হাসানুল বান্না অলি
ধর্মকথা
হজ মুসলিম ঐক্যের আন্তর্জাতিক পাঠশালা
ইসলাম নামক প্রাসাদের খুঁটি হলো পাঁচটি। এর মধ্যে পঞ্চম ও গুরুত্বপূর্ণ খুঁটি হলো হজ। এটি শুধু আনুষ্ঠানিক ইবাদাত নয়, বরং এটি আল্লাহতায়ালার প্রিয় বান্দা হওয়া ও মুসলিম ঐক্যের মিলনকেন্দ্র। ইসলামে এর গুরুত্ব অপরিসীম। হজ মানবজাতির আত্মিক ও সামাজিক পরিশুদ্ধতা আনয়ন করে। পুরো পৃথিবী থেকে সম্মানিত হাজিরা আল্লাহতায়ালার মেহমান হয়ে প্রতি বছর কাবাঘর তওয়াফ ও ইসলামের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো সফর করে থাকেন একমাত্র মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য।
হজ মূলত আরবি শব্দ। এর বাংলা অর্থ হলো ইচ্ছে পোষণ করা, কোনো কাজের দৃঢ় সংকল্প করা। ইসলামি শরিয়তের পরিভাষায় আল্লাহর ঘরের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ও আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশে কতগুলো বিশেষ ও নির্দিষ্ট কাজ সহকারে মহান ঘরের জিয়ারতের নিয়ত বা ইচ্ছে করাকেই হজ বলে। হজ ফরজ ইবাদত। তবে এটি সবার ওপর আমভাবে ফরজ নয়। শারীরিক ও আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান মুসলমানের ওপর এটি পালন করা ফরজ। ইসলামের ইবাদতগুলোর মধ্যে কিছু আছে আর্থিক আবার কিছু আছে শারীরিক। তবে হজ হলো আর্থিক ও শারীরিক সক্ষমতার সমন্বয়ে এক মহৎ ইবাদত। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর মানুষের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তাদের ওপর আল্লাহর জন্য সেই ঘরে হজ করা অবশ্য কর্তব্য।’ (সুরা আলে ইমরার-৯৭)
হজরত আলি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, যে ব্যক্তি সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও হজ পালন করেনি, সে ইহুদি হয়ে মারা যাক বা খ্রিস্টান হয়ে মারা যাক তাতে কোনো পার্থক্য হবে না। (মুসনাদে আহমাদ)
মূলত হজের মাস তিনটি। শাওয়াল, জিলকদ ও জিলহজ। এর মধ্যে প্রধান মাস হলো জিলহজ মাস। এই মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ এই ছয় দিনেই হজের মূল কার্যক্রম সম্পাদন করা হয়। কোরআনুল কারিমে মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, হজের মাসগুলো সুনির্দিষ্ট জানা (সুরা আল বাকারাহ-১৯৭)
হজ মুসলিম মিল্লাতের জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ.)-এর স্ত্রী হজরত হাজেরা ও পুত্র ইসমাইল (আ.)-এর স্মৃতিস্মারক। হজ পালনের মাধ্যমে প্রতিটি মুসলমানের স্মৃতিপটে তাদের ত্যাগের আত্মকাহিনি ভেসে ওঠে। শিশুপুত্র হজরত ইসমাইল (আ.)-এর পানির জন্য বিবি হাজেরার সাফা ও মারওয়া পর্বতে দৌড়াদৌড়ি করা ইসলামের ইতিহাসে হজের একটি অনন্য ঘটনা।
মহান আল্লাহতায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনগুলোর অন্তর্ভুক্ত। (সুরা বাকারাহ : ১৫৮) এরই ধারাবাহিকতায় সব হাজির ওপর সাফা-মারওয়া পাহাড়ে সাতবার সায়ি করা আল্লাহতায়ালা ওয়াজিব করে দিয়েছেন।
