ড. মুকিদ চৌধুরী
নাট্যোপন্যাস (১৩)
আটই ফাল্গুন

অবশেষে আম্মার একটি হাত- ডুবে যেতে যেতে মানুষ যেমন খড়কুটো আঁকড়ে বাঁচার শেষ চেষ্টা করে, তেমনই নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমাকে অনেক দূর চলে যেতে হবে, আম্মা। শরিফের দিকে তাকিয়ে রইলেন আম্মা, কিছুই বুঝতে পারছেন না। সে এরকম কিছু-একটা বলতে পারে, তা তার ধারণার বাইরে, জ্ঞানের বাইরে, স্বপ্নের বাইরে ছিল; তাই তিনি থ হয়ে রয়েছেন। আম্মার কাছে মনে হচ্ছে যেন দীর্ঘ, ঋজু চেহারার তার ছেলে আসলেই অবোধ। এই অবোধ ছেলেই আবার অস্ফুটস্বরে বলল, আমাকে এই শহর ছেড়ে চলে যেতে হবে, আম্মা। এ কথাগুলো সে কোনোরকমে শেষ করল, কেননা তার চোখ তখন শুকনো ছিল না; তাই যান্ত্রিকভাবে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে সুসজ্জিত রান্নাঘরের সাজানো জিনিসপত্রে, অবশেষে দৃষ্টি স্থির করল ঝকঝকে পরিচ্ছন্ন উনুনের ওপর, এখানেই যেন স্বস্তির সন্ধান করতে থাকে; কথাগুলো বলতে যতই কষ্ট হোক না কেন, বলে ফেলাতেই সে স্বস্তিবোধ করল; যদিও অশ্রুর কয়েকটি ক্ষীণ বিন্দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ে, কেননা আম্মাকে আবার নতুন করে একটা দুঃখ, একটা কষ্টের মধ্যে নিক্ষেপ করায় ওর মন বেদনায় আক্রান্ত।
মুহূর্তের জন্য মা ও ছেলে উভয়ই নিশ্চুপ। গভীর উদ্বেগের বোঝা বয়ে নিয়ে চলা আম্মার মন তবু পড়ে থাকে ছেলের হাতের মধ্যে। আর মনে মনে ভাবতে থাকেন, তার জন্যই তার ছেলের এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। সে পারলে অবশ্যই তার বেদনা লাঘব করত। তবু আম্মা কাঁদো কাঁদো কাতর সুরে বললেন, এই শহর ছেড়ে... অনেক দূরে?
শরিফ বুঝল, তার কথার উত্তরে আম্মা কঠিন কিছু বলেননি; অন্ততপক্ষে, সে যেরকম প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল সেইরকম কিছুই ঘটেনি; বরং ছেলের উত্তেজনা নিজের মধ্যে গ্রহণ করে যতটুকু উত্তেজিত না হয়ে পারা যায় না সেইরকমই বলেছেন। শরিফ বিষণ্ণ স্বরেই বলল, আম্মা, তুমি এমনভাবে বলে আমি কোনো সমাধানে পৌঁছতে পারব না।
আবেগে, উদ্বেগে আম্মার মুখখানা একেবারে বিবর্ণ হয়ে গেল। শরিফের বুঝতে অসুবিধে হলো না আম্মা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছেন। অজানা আশঙ্কায় রান্নাঘরটি জুড়ে যেন নেমে এলো গভীর এক নিস্তব্ধতা। একটু নীরবতা-নিস্তব্ধতার পর, সহসা আম্মা বলে উঠলেন, আর এই অসম্ভব কাজকে সম্ভব করার জন্যই বুঝি তুই একজন নার্সের সন্ধান করছিস? তবে তা-ই হোক। একজন নার্স আমার জন্য বরাদ্দ করে দে।
আম্মার কথা খাপছাড়া হলেও এইরকম প্রতিক্রিয়া অপ্রত্যাশিত নয়, কেননা শরিফ জানে তার কথায় আম্মা এরকম কিছু বলতে পারেন, অবশ্য আরও আগেই এরকম প্রতিক্রিয়া সে আশা করেছিল, তবে কিছুক্ষণ আগে অদ্ভুতভাবে যা প্রকাশ করলেন, তা তার কল্পনায় ছিল না; তাই সে হঠাৎ বলে বসল, তোমার দেখাশোনা করা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠেছে, আম্মা। তোমাকে তা বুঝতে হবে। আর এজন্য একজন নার্স প্রয়োজন।
আম্মার আর বাক্যুদ্ধ করার ক্ষমতা নেই, তাকে ভঙ্গুর দেখাচ্ছে, ভেতরে ভেতরে অবশ্য যন্ত্রণায় ছটফট করছেন এবং মনে মনে বলছেন, এতবড়ো দুঃসাহস শরিফ কোথায় পেল? হঠাৎ আম্মার সমস্ত স্নায়ু যেন একযোগে ছুটি চেয়ে বসল। একজন ব্যর্থ মায়ের দীর্ঘতম জীবনের অঘোষিত ব্যথা বুকের গোপনে পল্লবিত হয়ে ঝড়ের মতো আছড়ে পড়ল; তাই তিনি আঁচল চাপা দিয়ে নীরবে কেঁদে এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনের সামান্যতম রেশ খোঁজে পাওয়ার বাসনায় বললেন, তুই সত্যিই চলে যাবি? তবে কেন?
