এস এম নাজের হোসাইন
দৃষ্টিপাত
অস্থিরতায় খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরো বেড়েছে
সাম্প্রতিক সময়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশব্যাপী সৃষ্ট নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে জাতীয় অর্থনীতির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। প্রায় সবকিছু স্থবির হয়ে পড়ে। বন্ধ হয়ে যায় গণপরিবহন, ইন্টারনেটসহ অনেক সেবা ও পরিষেবা। সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকাও থমকে যায়। বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষ ও দিনমজুররা সবচেয়ে সংকটে পড়ে। নিত্যপণ্যের বাজারে নানা ছুতোয় আগুন লাগানোর প্রবণতা রয়েছে, এ সংকটে নতুনভাবে আবারও আগুন লাগায় অসাধু ব্যবসায়ীরা। অনেক জায়গায় নিত্যপণ্যের বিপুল মজুদ থাকলেও দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায়। যদিও নিত্যপণ্য পরিবহনে বড় ধরনের কোনো সংকট তৈরি হয়নি।
ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রবর্তনের দাবিটি জোরালো হয়েছে, যে বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে জাতির পিতার নেতৃত্বে স্বাধীনতাসংগ্রামে বিপুলসংখ্যক মানুষ শহীদ হয়েছিলেন। দেশে বৈষম্য প্রকট। ব্যাপক দুর্নীতির পাশাপাশি রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষ বৈষম্যের শিকার। এবারের ছাত্র আন্দোলনের কারণও ছিল সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য।
অস্থিরতা চলাকালে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শীর্ষ ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভা হয়েছে। সভায় ব্যবসায়ী নেতারা দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন খাতের সমস্যা তুলে ধরেন। ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় ব্যবসা-বাণিজ্য ও বৈদেশিক যোগাযোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা তুলে ধরলেও ব্যবসার অন্যতম অনুষঙ্গ ভোক্তাদের কোনো সমস্যার কথা কেউ বলেননি অথবা এ সমস্যা উত্তরণে তাদের কী করণীয়, তা নিয়েও আলোচনা করেননি।
দেশের বাজার-বিশ্লেষকসহ অনেক অর্থনীতিবিদ দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছিলেন, নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে স্বাভাবিক জীবনযাপনে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। আমদানিকারক, আড়তদার, পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী সবাই লাগামহীনভাবে বাজারে সব পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। চাল, পেঁয়াজ, রসুন, আলু, মাছ-মাংস, সবজি ও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে। মূল্যস্ফীতি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখছে না। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে না আসার পেছনে বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতাই দায়ী। এদিকে দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা ঘিরে অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বিশেষত ডলার সংকটের এ সময়ে পণ্য আমদানি এখনো পর্যাপ্ত নয়। দেশে রেমিট্যান্সসহ বৈদেশিক মুদ্রার আয় না বাড়লে আমদানি আরো কমতে পারে, যার খেসারত দিতে হবে দেশের নিম্ন ও সীমিত আয়ের সিংহভাগ মানুষকে। জীবন-জীবিকা নির্বাহে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হবে তারা।
সরকার এবার নতুন করে দায়িত্বভার নেওয়ার সময় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় রাখতে নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যায়নি। ফলে নিত্যপণ্যের বাজার সেই আগের মতোই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে যাচ্ছে। আর যারা এগুলো দেখভাল করার দায়িত্বে, তারা নানা রাষ্ট্রীয় কাজে ব্যতিব্যস্ত। ফলে বেশ কয়েক বছর ধরেই সাধারণ মানুষ উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে অসহনীয় জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর দিকে পণ্য পরিবহন কিছুটা ব্যাহত হলেও পরে ডিজিটাল লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দেশীয় পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য স্তিমিত হয়ে যায়। বৈদেশিক বাণিজ্য, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পেও এর ধাক্কা লাগে। অনেক ক্রেতা তাদের আদেশকৃত পণ্য না পাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্যে নেতিবাচক পরিস্থিতির পাশাপাশি বাজার হারানোর শঙ্কায় আছেন রপ্তানিকারকরা। কৃষি উৎপাদন সচল থাকলেও কৃষিপণ্য পরিবহনে বাধার কারণে এ খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।
