শাহজাহান সাজু
আগামী ৯ আগস্ট জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস
বিদ্যুতের ১০ শতাংশ আসবে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে
ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে সরকার। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশে গ্যাসের স্বল্পতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বিবেচনা করা হচ্ছে। সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে (২০২১-২২ থেকে ২০২৩-২৪) এসব তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘সরকারের দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে দেশে বিগত ১২ বছরে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। ২০০৯ সনের তুলনায় বর্তমানে পাঁচ গুণ বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।’
জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, ‘দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং টেকসই ও নিরাপদ জ্বালানির ব্যবহার ও সরবরাহ বৃদ্ধিকল্পে সরকার সচেষ্ট। আমাদের জ্বালানির মোট চাহিদার একটি বৃহৎ অংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের মাধ্যমে পূরণ হয়ে থাকে। দেশে আবিষ্কৃত ২৭টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে বর্তমানে ২০টি উৎপাদনে রয়েছে। ২০০৯ সালে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের উৎপাদন ছিল ১ হাজার ৭৪৪ মিলিয়ন ঘনফুট, যা বর্তমানে বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় ২ হাজার ৫২৫ মিলিয়ন ঘনফুটে দাঁড়িয়েছে। আমাদের প্রাকৃতিক গ্যাসের মোট চাহিদার অবশিষ্ট পরিমাণ এলএনজি বা লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস হিসেবে আমদানি করে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হচ্ছে।’
এ বিষয়ে জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আনিছুর রহমানের সঙ্গে গতকাল বিকালে মোবাইলে যোগাযোগ করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
সরকারের মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিষয়ে বলা হয়, বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে ‘পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি)-২০১৬’ শীর্ষক মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আওতায়, ২০২১ সালের মধ্যে ২৪ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সরকার কাজ করছে। গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ প্লান্টের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করে সরকার কয়লা ডিজেল-ফার্নেস তেল, পারমাণবিক শক্তি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। সাশ্রয়ী জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উদ্ভাবনের জন্য এ খাতে অনুসন্ধান ও গবেষণা অব্যাহত রাখা হবে।
এতে বলা হয়, বর্তমানে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা (ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্যসহ) ২২ হাজার ২৩ মেগাওয়াট এবং আরো ১৪ হাজার ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা সম্পন্ন ৩৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। দেশে বর্তমানে ৭২২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য উৎস হতে উৎপাদিত হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ, মেরামত ও দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। সরকার ভবিষ্যৎ জ্বালানি নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ২০২৫ সালের মধ্যে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি হতে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় বেসরকারি খাতকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। দেশে গ্যাসের স্বল্পতার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার বিবেচনা করা হচ্ছে।
দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে জ্বালানির চাহিদা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে উল্লেখ করে অর্থনৈতিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়, প্রাকৃতিক গ্যাস বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি সম্পদ, যা দেশের মোট বাণিজ্যিক জ্বালানির অধিকাংশ পূরণ করে। সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে দেশজ গ্যাস অনুসন্ধানে অফশোর ও অনশোরে সাইসমিক জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশে বর্তমানে আবিষ্কৃত গ্যাস ক্ষেত্রের সংখ্যা ২৭টি, যার মধ্যে ২০টি বর্তমানে উৎপাদনে রয়েছে। টেকসই জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ শতাংশ ও ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। গ্যাসের অপচয় রোধ এবং জ্বালানি দক্ষতা (energy efficienc) বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে, ঢাকা মহানগরীতে দুই লাখ এবং চট্টগ্রাম এলাকায় ৬০ হাজার প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপন করা হয়েছে। ২০২০-২৩ মেয়াদে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ১ লাখ ২০ হাজার এবং জালালাবাদ গ্যাস অধিভুক্ত এলাকায় ৫০ হাজার এবং চট্টগ্রাম এলাকায় তিন লাখ প্রি-পেইড গ্যাস মিটার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে।
এতে বলা হয়, মহেশখালীতে দৈনিক প্রায় এক হাজার মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতা সম্পন্ন দুটি ভাসমান সংরক্ষণাগার ও পুনঃগ্যাসায়ন ইউনিট (FSRU) স্থাপন করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বর্তমানে দৈনিক প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি জাতীয় গ্যাস গ্রিডে যুক্ত হচ্ছে। জ্বালানি আমদানির মাধ্যমে বর্ধিষ্ণু চাহিদা মেটানোর জন্য এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ, গভীর সমুদ্র থেকে তেল সরাসরি পাইপের মাধ্যমে গ্রহণ, চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনে তেল সরবরাহের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়াও মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর আওতায় সরকার পটুয়াখালীর পায়রাতে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
মধ্যমেয়াদি আর্থিক নীতি বিবৃতিতে বলা হয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিদ্যুৎ খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। সরকার বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রদান করছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতের সমন্বিত উন্নয়নের মাধ্যমে ২০২১ সালের মধ্যে সবার জন্য যৌক্তিক মূল্যে মানসম্পন্ন ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কাজ করছে। সুষম বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সরকার এরই মধ্যে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনের বর্তমান অবস্থার উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
এদিকে আগামী ৯ আগস্ট সরকারিভাবে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস পালন করা হবে। প্রতি বছরের মতো দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপনের লক্ষ্যে এ বছরও বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। জ্বালানি সেক্টরের সাম্প্রতিক অর্জন, অগ্রগতি ও অন্যান্য বিষয়ে জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হবে। যেখানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ বিভাগের সচিবের বাণী প্রকাশ করা হবে।
জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুজাতিক কোম্পানি শেল ওয়েলের কাছ থেকে তিতাস, রশিদপুর, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ এবং কৈলাসটিলা গ্যাস ক্ষেত্র কিনে নেন। ওই সময়ে ৪ দশমিক ৫ মিলিয়ন পাউন্ডে গ্যাসক্ষেত্রগুলো কিনে রাষ্ট্রীয় মালিকানা প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর জ্বালানির সাশ্রয়ী ব্যবহারের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ২০১০ সালের ১২ আগস্ট এক পরিপত্রে ৯ আগস্টকে জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকে প্রতি বছর এই দিন সরকার জাতীয় জ্বালানি নিরাপত্তা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
"