নিজস্ব প্রতিবেদক

  ১৩ অক্টোবর, ২০২৪

মধ্যস্বত্বের ভোগে রুপালি ইলিশ

সাধারণত বড় শহরের আড়তদাররা স্থানীয় ছোট মাছ ব্যবসায়ীদের ‘দাদন’ ঋণ দিয়ে থাকেন। তারা স্থানীয় পর্যায়ের আড়তদার। স্থানীয় আড়তদাররা ঋণ দেন মাছ ধরার নৌকা মালিকদের। এসব আড়তদার স্থানীয় মাছ-ঘাট বা ঢাকায় মাছ বিক্রির টাকার ওপর কমিশন নেন। কখনো আবার মাছ-ঘাটের কাছাকাছি প্রতিষ্ঠিত আড়তদাররা নিজেরাই ‘দাদন’ দিয়ে থাকেন। সে ক্ষেত্রে ঢাকায় কাউকে কমিশন দেওয়ার প্রয়োজন হয় না।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) ২০২০ সালের জুনে ‘বাংলাদেশে ইলিশ গবেষণা ও উন্নয়ন’ শীর্ষক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, আড়তদারদের নিলামে তোলা সব মাছের ওপর দুই থেকে ছয় শতাংশ কমিশন আদায় করা হয়।

বিক্রয়মূল্য থেকে কমিশন ও প্রাথমিক ঋণ কেটে নেওয়ার পর আড়তদাররা কেজিপ্রতি ইলিশ থেকে ১০ টাকা আদায় করেন। তবে এটি সমানভাবে দেওয়া হয় না। নৌকা মালিকরা বাকি টাকার অর্ধেক পান। বাকি অর্ধেক জেলে ও নৌকার মাঝিদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়। এই অর্ধেকের মধ্যে প্রধান মাঝি দুটি ভাগ ও প্রত্যেক জেলে একটি করে অংশ পান বলে জানিয়েছেন পটুয়াখালীর জেলে ইসলাম হাওলাদার।

তবে প্রচুর মাছ না পেলে সবাইকে আড়তদারের কাছে ঋণী হয়ে থাকার আশঙ্কা থাকে। একে ‘দুষ্টচক্র হিসেবে আখ্যা দিয়ে পটুয়াখালীর প্রধান মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র মহীপুর ফিশিং ট্রলার্স মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার গাজী বলেন, ‘ইলিশ ধরার জন্য আমাদের যথেষ্ট টাকা নেই। তাই আড়তদারদের থেকে টাকা নিতে হয়।

বিএফআরআইর প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ইলিশ ধরা জেলেরা সবচেয়ে গরিব। তাদের অধিকাংশই ভূমিহীন। বার্ষিক আয় মাত্র ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা। এতে আরও বলা হয়—তাদের সঞ্চয় নেই। জীবনযাত্রার মান খুব নিচু। মাছ ধরার সরঞ্জাম তারা কিনতে বা ভাড়া করতে পারেন না। নদী-সাগরে মাছ ধরার নৌকা চালানোর খরচও বহন করতে পারেন না।

মৎস্যজীবী ও ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন-ইলিশ হাত বদল হয় চার থেকে ছয়বার। জেলেরা প্রথমে মাছ-ঘাটের আড়তদারদের হাতে মাছ তুলে দেয়। সেখানকার আড়তদাররা পরে পাইকারদের কাছে মাছ পাঠান। পাইকাররা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে তা বিক্রি করেন। শেষে যায় ক্রেতাদের হাতে। ব্যবসায়ীরা জানান, বাজারে বিদ্যমান দর ও মাছের পরিমাণ বিবেচনায় নিয়ে পাইকাররা দাম নির্ধারণ করেন।

ইসলাম হাওলাদার ও দেলোয়ার গাজী জানান, মহীপুরে তাদের মাছ নিলামে তোলা হলে স্থানীয় ও আন্তঃজেলার পাইকারদের পাশাপাশি আড়তদারদের প্রতিনিধিরাও অংশ নেন।

তাদের একজন বলেন, ‘অনেক সময় আড়তদাররা ইলিশ কিনে মজুদ করে রাখেন। বিশেষ করে যখন প্রচুর ইলিশ ধরা পড়ে। পাইকারদের সংখ্যা যখন কম থাকে তখন এমনটি হয়। কক্সবাজারে আড়তদার ও পাইকারদের পূর্বনির্ধারিত দামে ইলিশ বিক্রি হয়।

কক্সবাজার ফিশিং বোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘বড় মাছ-ঘাটের বাজারদরের খবর নিয়ে পাইকাররা এখানে দাম ধরেন।

তার অভিযোগ, ‘পাইকাররা দাদন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে কম দাম ধরায় নৌকা মালিক ও জেলেরা ন্যায্যমূল্য পান না। আমাদের কাছ থেকে এক কেজি ওজনের ইলিশ ৯০০ টাকায় কিনে ঢাকায় বিক্রি করা হয় এক হাজার ৪০০ টাকায়।

দেলোয়ার গাজীরও একই অভিযোগ। ‘ঢাকায় এক কেজির বেশি ওজনের ইলিশ যেখানে বিক্রি হয় দুই হাজার টাকায়, আমাদের এখানে বিক্রি হয় দেড় হাজারে।

এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন নয়। গত মাসে যাত্রাবাড়ীতে অভিযান চালিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দেখতে পায়, পাইকারি দামের চেয়ে ৫১ শতাংশ বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। অধিদপ্তর আরও জানায়, রশিদ বা ভাউচার ছাড়াই মাছ বিক্রি হচ্ছে।

দেলোয়ার গাজী আরও বলেন, ‘জেলেরা যদি আড়তদারদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে মাছ বিক্রি করতে পারেন তবে তারা আরও বেশি মুনাফা করতে পারবেন।

‘কিন্তু দাদনের কারণে পারছি না। মাছ তাদের কাছে বিক্রি করতেই হয়। ব্যাংক ঋণ পেলে আড়তদারদের শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হতে পারতাম। ব্যাংক-এনজিও আমাদের ঋণ দেয় না।

নৌকার মালিকরা আনুষ্ঠানিক ঋণের সুযোগ পেলেও মুনাফা ভাগাভাগিতে পরিবর্তন না এলে ইসলাম হাওলাদার ও তার মতো জেলেদের কষ্ট দূর হওয়ার সম্ভাবনা কম।

বিএফআরআই বলছে, ইলিশ ধরা লাভজনক। মুনাফার ভাগ পক্ষপাতদুষ্ট, অসম ও শোষণমূলক। এর প্রতিবেদনে বলা হয়, মুনাফা বণ্টনের ফলে প্রকৃত মৎস্যজীবীদের আয় কমে গেছে।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) মৎস্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক মো. আব্দুল ওহাব বলেন, ‘ক্রেতারা চড়া দামে ইলিশ কিনলেও প্রকৃত জেলেরা সামান্যই উপকৃত হন। তার মতে, নৌকা মালিক ও দাদন ব্যবসায়ীরাই প্রকৃত সুবিধাভোগী।

‘ইলিশ আহরণে সরকারি বিধিনিষেধ মেনে প্রতিবছর ১৪৩ দিন কর্মহীন থাকলেও প্রকৃত জেলেদের অবস্থার উন্নতি হয়নি।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ সাইদুর রহমান বলেন, ‘জেলেরা ঋণের দুষ্টচক্রে পড়েছেন। তাদের সন্তানরা পড়ালেখা করতে পারে না। সরকার সামাজিক সুরক্ষা বাড়ালেই তাদের জীবনমান উন্নত হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close