আখতার হোসেন আজাদ

  ০৬ জুলাই, ২০২৪

দৃষ্টিপাত

ভোক্তার অধিকার ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট

খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও নিরাপত্তা মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে আমাদের সমাজে স্বীকৃত হলেও ভোক্তা অধিকারও মানুষের মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের সিংহভাগ নাগরিক জীবনের এই গুরুত্বপূর্ণ অধিকারটি সম্পর্কে জ্ঞাত নন। ফলে তারা প্রতিনিয়ত নানাভাবে পণ্য কিনে বা সেবা ভোগ করে প্রতারিত হচ্ছেন।

অর্থনীতির ভাষায়, ব্যক্তিপর্যায়ে ভোগ করার জন্য যিনি পণ্য বা সেবা কেনেন, তাকে ভোক্তা বলা হয়। অর্থাৎ নাগরিকরা ব্যবসায়িক উদ্দেশ্য ছাড়া নিজে ভোগ করার জন্য যদি কোনো পণ্য বা সেবা কেনেন, তবেই তিনি ভোক্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন। আইনের ভাষ্য মতে যিনি সম্পূর্ণ বা আংশিক মূল্য পরিশোধ করে অথবা সম্পূর্ণ বা আংশিক বাকিতে কিংবা কিস্তিতে পণ্য বা সেবা কেনেন, তিনিই ভোক্তা হিসেবে বিবেচিত হবেন।

একজন নাগরিক যখন কোনো পণ্য বা সেবা কেনেন, তা প্রতিশ্রুত ও গুণগত মান বজায় রেখে পণ্য বা সেবা ভোগের অধিকারকেই ভোক্তা অধিকার বলে। সহজ ভাষায় বলতে গেলে ভোক্তা অধিকার হলো অর্থের বিনিময়ে যথাযথ মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যকর, নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত পণ্য ও সেবা লাভের অধিকারই। নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়া, পণ্যের উৎপাদনের উপাদান, উৎপাদন ও মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ, পণ্যের সঠিক মূল্য জানা, গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখে পণ্য পাওয়ার অধিকারই হলো ভোক্তা অধিকারের অন্তর্গত। অর্থাৎ ন্যায্যমূল্যে ন্যায্য পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকারই হলো ভোক্তা অধিকার।

আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জন এফ কেনেডির মতে, একজন ভোক্তার অন্যতম ৪টি অধিকার রয়েছে। যথা : নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং প্রতিকার পাওয়ার অধিকার। একটি জনসভায় প্রদত্ত বক্তৃতায় এই অধিকারগুলো পরবর্তীকালে ভোক্তা অধিকার নামে পরিচিত লাভ করে। ফলে মার্কিন কংগ্রেসে ভোক্তা অধিকারগুলো অনুমোদন লাভ করে আইনি স্বীকৃতি পায়। এভাবে পৃথিবীতে ক্রেতার অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। পরবর্তীকালে জন এফ কেনেডির বক্তৃতায় বর্ণিত ভোক্তা অধিকারগুলো বিস্তৃত করে জাতিসংঘ ৮টি অধিকারকে ভোক্তা অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। এগুলো হচ্ছে মৌলিক চাহিদাপূরণের অধিকার, তথ্য পাওয়ার অধিকার, নিরাপদ পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার, পছন্দের অধিকার, অভিযোগ করা ও প্রতিকার পাওয়ার অধিকার, শিক্ষালাভের অধিকার এবং সুস্থ পরিবেশে থাকার অধিকার। এই অধিকারগুলো ভোক্তার মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।

জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত অধিকারসমূহকে বাংলাদেশ স্বীকৃতি দিয়ে মেনে চলছে এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ২৬(ক) থেকে ৪৭(ক) পর্যন্ত বিভিন্ন অনুচ্ছেদে এ-সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত রয়েছে। এ ছাড়া ভোক্তা অধিকার-সংক্রান্ত প্রচলিত বেশ কয়েকটি আইন জারি আছে। প্রায় প্রচলিত চল্লিশটিরও অধিকার এ-সংক্রান্ত বিধান বর্ণিত রয়েছে। যেমন : তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯; নিরাপদ খাদ্য আইন, ২০১৩; পণ্য বিক্রয় আইন, ১৯৩০; ওজন ও পরিমাপ আইন, ১৯৮২; অত্যাবশ্যক পণ্যসামগ্রী আইন, ১৯৫৬ প্রভৃতি আইন।

