ট্টগ্রাম ব্যুরো
নদীতীরে স্থাপিত সব শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডই অনুমোদনহীন
দেশের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড জোন হিসেবে পরিচিত সন্দ্বীপ-কুমিরা চ্যানেলের তীরবর্তী সীতাকুণ্ড উপকূলীয় এলাকা। এক সময় দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববাজার থেকে পুরোনো জাহাজ এনে এসব ইয়ার্ডে কেটে ইস্পাত পণ্য বিক্রি করত। শিল্প মন্ত্রণালয়সহ পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়ে এসব ইয়ার্ড কার্যক্রম পরিচালনা করত। দুই বছর আগে চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা থেকে ফেনীর সোনাগাজী পর্যন্ত নদীবন্দর ঘোষণা করে সরকার। সে আইন অনুযায়ী ফোরশোর বা নদীতীরে যেকোনো ধরনের স্থাপনা নির্মাণ কিংবা কার্যক্রমের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) অনুমোদন নিতে হবে। অর্থাৎ এসব ইয়ার্ডকেও নতুন করে অনুমোদন নিতে হবে। কিন্তু দুই বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো প্রতিষ্ঠানই বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নেয়নি। আবার অনুমোদনের জন্য কোনো তাগাদাও দেয়নি সংস্থাটি। সে হিসেবে নদীতীরে স্থাপিত দেশের শতভাগ শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডই বর্তমানে অনুমোদনহীন অবস্থায় কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
দেশে নতুন শিপইয়ার্ডের অনুমোদনের জন্য শিল্প মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, সংশ্লিষ্ট এলাকার উপজেলা চেয়ারম্যান, বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। শিপইয়ার্ড স্থাপনে অনুমোদনের এসব বিষয় নির্ধারণ করে দেওয়া হয় শিল্প মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এত দিন সেখানে বিভিন্ন দপ্তরের বিষয়টি উল্লেখ করা থাকলেও বিআইডব্লিউটিএর ছাড়পত্রের বিষয়টি উল্লেখ ছিল না। ২০২০ সালের আগে চট্টগ্রামের এ অঞ্চলে কোনো নদীবন্দর না থাকায় শিপইয়ার্ডগুলো বিআইডব্লিউটিএ থেকে কোনো ছাড়পত্র নেয়নি। তবে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারির পরও নিয়ম অনুযায়ী গত দুই বছরে কোনো ইয়ার্ড এ ছাড়পত্র নেয়নি। এজন্য অবশ্য বিআইডব্লিউটিএকেই দুষছেন ইয়ার্ড মালিকরা। তাদের দাবি, সংস্থাটির পক্ষ থেকে তাদের কিছুই জানানো হয়নি।
পরিবেশ অধিদপ্তর, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের তথ্য মতে, ২০২০ সাল পর্যন্ত সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য মতে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও কুমিরা এলাকার ৯টি মৌজায় ১৮৬টি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের অনুমোদন ছিল। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারী, ব্যাংকঋণসহ নানা জটিলতায় বেশকিছু ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে প্রায় ৬০টি প্রতিষ্ঠান বৃহৎ কিংবা সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালু রেখেছে। কিন্তু এদের কারোরই নেই বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন। সে হিসাবে নতুন নিয়মে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই অবৈধ হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বিআইডব্লিউটিএ। এতে একদিকে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে নদীর তীরভূমির যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটাচ্ছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো। ১৯৫৮ সালের অর্ডিন্যান্সের ক্ষমতাবলে জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, অনুমোদনসাপেক্ষে নদীবন্দর এলাকা ব্যবহার করলে বিআইডব্লিউটিএকে নির্ধারিত শুল্ক দিতে হবে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি এ শুল্ক পরিশোধে অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে নদীবন্দরের সংরক্ষক হিসাবে বিআইডব্লিউটিএ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে পারবে। তবে প্রজ্ঞাপন জারির পর দুই বছর পেরোলেও আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরের কথা, জরিপের মাধ্যমে নদীবন্দরের তীরভূমিই নির্ধারণ করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ।