চলমান অস্থিরতায় দুটি বিষয় সরাসরি বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। উৎপাদনকারী এলাকায় পণ্য পরিবহনে প্রতিবন্ধকতার কারণে পণ্যের ন্যায্য দাম পাওয়া যাচ্ছে না। অন্যদিকে ভোক্তাপর্যায়ে পণ্যের সরবরাহ কম থাকায় অত্যধিক বেশি দামে পণ্য কিনতে বাধ্য হতে হচ্ছে তাদের। যদিও দেশে উৎপাদিত অধিকাংশ কৃষিপণ্যের দাম এমনিতেই সাধারণের ক্রয়সীমার মধ্যে থাকে না। আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের মতো পণ্য আবার আমদানি করা হচ্ছিল ঘাটতির কথা বলে। এর মাঝে প্রায় সময় হঠাৎ করেই ডিম ও পোলট্রি মুরগির দাম বেড়ে যায়। চাল থেকে শুরু করে সব ধরনের শাকসবজির দাম প্রতিনিয়তই ওঠানামা করে। কৃষিতে নানা উদ্ভাবনী প্রযুক্তির কারণে দেশে সবজির উৎপাদন অনেক বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদন এলাকায় কৃষকরা সবজির মূল্য পান না, আবার ঢাকা ও অন্যান্য জেলায় ভোক্তারা বেশি দামে সবজি কিনতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ধরনের অভিযোগ প্রতিনিয়তই করা হলেও এর প্রতিকারে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দৃশ্যত দেখা যায়নি।
দেশের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার প্রধান উপাদান চালের বাজার পরিস্থিতি বছর জুড়েই অস্থির থাকে। সরকারও বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করে চালের মজুদ বাড়ানোর জন্য এর আমদানি একটা সময় উন্মুক্ত রাখে। কিন্তু তার পরও ভরা মৌসুমেও চালের দাম বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যায়। বর্তমানে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়েও আবার নতুন করে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। মোকাম থেকে চাল পরিবহনের সুযোগ থাকলেও অস্থির সময়ে পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার অজুহাতে দাম বাড়িয়ে দেন। একবার চালকল মালিক, আরেকবার করপোরেট ব্যবসায়ীদের দোহাই দিয়েও দাম বাড়ানো হয়। আবার রাজনৈতিক সংকটকালে খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) এবং টিসিবির স্বল্পমূল্যে পণ্য বিক্রি কার্যক্রমও সচল থাকে না। ক্যাব থেকে বারবার সংকটকালীন খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবনঘনিষ্ঠ এসব সেবা চালু রাখার কথা বলা হলেও সে বিষয়ে অগ্রগতি হয়নি। নগরীর দরিদ্র ও প্রান্তিক আয়ের জনগোষ্ঠী এসব সরকারি কার্যক্রম থেকে কিছুটা উপকৃত হতে পারতেন। আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতায় নিম্ন আয়ের মানুষ, শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে বেড়ে যায় তাদের জীবন নির্বাহের ব্যয়। ফলে আন্দোলন ঘিরে সংঘাত-সহিংসতার পাশাপাশি তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে উদ্বেগ, অনিশ্চয়তা আর উৎকণ্ঠা বেড়েছে।
এভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ধারা যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে দেশের প্রান্তিক আয়ের মানুষ, নিম্নমধ্যবিত্ত, এমনকি অনেক মধ্যবিত্তও একসময় দরিদ্রের খাতায় নাম লেখাবেন। সে ক্ষেত্রে সরকার গৃহীত মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে- এমন আশা করা যায় না। তবে গৃহীত লক্ষ্যমাত্রা ও নীতিকৌশল সফল করতে কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন। বিশেষ করে অসাধু ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের খপ্পর থেকে দেশের ব্যবসা খাতকে উদ্ধার করতে হবে। তাদের অতিমুনাফার কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ সরকারের অনেক উদ্যোগ বারবার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির পাশাপাশি সর্বত্র সুশাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যবসায়ীরা বারবার অর্থনীতিতে সুশাসনের অনুপস্থিতির কথা বলছেন। এটি সুস্থধারার রাজনৈতিক পরিবেশের ওপরও অনেকখানি নির্ভরশীল।
সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে সরকারকে আরো মনোনিবেশ করতে হবে। শুধু বাজারে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার তদারকি বাড়ানোই সমাধান নয়। সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে উৎপাদন, মজুদ, আমদানি ও বিতরণের সব পর্যায়ে সমন্বয়টি জোরদার করতে হবে। বাজারে পণ্য সরবরাহে মধ্যস্বত্বভোগীর তৎপরতা ও অতিমুনাফা বন্ধ করতে হবে। সে জন্য বাজার তদারকির সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর লোকবল ও লজিস্টিক সক্ষমতা বাড়াতে হবে। বাজারে প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরিতে প্রতিযোগিতা কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হবে।
দেশে আমদানি থেকে ভোক্তা এবং উৎপাদন স্তর থেকে ভোক্তা স্তরে বাজার ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন দরকার। চাহিদা ও সরবরাহ, সরকারের নিজস্ব মজুদ এবং আমদানির মধ্যে সমন্বয় থাকলে হঠাৎ মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি কিছুটা সামাল দেওয়া যাবে। ডলারসংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার প্রতিবন্ধকতা হ্রাস করে আমদানি সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সর্বোপরি বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অবশ্যই খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে হবে। খাদ্যপণ্য আমদানিতে উন্মুক্ত নীতি গ্রহণ করতে হবে। যখন দেশে পণ্য উৎপাদন হয়, তখন আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা এবং সংকট হলে আমদানি করে হলেও বাজারে পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার নীতি গ্রহণ করতে হবে। এ অনুযায়ী কর নীতিমালাও ঢেলে সাজাতে হবে।
লেখক : ভাইস প্রেসিডেন্ট, ক্যাব
"