নুরুল্লাহ আলম নুর

  ২৪ জুন, ২০২৪

মুক্তমত

বিসিএস আসক্তি এবং শিক্ষক সমাজের করণীয়

বর্তমানে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসকে (বিসিএস) সাফল্যের একমাত্র শিখর হিসেবে ধরা হচ্ছে। যার ফলে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সম্ভাবনা এবং আকাঙ্ক্ষা বহুকেন্দ্রিক না হয়ে এককেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বছর ধরেই দেখা যাচ্ছে, বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যা তার আগের বছরকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাই এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আগামী দিনগুলোয়ও বিসিএস পরীক্ষার্থীর সংখ্যায় নতুন রেকর্ড হবে। বিসিএস নিয়ে এখন যা চলছে, সেটা বেশ কিছুদিন থেকেই আর আগ্রহের পর্যায়ে নেই, এটি এখন পরিণত হয়েছে এক ভয়ংকর প্রবণতায়। দেশের জনসংখ্যার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ বিসিএস নামক ট্রেন্ডের পেছনে ছুটছে, যা সমাজের অন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো উপেক্ষিত রাখছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একটি একক কর্মজীবনের পথের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে শিক্ষার্থীদের লক্ষ্য সীমাবদ্ধ করতে হবে? দেশের বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোয় গেলে দেখা যায়, স্নাতক শ্রেণিতে পড়ুয়া অসংখ্য ছাত্রছাত্রী তাদের পড়াশোনার মূল বিষয় বাদ দিয়ে বিসিএসের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। ভার্সিটির শিক্ষার্থীদের পড়ার টেবিলে তাদের মূল পড়াশোনার বইয়ের চেয়ে বিসিএস প্রস্তুতির বই-ই বেশি দেখা যায়। এর জন্য অবশ্য শিক্ষক সমাজের বড় একটা অংশকে দায়ী করলেও ভুল হবে না।

শিক্ষার্থীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা গঠনে এবং তাদের শিক্ষাগত যাত্রা পরিচালনায় শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু বর্তমানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে এসে শিক্ষার্থীদের এককভাবে শুধু বিসিএসের প্রতিই উদ্বুদ্ধ করে যান, যেটা পুরোপুরিভাবেই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের জন্য বেমানান। শ্রেণিকক্ষ বুদ্ধি বৃদ্ধি, কৌতূহল জাগানো এবং বিভিন্ন প্রতিভা লালন-পালনের জন্য একটি অভয়ারণ্য হিসেবে কাজ করে থাকে। এটি এমন একটি প্ল্যাটফরম যেখানে শিক্ষকরা যেকোনো একক পেশার সীমানা অতিক্রম করে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ নেতা, চিন্তাবিদ এবং পরিবর্তন-প্রস্তুতকারক হিসেবে তৈরি করতে পারেন। শিক্ষকদের ভূমিকা একটি নির্দিষ্ট কর্মজীবনের গতিপথের পক্ষে সমর্থন করার বাইরেও প্রসারিত। আর শিক্ষকদের দেখানো পথের মাধ্যমেই শিক্ষার্থীরা তাদের আবেগ অন্বেষণ করতে, তাদের ব্যক্তিত্বকে আঁকড়ে ধরতে এবং প্রশাসনিক পরিষেবার বাইরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সাহায্য করতে পারে।

বিসিএস পরীক্ষার এই এককেন্দ্রিকতা আমাদের সমাজে একটি বৃহত্তর সমস্যা তৈরি করছে, যেখানে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসা, শিল্প, সাহিত্য এবং অন্যান্য বিভিন্ন সৃজনশীল ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিভা বিকশিত করতে পারছে না। এর ফলে, আমরা একটি বহুমুখী এবং সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে পিছিয়ে যাচ্ছি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভিন্নধর্মী এবং উদ্ভাবনী চিন্তার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, যা একটি দেশের উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অতএব, বিসিএস পরীক্ষা নিয়ে এই ভয়ংকর প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সমাজের সবস্তরে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভিন্ন পেশার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা এবং তাদের মেধা ও সৃজনশীলতার বিকাশে সহায়তা করা উচিত। শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে বৈচিত্র্য এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা বিসিএস ছাড়াও অন্য সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোয় নিজেদের প্রতিভা এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে পারে।

