বেনাপোল (যশোর) প্রতিনিধি

  ০৭ আগস্ট, ২০২২

‘অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম’ চালু

পণ্য আমদানিতে গতি বেড়েছে বেনাপোলে

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ‘অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম’ চালু হওয়ায় বেনাপোলে পণ্য আমদানিতে অভাবনীয় গতি এসেছে। আগে আমদানি পণ্য দেশে প্রবেশ করতে পেট্রাপোলে ৩০ থেকে ৪০ দিন অপেক্ষা করতে হতো। গুনতে হতো বাড়তি ডিটেনশন চার্জ ও গোডাউন ভাড়া। আমদানিকারকদের মতে, এই খাতে বছরে বাড়তি ব্যয় হতো প্রায় হাজার কোটি টাকা। এখন তিন দিনেই পেট্রাপোল থেকে বেনাপোল বন্দরে প্রবেশ করছে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক। ফলে দ্রুততম সময়ে পণ্য আমদানির পাশাপাশি সাশ্রয় হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা। ভারতের রাজ্য সরকারের নয়া সিদ্ধান্তে এশিয়ার বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোলে স্বস্তি মিলেছে অপরদিকে দুই যুগ পর ভারতের কালীতলা পার্কিংয়ের সিন্ডিকেট কবল থেকে মুক্তি মিলেছে আমদানিকারকদের।

ওপারের পেট্রাপোল সূত্রগুলো জানায়, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের স্থলবন্দরগুলো দিয়ে ট্রাকে পণ্য রপ্তানি সংক্রান্ত কাজে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে সম্প্রতি পরিবহন দপ্তর অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম বা ‘সুবিধা ভেহিকেলস ফেসিলিয়েশন সিস্টেম’ চালু করেছে।

পুরোনো ব্যবস্থায় বাইরের রাজ্য থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক পেট্রাপোল বন্দরে যাওয়ার আগে বনগাঁ শহরের তিনটি জায়গায় (কালীতলা, কালীবাড়ি মোড় এবং বিএসএফ ক্যাম্প মোড়) পরিবহন দপ্তরের কাছে এন্ট্রি করাত। তারপর সীমান্তে যাওয়ার জন্য ছাড়পত্রের জন্য অপেক্ষা করত। এই ছাড়পত্র মিলতে এক মাস বা তারও বেশি সময় লাগত। তত দিন ট্রাকের মালামাল স্থানীয় গোডাউন বা স্থানীয় ট্রাকে তুলে বেসরকারি পার্কিং লটে রাখা হতো। বাইরে থেকে আসা বেশির ভাগ ট্রাক বনগাঁয় পণ্য নামিয়ে ফিরে যেত। এ কারণে বাড়তি সুবিধা নিতে বনগাঁয় বহু সংখ্যক গোডাউন এবং পার্কিং লট গড়ে ওঠে।

বনগাঁর পার্কিং ও গোডাউন ঘিরে এই সিন্ডিকেটকে কালীতলা সিন্ডিকেটও বলা হয়। এই চক্রে ৩০ থেকে ৪০ দিন আটকে থেকে পণ্যবোঝাই প্রতি ট্রাককে গড়ে ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা বাড়তি গুনতে হতো। বছরে যা প্রায় হাজার কোটি টাকা।

ওপারের পরিবহন দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, নতুন ব্যবস্থাপনায় ভারতের যেকোনো প্রান্ত থেকে ব্যবসায়ীরা স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে ট্রাকে পণ্য পরিবহনের জন্য আগে ভাগেই অনলাইনে ‘স্লট বুকিং’ করতে পারবেন। এই কাজে চেসিসের জন্য লাগবে ৫ হাজার টাকা এবং পণ্যবোঝাই ট্রাকের জন্য ১০ হাজার টাকা। নতুন এই ব্যবস্থাপনায় ভেঙে গেছে কালীতলা পার্কিং সিন্ডিকেট।

আমদানি বাণিজ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার বনগাঁ কালীতলা পার্কিং সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে অনলাইনে স্লট বুকিং চালু করায় ভারতের যেকোনো প্রদেশ থেকে ট্রাক কলকাতায় এসে পৌঁছানোর পর ১-২ দিনের মধ্যে বেনাপোলে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে খুশি ব্যবসায়ীরা।

তারা বলছেন, উভয় দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে ভারতীয় পরিবহন দপ্তর, বন্দর কাস্টমস এবং বেনাপোল কাস্টমস ও পোর্ট এলপিআই নিয়মিত তদারকি করলে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশে বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেটের ডিটেনশন চিরতরে হারিয়ে যাবে। আগের ব্যবস্থায় দিন প্রতি পণ্যবাহী গাড়ির এন্ট্রি হতো ৮৪৬টি করে। বর্তমানে তা কমে ২৯৯টি হয়েছে। আগে লাইনে পণ্যবাহী গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকত ৯ হাজারের মতো। নয়া ব্যবস্থার পর তা কমে ১ হাজার ৫৮৭টিতে এসে দাঁড়িয়েছে।

ইন্দো-বাংলা চেম্বার অব কমার্স সাব কমিটির পরিচালক মতিয়ার রহমান মতিয়ার রহমান জানান, বাংলাদেশের প্রতিটি আমদানিকারক ঋণপত্র খোলার সময় পণ্যের মূল্যের সঙ্গে বনগাঁ, কালীতলা পার্কিংয়ের ৩০-৩৫ দিনের ট্রাক ডিটেনশন চার্জ ও মালবাহী ট্রাক চার্জ উল্লেখ করে তার ওপর আমদানিকারককে শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। গত এক দশক ধরে প্রতি বছর প্রায় হাজার কোটি টাকা শুধু কালীতলা পার্কিং ও ডিটেনশন চার্জ বাবদ দেওয়া হয়েছে।