হজ মানে শুধু কাবাঘর সফর করা নয় বরং হজের মানে হলো বর্ণ, গোত্র ও জাতিগত বৈষম্য ভুলে গিয়ে মুসলিম ঐক্যের মহামিলনের এক আন্তর্জাতিক কর্মসূচি। হজের সময় রাজা-প্রজা, উঁচু-নিচু, মনিব-ভৃত্য, ধনী-গরিব, সাদা-কালো, লম্বা-খাটো, আরব-অনারব- সবাই মিলে একই পোশাক পরিধান করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব ধরনের ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে সাম্যের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে মহান প্রভুর বিধান পালন করে। হজ ছাড়া আর অন্য কোনো অনুষ্ঠানে সাম্যের এই নজির দেখা যায় না। সবাই মিলে একই সঙ্গে আরাফার ময়দানে খোলা আকাশের নিচে লাব্বাইক লাব্বাইক বলে মহান আল্লাহর কাছে হাজিরা দেওয়ার যে দৃশ্য পৃথিবীর অন্য কোথাও এত বড় সমতার অনুষ্ঠান পাওয়া যাবে না। সবার উদ্দেশ্য একটাই, মহান রবের সন্তুষ্টি। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পরিপূর্ণভাবে হজ পারলন করল এবং তাতে কোনো অশ্লীল বা পাপকাজ করল না, সে ঠিক ওইদিন কার মতো হয়ে বাড়ি ফিরবে, যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল। অর্থাৎ সে একদম নিষ্পাপ হয়ে বাড়ি ফিরবে। (বোখারি-১৫১১)
হজের সময় পুরো পৃথিবী থেকে মুসলিমরা হজ করতে মক্কা নগরীতে আসেন। এ সময় একে অন্যের সঙ্গে পরিচয়, ভাববিনিময় ও ভালোবাসার সম্পর্ক ও সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি হয়।
হজের একমাত্র ও প্রধান লক্ষ্য হলো মহান রবের সন্তুষ্টি অর্জন করা। হজের সময় সব মুসলমান নিজেদের মহান রবের কাছে আত্মসমর্পণ করে থাকেন। ইহরাম, তালবিয়া, তাওয়াফ, কোরবানিসহ হজের নানা আনুষ্ঠানিকতা পালনের মাধ্যমে মানব মন প্রভুর প্রেমে নিমগ্ন হয়ে যায়। তখন দুনিয়ার সব চিন্তা-চেতনা ভুলে বান্দা তার প্রভুর নিবিড় সান্নিধ্য কামনায় রত থাকে। আল্লাহতায়ালা বলেন, আর লোকদের হজের জন্য সাধারণভাবে হুকুম করে দাও, তারা প্রত্যকে দূরদূরান্ত থেকে হেঁটে হেঁটে ও উটে চড়ে তোমার কাছে আসবে। (সুরা হজ-২৭)
হজ শুধু জাতীয় ভ্রাতৃত্বই তৈরি করে না বরং আন্তর্জাতিকভাবে মুসলমানদের সম্প্রীতি বৃদ্ধি ও সম্পর্ক দৃঢ় করে। বিশ্বের সব দেশের মুসলমানদের সঙ্গে মিশে তাদের আচার-আচরণ, রীতিনীতি সম্পর্কে জানা যায়। বাহ্যিকভাবে হজ পালনে মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় হলে হজের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক অনেক উপকারিতা রয়েছে। কবুল হজের পুরস্কার হলো দুনিয়ায় একদম গুনাহহীন নিষ্পাপ মানুষ হবে আর আখিরাতে জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসেবে থাকবে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কবুল হজের পুরস্কার জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নয়। (মুসলিমণ্ড১৩৪৯) পবিত্র মক্কা হলো হজরত ইব্রাহিম (আ.) ও ইসমাইল (আ.)-এর লালন ভূমি। মুসলমানদের মহামিলন কেন্দ্র। মুসলমানদের মধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার মহাসুযোগ আর কোনো সম্মেলনে নেই।
লেখক : শিক্ষার্থী, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
"