শিক্ষার্থীদের উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে একটি একক লক্ষ্যে সংযুক্ত করার পরিবর্তে, শিক্ষকদের উচিত শিক্ষার্থীদের তাদের স্বপ্ন অনুসরণ করতে অনুপ্রাণিত করা, হোক সেটা অ্যাকাডেমিক, হোক সেটা উদ্যোক্তা অথবা শিল্পকলা অথবা বিজ্ঞান বা সমাজসেবার ক্ষেত্রে কিংবা অন্যান্য যেকোনো ক্ষেত্রেই হোক না কেন। একটি বৃহত্তর দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি উৎসাহিত করা শিক্ষার্থীদের তাদের সত্যিকারের আহ্বান খুঁজে পেতে, সমাজে পরিপূর্ণতা আনতে সাহায্য করে পাশাপাশি অবদানের বোধকে উৎসাহিত করে, যা প্রশাসনিক ভূমিকার সীমার বাইরে পর্যন্ত যাওয়ার ক্ষমতা রাখে। অধিকন্তু, শিক্ষার জন্য একটি সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি লালন করার মাধ্যমে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের হস্তান্তরযোগ্য দক্ষতা, সমালোচনামূলক চিন্তাভাবনা, যোগাযোগ, সমস্যা-সমাধানসহ অন্যান্য দক্ষতারও বৃদ্ধি ঘটাতে পারেন, যা যেকোনো পেশার ক্ষেত্রে অপরিহার্য। এই দক্ষতাগুলো শুধু ব্যক্তিগত বিকাশকেই সমৃদ্ধ করে না বরং দ্রুত বিকশিত এই বিশ্বের উন্নতির জন্য তাদের প্রস্তুত করে।

একটি শ্রেণিকক্ষ অনুপ্রেরণার আলোকবর্তিকা হওয়া উচিত, যা শিক্ষার্থীদের তাদের পূর্ণ সম্ভাবনা এবং বৈচিত্র্যময় আকাঙ্ক্ষা অন্বেষণ করতে সাহায্য করতে পারে। শিক্ষকরা এমন একটি পরিবেশ গড়ে তোলার দায়িত্ব পালন করেন, যেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের আবেগ অনুধাবন করতে পারে, ক্যারিয়ারের একাধিক পথ অন্বেষণ করতে পারে। পাশাপাশি শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন এবং কর্মক্ষেত্রে বৈচিত্র্য আনয়ন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের উচিত শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যময় নীতি গ্রহণ করা, যাতে শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য পেশাগত ক্ষেত্রে সমানভাবে এগিয়ে যেতে পারে।

সমাজের প্রতিটি স্তরে বিসিএস পরীক্ষার বাইরে অন্য ক্ষেত্রগুলোর গুরুত্ব তুলে ধরা প্রয়োজন, যাতে শিক্ষার্থীরা জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে ভাবতে পারে এবং একটি সুসংগঠিত এবং সৃজনশীল সমাজ গঠনে অবদান রাখতে পারে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে স্বপ্নের বিচিত্রতা এবং প্রতিভার বৈচিত্র্য তুলে ধরতে হলে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবং সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন। এভাবেই আমরা একটি বহুমুখী, সৃজনশীল এবং সমৃদ্ধ সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যা শুধুমাত্র বিসিএস পরীক্ষাকেন্দ্রিক নয়, বরং একটি সুষম এবং প্রগতিশীল বাংলাদেশ গঠনে সহায়ক হবে। শিক্ষার লক্ষ্য হওয়া উচিত একটি একক কর্মজীবনের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে অগণিত সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যাওয়া, যা সমাজের কাঠামোকে সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করতে পারে।

লেখক : শিক্ষার্থী, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

[email protected]

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close