন নিরাময়ে সহায়তা দেওয়ার সঠিক পদক্ষেপ প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য, বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য রাজনৈতিক, পেশাগত ও নৈতিক সংস্কারকে আরো ভালোভাবে মানিয়ে নিতে বাংলাদেশের রূপান্তরের জন্য বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সংস্কার প্রয়োজন। এখানে সংস্কারের মূল ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে রয়েছে- স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ও স্বচ্ছতাকে শক্তিশালী করবে। এতে কমিশনার নিয়োগ করা এবং কমিশনকে পর্যাপ্ত ক্ষমতা ও স্বায়ত্তশাসন প্রদান করার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলোর সংস্কার করা প্রয়োজন, যা দলের অভ্যন্তরে গণতন্ত্রচর্চা, নিয়মিত নেতৃত্ব নির্বাচন এবং স্বচ্ছ প্রার্থী নির্বাচন করতে উৎসাহিত করবে। এটি নেতৃত্বের অবস্থানে নতুন মুখ ও ধারণা আনতে সাহায্য করতে পারে। রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধিত্ব ও সম্পৃক্ততা নিশ্চিত করতে দলীয় নেতৃত্ব ও প্রার্থী তালিকায় তরুণ সদস্যদের জন্য কোটা প্রবর্তন করা অত্যন্ত জরুরি।
শাসন এবং দুর্নীতিবিরোধী ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অত্যন্ত জরুরি। সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য কঠোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক সম্পদ ঘোষণা এবং স্বাধীন তদারকি সংস্থাগুলোর সঙ্গে শক্তিশালী দুর্নীতিবিরোধী আইন। মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করা, যা সরকারি অফিস ও সিভিল সার্ভিসে নিয়োগে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা বা স্বজনপ্রীতির পরিবর্তে যোগ্যতার ভিত্তিতে হতে হবে।
বিচার বিভাগীয় সংস্কার ও বিচারিক স্বাধীনতা, যা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ থেকে রক্ষা করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে শক্তিশালী করবে। বিচারক নিয়োগ প্রক্রিয়ায় সংস্কার এবং বিচারব্যবস্থার জন্য পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করার মাধ্যমে এটি অর্জন করা যেতে পারে। ফাস্ট-ট্র্যাক কোর্ট বিচার ত্বরান্বিত করতে এবং মামলার ব্যাকলগ কমাতে দুর্নীতি এবং রাজনৈতিক অপরাধের জন্য দ্রুত-ট্র্যাক আদালত স্থাপন করাও অত্যন্ত জরুরি। তরুণ নাগরিকদের মধ্যে গণতান্ত্রিক নীতি, অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির স্কুল পাঠ্যক্রমের সঙ্গে নাগরিক শিক্ষাকে একীভূত করা প্রয়োজন।
বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং স্টার্টআপের মাধ্যমে অর্থনৈতিক নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা সম্ভব, যা বেকারত্ব সমস্যার সমাধান করবে এবং তরুণদের জন্য চাকরি ও কাজের সুযোগ তৈরি করবে। সামাজিক নিরাপত্তা জাল বা বেষ্টনী আরো সম্প্রসারণ করা দরকার, যা দুর্বল জনগোষ্ঠীকে রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য কমাতে সহায়তা করবে এবং তা রাজনৈতিক অস্থিরতাও কমাতে পারে। ক্ষমতা ও সম্পদের বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়ন করা প্রয়োজন।
এ সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশে একটি অধিকতর অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে, যা তরুণ নেতৃত্বকে উৎসাহিত করবে।
লেখক : অধ্যাপক ও ডিন, স্কুল অব সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ
"