চোখ-মুখের কী আশ্চর্য ভঙ্গি আম্মার, সর্বাঙ্গে থরথর কম্পন, দেখলে মনে হয় ভেতর থেকে কে যেন তাকে আঘাত করে বসেছে, নাড়াও দিচ্ছে। তিনি এমন একটা ভঙ্গি ধারণ করে রয়েছেন, যা ক্ষুব্ধও না, নিরুৎসাহও না; এমন তো হবেনই, শরিফও তা জানে, তাই মিনতি কণ্ঠে বলল, আমার অন্য শহরে চাকুরি হয়েছে, আম্মা। তা ছাড়া বর্তমান চাকরির মেয়াদ তো প্রায় শেষ হয়ে এলো। ওই চাকরিটা না নিলে আমাদের কেমন করে চলবে? তুমি বোঝার চেষ্টা করো।
আম্মা জানেন, তার ছেলেকে কাজ করতে হয়, করা দরকারই বটে, ওর কাজ ছাড়া এই সংসার চলবে কেমন করে? এক হিসেবে ভালোই হল সে কাজের জন্য অন্য শহরে যাচ্ছে, ভালো বেতন অবশ্যই পাবে, না পেলে সে যেত না; তবে তিনি শরিফের ওপর বড্ড বেশি নির্ভরশীল; এই চিন্তাই তার হৃদয় বেদনার্ত; কিন্তু তার কাছে সবচেয়ে দুর্বোধ্য মনে হচ্ছে সমস্ত কিছু ফেলে শরিফ চলে যেতে চায় কেন? সেই মেয়েটির (শরিফের স্ত্রীর) কী হবে? সে কোথায় থাকবে? নাকি শরিফ চলে যাওয়ার ভয় দেখিয়ে তাকে শেষ পর্যন্ত রাজি করিয়ে নিতে চায়, সেই মেয়েটির এখানে নিরাপদে থাকার বন্দোবস্ত? অথবা শরিফ চলে যাওয়ার পর, সেই মেয়েটিকে এখানে ফিরিয়ে আনার উপায় সৃষ্টি করবে। উভয় ক্ষেত্রেই তো তার জন্য অনিবার্য বিপদ। তবে এরকম কাজ শরিফের প্রকৃতির সঙ্গে তো খাপ খায় না। তাছাড়া শরিফের পক্ষে এভাবে চলে যাওয়াও সম্ভব বলে মনে হয় না। এসব ভাবতে ভাবতেই আম্মা বলে উঠলেন, আর সেই মেয়েটি?
সেও আমার সঙ্গে যাবে।
তাহলে সে আর আমার সঙ্গে থাকবে না।
না, থাকবে না। সে আমার সঙ্গেই থাকবে।
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আম্মা বললেন, রক্ষা পেলাম। উত্তম ব্যবস্থা!
তোমার এভাবে বলার তো কোনো কারণ নেই, আম্মা।
না নেই। আম্মা কিছু-একটা মনে করার চেষ্টা করলেন, আর যখন খুঁজে পেলেন হয়তো তখনই বলে উঠলেন, শুধু... মানে... তোর না একটা স্ত্রী আছে! ওর নামটা যেন কী?
কানিজ।
ঠিক। তাহলে স্ত্রীকে সঙ্গে না নিয়ে একটা মেয়েকে কেন সঙ্গে নিবি?
কোন মেয়েটি?
আরে ওই-যে, যে-মেয়েটি আমার তসবি চুরি...।
সে তোমার কোনো তসবিই চুরি করেনি। আর সেই মেয়েটিই আমার স্ত্রী, কানিজ।
তাহলে চোরটাকে নিয়ে সেখানে গিয়ে বসবাস করবি?
