নিজস্ব প্রতিবেদক

  ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০

ব্যাংকিং খাত তদারকি ও খেলাপি কমাতে টিআইবির ১০ সুপারিশ

বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং খাতে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে দাবি করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিংব্যবস্থা পরিচালনায় এ খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন গঠন করাসহ ১০ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

গতকাল ‘খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা এবং সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি করা হয়। টিআইবির পরিচালক (গবেষণা ও পলিসি) মোহাম্মদ রফিকুল হাসান প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

টিআইবি বলছে, বিভিন্ন সময়ে খেলাপি ঋণ হ্রাস এবং ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও, তা কার্যকর না করে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক বারবার ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ ও পুনর্গঠনের সুযোগ দেয়। সর্বশেষ ২০১৯ সালের মে মাসে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি নির্দেশনায় খেলাপি ঋণের মাত্র দুই শতাংশ ফেরত দিয়ে পুনঃতফসিলি করার মাধ্যমে ১০ বছরের মধ্যে ঋণ পরিশোধের সুযোগ দেওয়া হয়। এভাবে পুনঃতফসিলের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় না করেই গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে প্রায় ২৪ হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ কমিয়ে গত মার্চ পর্যন্ত ৯২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ হিসেবে দেখানো হয়, যা জুন ২০২০-এ ফের বেড়ে দাঁড়ায় ৯৬ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী জুন ২০১৯ পর্যন্ত প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি নীতি ও কৌশলগুলোতে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাত সংস্কার ও নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের অধিকতর সুশাসনের কথা বলা হলেও এগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি, সরকারের সদিচ্ছার ঘাটতি এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও হস্তক্ষেপের কারণে ব্যাংকিং খাতে আইনের লঙ্ঘন ও অনিয়ম-দুর্নীতির মাত্রা ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মাধ্যমে কয়েকটি ব্যবসায়ী গ্রুপের মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র বা গোষ্ঠীতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি উভয় ধরনের ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ হিসেবে নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের দখলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে সংবাদ সম্মেলনে ব্যাংকিং খাত খাদের কিনারায় উল্লেখ করে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাষ্ট্রমালিকানাধীন বা ব্যক্তিমালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো যে জনগণের অর্থ ও আমানত নিয়েই ব্যবসা করে থাকে এই বাস্তবতার স্বীকৃতি বাংলাদেশে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের স্বেচ্ছাচারী প্রবণতায় মনে হয়, ব্যাংকে গচ্ছিত জনগণের অর্থ যেন কিছু মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদ; যা তাদের খুশিমতো ব্যবহার করা যাবে। আবার ব্যাংক মালিক, নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও সরকার এই তিন পক্ষও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ যে জনগণের সম্পদ সেটি ভুলে গিয়ে লুটপাটকারী তথা ঋণখেলাপিদেরই ক্রমাগতভাবে সুযোগ করে দিচ্ছে। অনেক সময় তারা ঋণখেলাপি, জালিয়াতিকারী, অর্থ আত্মসাৎকারী ও অর্থ পাচারকারীদের সহায়ক শক্তি হিসেবেও ভূমিকা পালন করছে। এমনকি সরকারকেও তাদের কাছে জিম্মি মনে হয়। নির্বাহী পরিচালক বলেন, যেই বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব জনগণের আমানত তদারকি এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করা তারাও নেতৃত্বের অদক্ষতা, রাজনৈতিক প্রভাব এবং ঋণখেলাপিদের চাপের কাছে নতিস্বীকার করে খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অকার্যকর একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে।

ব্যাংকিং খাতের প্রকট সংকটময় এই পরিস্থিতির মূলে বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দায়ী করে তিনি আরো বলেন, এ দেশের রাজনীতি ব্যবসার সঙ্গে একাকার হয়েই ক্ষ্যান্ত হয়নি বরং তা ব্যবসায়ীদের হাতেই জিম্মি হয়ে পড়েছে। যার কুপ্রভাব ব্যাংকিং খাতেও পড়েছে। এর ফলে সরকারি ঘোষণায় খেলাপি ঋণ নিয়ন্ত্রণ ও বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের সুশাসন ইত্যাদি বিষয়ে জোরালো অঙ্গীকার থাকলেও তার কোনো প্রয়োগ বা কার্যকর বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না; যা ব্যাংকিং খাতকে খাদের কিনারায় এনে দাঁড় করিয়েছে। এতে পুরো অর্থনীতিই এক অভূতপূর্ব নাজুক অবস্থায় পড়েছে। যদি এখনই এই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে ধস অপরিহার্য বললে অত্যুক্তি হবে না এবং আমানতের অর্থ জনগণের হওয়ায় এর সম্পূর্ণ বোঝাও নিঃসন্দেহে জনগণের ওপরই পড়বে। তাই এ সংকট থেকে উত্তরণে অবিলম্বে সম্পূর্ণ স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং সরকার কিংবা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমুক্ত একটি কমিশন গঠন করে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনাসহ কৌশল প্রণয়ন ও অবিলম্বে বাস্তবায়ন অপরিহার্য।

গবেষণায়প্রাপ্ত পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করে সুস্থ ও নিরাপদ ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় ১০ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি। উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ ও ব্যাপক অনিয়মে জর্জরিত ব্যাংকিং খাত সংস্কারের জন্য এ খাতসংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি স্বাধীন ব্যাংকিং কমিশন করতে হবে, ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬ ও ৪৭ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ ব্যাংককে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকির পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে, নিয়োগ অনুসন্ধান কমিটির গঠন, দায়িত্ব-কর্তব্য ও নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনাসহ বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সদস্য, গভর্নর ও ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ ও অপসারণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট লিখিত নীতিমালা করতে হবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে তিনজন সরকারি কর্মকর্তার স্থলে বেসরকারি প্রতিনিধির সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে, ব্যাংকসংশ্লিষ্ট আইনসমূহে আমানতকারীর স্বার্থ পরিপন্থী ও ব্যাংকিং খাতে পরিবারতন্ত্র কায়েমে সহায়ক সব ধারা সংশোধন/বাতিল করতে হবে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসহ সব বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে একটি প্যানেল গঠন করে সেখান থেকেই বিভিন্ন ব্যাংকের পরিচালক নিয়োগের বিধান করতে হবে, রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের ব্যাংক পরিচালক হওয়া থেকে বিরত রাখার বিধান করতে হবে এবং ব্যাংক পরিচালকদের ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি নজরদারির মাধ্যমে অনুমোদনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, ব্যাংক পরিদর্শনের সংখ্যা ও সময়কাল বৃদ্ধি, প্রত্যক্ষভাবে পরিদর্শন কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভাগসমূহের শূন্য পদসমূহ অবিলম্বে পূরণ, পরিদর্শন প্রতিবেদন যুক্তিসংগত সময়ের মধ্যে সমাপ্ত ও এর সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে এবং পরিদর্শনে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা পরিদর্শন দলকে দিতে হবে, তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি ও বাস্তবায়নে সংঘটিত অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close