অনিরুদ্ধ সাজ্জাদ
মুক্তমত
সামাজিক মাধ্যম যখন সমাজবিমুখতার কারণ
আজকের দুনিয়ায় সামাজিক মাধ্যম আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। তরুণ প্রজন্ম থেকে শুরু করে প্রবীণ ব্যক্তিরাও প্রতিদিনের একটি বড় অংশ সামাজিক মাধ্যমের পেছনে ব্যয় করছেন। তবে এই সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে আমরা কি বাস্তব সমাজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছি? এ প্রশ্নটি আজকের দিনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক মাধ্যম আমাদের বিভিন্ন ধরনের সুবিধা প্রদান করে, যেমন সহজে যোগাযোগ করা, তথ্য আদান-প্রদান এবং বিনোদন। তবে, এর অনেক অন্ধকার দিকও রয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করার ফলে মানুষের মধ্যে একাকিত্বের অনুভূতি বেড়ে যাচ্ছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম এবং টুইটারের মতো প্ল্যাটফরমগুলোয় আমরা অন্যের সুখী মুহূর্তগুলো দেখে নিজেদের জীবনকে অসন্তোষজনক মনে করতে শুরু করি।
সামাজিক মাধ্যমে আমরা অনেক মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি, তবে এই যোগাযোগ কতটা গভীর এবং আন্তরিক, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। আমরা প্রায়ই অন্যের সুখী মুহূর্তগুলো দেখে নিজেদের জীবনকে হতাশাজনক মনে করি, যা মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
২০১৮ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৪ থেকে ২৪ বছর বয়সি তরুণদের মধ্যে যারা দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সামাজিক মাধ্যমে সময় ব্যয় করে, তাদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও একাকিত্বের অনুভূতি অনেক বেশি। একই গবেষণায় বলা হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাদের মধ্যে অনেকেই বাস্তব সমাজে মুখোমুখি কথোপকথনে অস্বস্তি অনুভব করে। এর ফলে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যাও দেখা দিতে পারে। সমাজবিজ্ঞানের বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা এবং আন্তরিকতা কমিয়ে দিচ্ছে। বাস্তব জীবনে মিথস্ক্রিয়া কমে যাওয়ায় আমাদের সামাজিক দক্ষতাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
আমেরিকান মনোবিজ্ঞানী জনাথন হেইডট এবং জিন টুয়েঞ্জের গবেষণায় দেখা যায়, সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে তরুণদের মধ্যে বিষণ্ণতা এবং আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশেষ করে, মেয়েদের মধ্যে এই প্রবণতা বেশি দেখা যায়। তাদের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, ২০১০ সালের পর থেকে তরুণদের মধ্যে বিষণ্ণতা ও আত্মহত্যার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা সামাজিক মাধ্যমের ব্যাপক ব্যবহারের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত।
২০২১ সালে একটি গবেষণার পরিসংখ্যান বলছে, প্রতি পাঁচজন তরুণের মধ্যে চারজন সামাজিক মাধ্যমের কারণে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি অনুভব করেছে। এ ছাড়া, যুক্তরাজ্যে রয়্যাল সোসাইটি ফর পাবলিক হেলথের এক জরিপে জানা যায়, তরুণ সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৭০ শতাংশ মানসিক চাপ ও বিষণ্ণতা অনুভব করে। আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সি কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে যারা দিনে তিন ঘণ্টার বেশি সামাজিক মাধ্যমে সময় ব্যয় করে, তাদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগের হার দ্বিগুণ বেশি। সামাজিক মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর এতটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা খুবই উদ্বেগজনক।
সামাজিক মাধ্যমের আসক্তি একটি বাস্তব সমস্যা। এটি শুধু মানসিক স্বাস্থ্যেই নয়, বরং শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। দীর্ঘ সময় ধরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখের সমস্যা, ঘুমের ব্যাঘাত এবং অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও দেখা দিতে পারে। তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে হবে, সামাজিক মাধ্যম একটি কৃত্রিম পরিবেশ এবং এর মাধ্যমে দেখানো সবকিছুই বাস্তব নয়। আমাদের উচিত বাস্তব জীবনের সম্পর্ককে গুরুত্ব দেওয়া এবং মুখোমুখি যোগাযোগ বাড়ানো। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো, সমাজের বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা এবং নতুন দক্ষতা অর্জনে মনোনিবেশ করা জরুরি।
তরুণদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন কর্মশালা ও প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম আয়োজন করা যেতে পারে। এ ছাড়া, স্কুল ও কলেজে মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা বৃদ্ধি করার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম আয়োজন করা উচিত। সামাজিক মাধ্যম আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও, এর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতন হওয়া এবং সঠিকভাবে এর ব্যবহার করা প্রয়োজন। তরুণ প্রজন্মকে বাস্তব সমাজের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য উৎসাহিত করা এবং তাদের মধ্যে সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
সামাজিক মাধ্যমে আসক্তি কাটিয়ে বাস্তব জীবনের সম্পর্কগুলোকে মূল্যায়ন করা শিখলে, আমরা একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে সক্ষম হব। তরুণদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ও তাদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি, তারুণ্যের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করার জন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের এগিয়ে এসে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
লেখক : শিক্ষার্থী, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়
"