রাজিন হাসান রাজ
মুক্তমত
সেশনজট শিক্ষার্থীদের গলার কাঁটা
বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সেশনজটের সমস্যা একটি দীর্ঘস্থায়ী ও জটিল ইস্যু হিসেবে পরিচিত, যা শিক্ষার্থীদের জীবনে এক অভিশাপের মতো কাজ করছে। এই সমস্যাটি শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে এবং তাদের ক্যারিয়ার গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেশনজটের ফলে চার বছরের স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি শেষ করতে অনেক সময় ছয় থেকে আট বছর পর্যন্ত সময় লাগছে, যা শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত হতাশাজনক। সেশনজটের প্রধান যে কারণগুলো রয়েছে, সেগুলো অনুধাবন করলে আমরা দেখতে পারি যে বাংলাদেশের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগে পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাব রয়েছে। অন্যদিকে রয়েছে প্রশাসনিক উদাসীনতা, সময়মতো খাতা দেখা এবং ফলাফল প্রকাশে গড়িমশি করা, অবকাঠামোগত সমস্যা ও পর্যাপ্ত ক্লাসরুম এবং ল্যাবের অভাব, পরীক্ষার সময়সূচি ও ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব করা। মূলত উল্লিখিত কারণগুলোই সেশনজটের অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশে সেশনজটের সমস্যা বেশির ভাগ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকট। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এ সমস্যার সঙ্গে বেশি মোকাবিলা করছে। এ ছাড়া ঢাবি অধিভুক্ত সাত কলেজেও রয়েছে তীব্র সেশনজট। বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে ব্যবসায় শিক্ষা, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি গবেষণার বিষয়গুলোয় সেশনজট বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া আইন, ইসলাম শিক্ষা, কৃষিবিজ্ঞান, স্বাস্থ্যবিজ্ঞান, প্রাণিচিকিৎসা বিজ্ঞান এবং নারী শিক্ষাবিষয়ক বিভাগগুলোতেও সেশনজটের প্রবণতা রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে সিএসই, আল-ফিকহ, বাংলা, ইংরেজি, গণিতসহ আটটি বিভাগে রয়েছে ব্যাপক সেশনজট। বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো, শিক্ষকসংখ্যা, প্রশাসনিক দক্ষতা এবং শিক্ষার্থীদের সংখ্যা অনুযায়ী সেশনজটের মাত্রা ভিন্ন। তবে কোভিড-১৯-এর কারণে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানেই একটি জটিল জট পড়েছে, যা বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের সঙ্গে একীভূত হয়ে আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীরা যে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তা বর্ণনা করে শেষ করা সম্ভব নয়। তবে সেশনজটের কারণে শিক্ষার্থীদের ডিগ্রি সম্পন্ন হতে অনেক বেশি সময় লাগে, যা তাদের শিক্ষাগত অগ্রগতিতে বাধা দেয়। চাকরি বা উচ্চশিক্ষার জন্য আবেদনের সময় বিলম্ব হয়, যা ক্যারিয়ার গঠনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শিক্ষার্থীরা অনিশ্চয়তা ও মানসিক চাপে ভুগে থাকে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। সেশনজটের ফলে শিক্ষার্থীদের অতিরিক্ত সময় ধরে শিক্ষা খরচ বহন করতে হয়, যা তাদের এবং তাদের পরিবারের ওপর অর্থনৈতিক বোঝা বাড়ায়। এ ছাড়া পাঠদান ও পরীক্ষার মান হ্রাস পায়, যা শিক্ষার মানের অবনতি ঘটায়। ২০২২ সালে সেশনজটের কারণে হতাশাগ্রস্ত হয়ে গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পল্লবী মণ্ডল গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ২০২৩ সালে ৯৮ জন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন, যাদের অধিকাংশের অন্যতম একটি কারণ হলো এই সেশনজট। কোভিড-১৯-পরবর্তী সময়ে যা তীব্র আকার ধারণ করেছে এবং শিক্ষার্থীদের ডিপ্রেশনের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, শিক্ষার্থীদের ৮০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে বিষণ্ণতা আর মানসিক চাপে রয়েছে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী। এই গবেষণায় দেশের ৬২ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয়, চতুর্থ এবং মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। চার বছরের স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রি শেষ করতে ছয় থেকে আট বছর লাগলে শিক্ষার্থীদের জন্য এটি খুবই ক্ষতিকারক।
সেশনজট কমানোর জন্য কোর্সভিত্তিক ক্লাসের সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়া, শুক্র ও শনিবারের মতো ছুটির দিনগুলোয় ক্লাস চালু রাখা, পরীক্ষা কমিটিকে আরো সক্রিয় করা, শিক্ষকসংকট মোকাবিলায় আরো শিক্ষক নিয়োগ করা উচিত। এ ছাড়া প্রশাসনের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যক্রমে পরিবর্তন আনা জরুরি। শিক্ষক নিয়োগ, ক্লাসসংখ্যা বৃদ্ধি, সময়জ্ঞান মেনে চলা এবং অবকাঠামো উন্নয়নের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তবে, এই প্রস্তাবনাগুলো বাস্তবায়নে অনেক বাধা রয়েছে, যেমন বাজেটের অভাব, রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির অভাব এবং প্রশাসনিক জটিলতা।
পরিশেষে সেশনজট একটি জটিল সমস্যা এবং এর সমাধানের জন্য সবার আন্তরিকতা এবং সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ এবং দেশের উন্নতির জন্য এ সমস্যার দ্রুত সমাধান অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ এবং সুন্দর ভবিষ্যতের এর কথা চিন্তা করে এ সমস্যার দ্রুত সমাধান করা উচিত।
লেখক : শিক্ষার্থী, নর্দার্ন ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যান্ড টেকনোলজি খুলনা
"