সরেজমিন দেখা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই থেকে সীতাকুণ্ডের শেষ সীমানা পর্যন্ত সরকার ঘোষিত ৯টি মৌজায় শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোর অবস্থান। মূলত এগুলো নদীর পাড় ঘেঁষেই গড়ে উঠেছে। আর এসব স্থান এখন চট্টগ্রাম নদীবন্দর এলাকার অন্তর্ভুক্ত। অর্থাৎ নদীবন্দর এলাকা থেকেই জাহাজ ভাঙা শিল্পের স্ক্র্যাপ দেশের বিভিন্ন ইস্পাত কারখানায় সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু আইন অনুযায়ী অনুমোদনহীনভাবে এসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ১৯৬০ সালে খুলনায় নদীবন্দরের অনুমোদন দেওয়া হলে বিআইডব্লিউটিএকে এর সংরক্ষক নিযুক্ত করা হয়। এরপর থেকে খুলনার নদীবন্দর এলাকায় যাবতীয় স্থাপনা এবং প্রতিষ্ঠান থেকে রাজস্ব আদায় করে আসছে প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে চট্টগ্রাম নদীবন্দরের সংরক্ষণের দায়িত্বও বিআইডব্লিউটিএকেই দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দায়িত্ব পাওয়ার দুই বছর পরও তা পালনে আগ্রহ দেখায়নি তারা।
বিআইডব্লিউটিএর একটি সূত্র বলছে, নৌবন্দর ঘোষণার পর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের সমুদ্রতীরবর্তী এলাকায় বিদ্যমান শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলো ফোরশোর (তীরভূমি) সংক্রান্ত অনুমোদনের আওতায় নিয়ে আসতে একটি কমিটি গঠন করে দেওয়া হয়। কিন্তু সে কমিটি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেনি। ফলে নির্ধারিত এলাকায় কতটি শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড আছে, কোনোটি কোথায় অবস্থিত এ ধরনের সাধারণ তথ্যই সংগ্রহ করতে পারেনি বিআইডব্লিউটিএ। চলতি বছরের শুরুতে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনে সমুদ্র তীরভূমি ব্যবহার, জেটি নির্মাণ ও স্লিপওয়ে স্থাপনের লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরে অনুমোদনের জন্য যায় ডিপ ডিগার্স লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএর লাইসেন্স ছাড়া পরিবেশগত অনুমোদন দেয়নি অধিদপ্তর। এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে বিআইডব্লিউটিএর কাছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড স্থাপনে ফোরশোর ব্যবহার-সংক্রান্ত বিষয়ে অনুমতি চেয়ে আবেদন করে ডিপ ডিগার্স লিমিটেড। ওই আবেদনের সঙ্গে প্রস্তাবিত শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের ফোরশোর ম্যাপ, মৌজা ম্যাপ, স্ক্যাচ ম্যাপ, হাইড্রোগ্রাফিক চার্ট, ট্রেড লাইসেন্স, জমির দলিল, জাতীয় পরিচয়পত্র, টিআইএন সার্টিফিকেট যুক্ত করা হয়। তবে সে আবেদনের বিষয়ে এখনো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর গোলাম সাদেক বলেন, ২০২০ সালের মার্চে প্রজ্ঞাপন জারি হলেও নদীতীরবর্তী ফোরশোরের সীমানা নির্ধারণ জরিপ কাজ এখনো সম্পন্ন হয়নি। ফলে ঠিক কোনো এলাকার কতটুকু ভূমি বিআইডব্লিউটিএর অধীনে তা এখনো নির্ধারণ করা যায়নি। সে কারণেই এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। জেলা প্রশাসন ও বিআইডব্লিউটিএ যৌথভাবে জরিপ কাজ শেষ করে সীমানা বুঝে পেলে প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী সব প্রতিষ্ঠানকে আইনের আওতায় আনার কাজ শুরু করা হবে। এরপর কাট্টলী থেকে সোনাগাজী পর্যন্ত নদী ও সমুদ্রতীরবর্তী অংশে স্থাপিত ও স্থাপন করতে চাওয়া শিপ ব্রেকিংসহ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রথমেই বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন লাগবে।
জাহাজভাঙা ইয়ার্ডগুলোর মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআরএ) সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পের ইয়ার্ডগুলো যখন বাংলাদেশে অনুমোদন পাওয়া শুরু করে, তখন থেকেই কোন কোন দপ্তরের ছাড়পত্র নিতে হবে, সে বিষয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু নতুন করে বিআইডব্লিউটিএর অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি আমাদের জানানো হয়নি। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ বা শিল্প মন্ত্রণালয় কিছুই জানায়নি। সে কারণেই ইয়ার্ডের অনুমোদন নেওয়ার বিষয়টি মালিকরা জানেন না।
"