দুঃখজনক হলেও সত্য, স্বাধীনতা লাভের দীর্ঘদিন পর নাগরিক তথা ভোক্তাদের অধিকার সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে পূর্ণরূপে ভোক্তা অধিকার আইন তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা লাভের পর বাংলাদেশে ভোক্তা অধিকার সুরক্ষা ও উন্নয়নের জন্য ২০০৯ সালের ৬ এপ্রিল ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন জারি করা হয়। এ আইনে বলা হয়েছে, ভোক্তা অধিকারবিরোধী কার্যক্রম রোধ ও এই সম্পর্কিত অভিযোগ নিষ্পত্তির জন্য এ আইনে প্রণীত হয়েছে। এ আইনের ৮২টি ধারা ও অনেক ধারার উপধারা রয়েছে। ভোক্তা অধিকার আইনটি বিস্তৃত পরিসরের আইন। এ আইনে খাদ্য, পণ্য, ওষুধসহ বিভিন্ন ধরনের সেবাকে ভোক্তার অধিকারের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের নাগরিক তথা ভোক্তারা বিভিন্নভাবে পণ্য বা সেবা ক্রয় করে প্রতারিত হচ্ছেন। প্রতারিত হলেও সচেতনতার অভাবের দরুন তারা পান না কোনো প্রতিকার। বর্তমান আধুনিক যুগে বাজারে এখনো সনাতনী পদ্ধতির পাল্লার বাটখারা ব্যবহৃত হচ্ছে। বিক্রেতাদের থেকে অহরহ ওজনে কম দেওয়ার ফলে ভোক্তারা নিয়মিত প্রতারিত হচ্ছেন। আবার বাজারে দেখা মেলে বিভিন্ন মুখরোচক পণ্যের। বিএসটিআই কিংবা যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছাড়া হরহামেশাই সেসব পণ্য উন্মুক্তভাবে বিক্রয় হচ্ছে। এসব পণ্যের মোড়কে উৎপাদনের উপাদান, উৎপাদন কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ কিংবা সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা থাকে না। ফলে ভোক্তারা যেমন বিভিন্ন ক্ষতিকর বা মানবস্বাস্থ্যের জন্য হুমকিস্বরূপ উপাদান দ্বারা তৈরি করা পণ্য কিনেছেন। ঠিক তেমনই নির্ধারিত মূল্য উল্লেখ না থাকার দরুন তারা অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে পণ্য কিনে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। আবার বিভিন্ন পণ্যের মোড়কে উৎপাদন বা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ লেখা থাকলেও অসাধু ব্যবসায়ীরা মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বিক্রি করে থাকেন। সচেতনতার অভাবের জন্য ক্রেতারা সেসব পণ্য না দেখেই কেনেন।

ভোক্তাদের প্রতারণায় নতুনরূপে যুক্ত হয়েছে অনলাইনে পণ্য বিক্রি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে খুব সহজেই চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করে থাকেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। পরে মূল্য নিয়ে কাঙ্ক্ষিত পণ্য না দিয়ে ক্রেতাদের সঙ্গে প্রতারণা করার ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। কখনো বা পণ্য না দিয়ে অর্থ আত্মসাতের ঘটনাও ঘটে থাকে।

এছাড়া বিক্রয়যোগ্য পণ্যের মূল্য তালিকা প্রকাশ না করা, সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও প্রদর্শন না করা, ধার্যকৃত মূল্যের অধিক মূল্যে পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রয়, ভেজাল পণ্য বা ওষুধ বিক্রয়, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ দ্রব্যের মিশ্রণ, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতাসাধারণকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা, পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন, মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্য বা ওষুধ বিক্রি, সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্যের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একটি স্লোগান হলো ‘লঙ্ঘিত হলে ভোক্তা অধিকার, অভিযোগ করলে মিলবে প্রতিকার’। আমাদের দেশের অন্যতম সমস্যা হলো, দেশের নাগরিকরা প্রতারিত হলে কোথায়, কখন ও কীভাবে অভিযোগ করতে হবে, তা সম্পর্কে কোনো জ্ঞান রাখেন না। অভিযোগ করলে অহেতুক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার ভয় কিংবা হুমকি বা অন্য কোনো ক্ষতির ভয়েও অনেকেই অভিযোগ করতে চান না। তবে সচেতন নাগরিক হিসেবে ভোক্তা অধিকার লঙ্ঘিত হলে অবশ্যই ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ জানানো কর্তব্য। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সার্বক্ষণিক খোলা হটলাইন নম্বর ১৬১২১ অথবা ইমেইলের মাধ্যমে অভিযোগ করতে পারেন। ইমেইলে অভিযোগ করার ঠিকানাটি হলো- [email protected]। এছাড়া অনলাইনে www.dncrp.com ঠিকানায় ভিজিট করে অভিযোগ করা যেতে পারে। অভিযোগ করার সময় অবশ্যই পণ্য ক্রয়ের রসিদ, অভিযোগকারীর নাম, যোগাযোগের বিস্তারিত ঠিকানা, যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বর, অভিযুক্ত ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠানের নাম ও যোগাযোগের ঠিকানা, ঘটনার বিবরণ উল্লেখ করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ মোতাবেক ভোক্তাকে অবশ্যই ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যেই অভিযোগ করতে হবে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারী ভোক্তাকে ক্ষতিপূরণ বাবদ দেওয়ার বিধান রয়েছে।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯ সালে প্রণিত হলেও আইনটি এখনো সার্বিকভাবে ছড়ানো সম্ভব হয়নি। একটি প্রবাদ আছে, ‘সুস্থ দেহ, সুন্দর মন, উন্নত জীবন’। তাই উন্নত জীবনসমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সুস্থ ও স্মার্ট নাগরিক। ব্যক্তিপর্যায়ে নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হন, তবেই তারা নিজেরা স্মার্ট নাগরিকে পরিণত হবেন। আর স্মার্ট নাগরিকদের সমন্বয়েই বিনির্মাণ হবে সচেতন ভোক্তাবান্ধব বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার স্মার্ট বাংলাদেশ।

লেখক : সাবেক শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close