শুধু তাই নয়, দিল্লি, মুম্বাই অথবা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে একটি ট্রাক পেট্রাপোলে আসার পর পণ্য লোকাল গোডাউনে আনলোড করে রাখত। পরে সেই একই পণ্য দুইটি ট্রাকে লোড করে বেনাপোলে পাঠানো হতো যা ঋণপত্রের শর্তবহির্ভূত। এলসিতে পার্ট শিপমেন্ট অনুমোদন থাকলেও ট্রান্সশিপমেন্টের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা থাকে। বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেট ট্রাকের ভুয়া নম্বর দিয়ে এন্ট্রি করে রাখা হতো। পরে সেই সিরিয়াল নম্বর ৫০ হাজার টাকায়ও বিক্রি করা হতো বলে জানান তিনি।

ভারতের যেকোনো প্রদেশ থেকে বেনাপোলে পণ্য আসলে সাধারণত ডিটেনশন ছাড়া দেড় লাখ টাকা ভাড়া হয় জানিয়ে মতিয়ার রহমান বলেন, পশ্চিম বাংলা সরকারের পরিবহন দপ্তর অনলাইনে স্লট বুকিং চালু করায় ভারতের যেকোনো প্রদেশ থেকে ট্রাক কলকাতায় এসে পৌঁছানোর পর ১ থেকে ২ দিনের মধ্যে বেনাপোলে পৌঁছে যাচ্ছে। ফলে খুশি ব্যবসায়ীরা। এ বিষয়ে উভয় দিকে সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে ভারতীয় পরিবহন দফতর, বন্দর কাস্টমস এবং বেনাপোল কাস্টমসও পোর্ট এলপিআই নিয়মিত তদারকি করলে ভারতীয় পণ্যবাহী ট্রাক প্রবেশে বনগাঁ পার্কিং সিন্ডিকেটের ডিটেনশন থেকে চিরতরে মুক্তি পাবে এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ী ও সাধারণ ক্রেতারা উপকৃত হবে বলে আশা করেন তিনি।

বেনাপোল বন্দরের আমদানি-রপ্তানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, একটা সময় কোনো পণ্যবাহী ট্রাক এন্ট্রি নেওয়ার পর ৩০ থেকে ৪০ দিন আটকে থাকতে হতো। তারপরও দালালদের টাকা দিয়ে পণ্য দেশে ঢুকত। এই পুরোনো ব্যবস্থা পাল্টাতে মাস্টারস্ট্রোক দেয় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। পৌরসভার হাত থেকে পার্কিং নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নিয়ে তা তুলে দেওয়া হয় পরিবহন দপ্তরের হাতে। নয়া সিদ্ধান্তের পর দেখা গেছে, জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আটকে থাকা গাড়ির সংখ্যা ও দিন অনেক হ্রাস পেয়েছে। এখন ৩০-৪০ দিন নয়, তা কমে তিন দিনে নেমে এসেছে। কোনো কোনো গাড়ি এন্ট্রি হওয়ার দিনই ঢুকছে বাংলাদেশে। ফলে অভাবনীয় গতি এসেছে পণ্য আমদানিতে, স্বস্তি ফিরেছে বাণিজ্যে।

সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ী ইদ্রিস আলী জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন পদক্ষেপে পণ্য পরিবহনব্যবস্থা সহজ হওয়ায় স্বস্তি ফিরেছে আমদানিকারকদের মাঝে। দ্রুত পরিবহন করা যাচ্ছে পণ্য। এতে বাণিজ্য সহজ হয়েছে।

ভারতীয় ট্রাকচালক জগদিশ দাস জানান, আগে দেড় মাস পর্যন্ত কালীতলা পার্কিংয়ে থাকতে হতো। এখন ৩ থেকে ৪ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে ঢোকা যাচ্ছে। দ্রুত পণ্য পৌঁছাচ্ছে বন্দরে। বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এমন উদ্যোগে দুই দেশের ব্যবসায়ীরাই খুশি। তবে ট্রাক প্রতি সেবা চার্জ ১০ হাজার রুপি রুপি ট্রাক চ্যাচিজ চার্জ ৫ হাজার রুপি নির্ধারণ করা হয়েছে। এই চার্জ কিছুটা কমালে আরো উপকৃত হবেন ব্যবসায়ীরা।

পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তী বলেন, ভুয়া এন্ট্রি বন্ধ হওয়ায় এখন দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে গাড়ি বাংলাদেশ পৌঁছে যাচ্ছে। আগামী দিনে এই বন্দরে কাজের পরিমাণও বাড়বে। রপ্তানি বাণিজ্য করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ব্যবসায়ীদের উৎসাহ বাড়বে বলে মনে করছেন শুল্ক দপ্তরের আধিকারিকরা।

বেনাপোল বন্দরের উপপরিচালক আবদুল জলিল বলেন, ওপারে ‘অনলাইন স্লট বুকিং সিস্টেম’ চালু হওয়ায় পণ্য আমদানিতে দীর্ঘসূত্রতা কেটেছে। দুই দেশের সরকারের চেষ্টায় ভারতের রাজ্য সরকারের এই নতুন নির্দেশে পেট্রাপোলের আমদানি বাণিজ্যে গতি এসেছে, গতি এসেছে বেনাপোলেও। আমরা আশাবাদী আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য আরো গতিশীল হবে, ব্যবসায়ীরা পেট্রাপোল-বেনাপোল বন্দর ব্যবহারে আরো আগ্রহী হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close