বললাম তো সে তোমার কোনো তসবি চুরি করেনি। আর হ্যাঁ, ওকে নিয়েই আমি ওখানে থাকব।
বাহাদুরি প্রকাশ করতে হবে না, যা আরম্ভ করেছিস- বড্ড চমৎকার! আম্মার কথার খোঁচাটি ঠিকই শরিফের গায়ে গিয়ে বিঁধল। একবার ইচ্ছে হলো সত্যি সত্যিই বাহাদুরি করে বলবে, কিছুদিন পরেই বুঝতে পারবে, কানিজ তোমার জন্য কী করেছে। কিন্তু আম্মা রেগে যাবেন- এ কথা ভেবেই তার ইচ্ছে দমন করল, আর কথা না বাড়িয়ে নীরবে নিশ্চপে চুমুক দিল চায়ের পেয়ালায়, নিজেকে শান্ত ও স্বাভাবিক করার চেষ্টায়; অতঃপর নিরীহভাবে একটি শান্তির হাসি ঠোঁটদ্বয়ে ছড়িয়ে দিল। অবশ্য ছেলের শান্তির হাসিটি আম্মা লক্ষ করলেন না, কেননা তার দৃষ্টি তখন চায়ের পেয়ালায়। পেয়ালার ওপর দৃষ্টি স্থির করেই অতিধীরে এবং অত্যন্ত সন্তর্পণে যোগ করলেন, আচ্ছা সেখানে কি বাঙালি খাবার পাওয়া যাবে?
যাবে। আর না পেলে খুঁজে নেব। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আম্মাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে মাথায়- মাথার চুলগুলো ধবধবে সাদা- চুমু খেলো শরিফ, তবে তা ক্ষণিকের বেশি নয়। আম্মাও হাতবাড়িয়ে শরিফকে জড়িয়ে ধরেননি, কেননা তার সমস্ত সত্তা জুড়ে একমাত্র ভাবনাই- ছেলে তাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে; তা অত্যন্ত প্রবল তার মনে; এ ভাবনাটিই তার প্রাণের সমস্ত আবেগকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে মাথা উঁচিয়ে প্রাচীর হয়ে রইল; আর তার মন শক্ত বাঁধনে বন্দির মতো ছটফট করতে লাগল। চেয়ারে পা ঝুলিয়ে যেভাবে বসেছিলেন, সেইভাবেই বসে রইলেন, শুধু দৃষ্টি খানিকটা কোমল, প্রকৃতপক্ষে মমতার অস্পষ্ট অভিব্যক্তি যেন; হয়তো শরিফের তার মাথায় চুমু কাটাটি আরো একটু চললে তার দুচোখে ফোয়ারার মতো জল উৎসারিত হতো, তাই হয়তো তিনি অপেক্ষা করলেন শরিফের চুম্বন কাটা বন্ধ করে দেওয়ায়, আর তাই হয়তো তার দুটি চোখ দিয়ে অশ্রুবিন্দু গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়তে সময় নিল না, ছেলেকে তিনি সত্যিই হৃদয়ের সবটুকু দিয়ে, সমস্ত অনুভবশক্তি দিয়ে ভালোবাসেন; যদিও শরিফ অশ্রুবিসর্জন লক্ষ করেনি, এমনকি আঁচল দিয়ে অশ্রু মোছাও নয়, কেননা তখন সে আম্মার মাথায় নিজের মাথা কাত করে রেখে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, তবু আম্মার আহ্লাদে ভরপুর চক্ষুদ্বয় জলে টলটল করতে থাকে, বিষাদসিন্ধুর বিষণ্ণতায় ভরে উঠেছে যেন। অতঃপর আম্মা নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ রে, সত্যি সত্যিই তুই পালিয়ে যাবি?
পালিয়ে যাব, মানে?
শরিফ এমনভাবে কথাটি বলল যে, ঘরের করুণ আবহাওয়াও বীভৎস প্রতিবাদে, এই সামান্য কথাটুকুর মধ্যেও, বজ্রের মতো গর্জে উঠল। আম্মাও গর্জন করে উঠলেন, বললেন, সত্যি করে বল তো আমি কি ওকে চিনি?
কাকে?
ওই-যে যার সঙ্গে তুই পালিয়ে যাবি ওকে?
অবশ্যই। সে-ই তো কানিজ।
তাহলে স্বীকার করলি, তুই আমাকে ছেড়ে সেই মেয়েটির সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছিস?
আম্মা!
আম্মা এই শব্দটি শুনতে পেলেন না, তিনি যেন চৈতন্য আর অচৈতন্যের মধ্যবর্তী একটা অবস্থায় নিমজ্জিত, তাই শুনতে পেলেন, শুধু দেখতে পেলেন তার স্বামী এসে তার সমানে দাঁড়িয়ে বলছেন, বুড়ো হলে ছেলে থাকা আর না-থাকা দুই-ই সমান, অবহেলায়ই কাটাতে হবে বাকি জীবনটা। হঠাৎ চৈতন্য আর অচৈতন্যে মধ্যবর্তী লোক থেকে জেগে উঠলেন আম্মা। ঘাড় ফিরিয়ে শরিফের দিকে তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকালেন তিনি। তিনি ছাড়াও শরিফের যে একটা জীবন আছে, সেই কথা ভুলে থাকতে চেয়েছিলেন আম্মা। অতি কোমল স্বরে তার সমস্ত নিরুপায়তার শেষ কথা প্রকাশ করলেন, বললেন, আমার অদৃষ্ট!
অদৃষ্ট শব্দটি কী ভয়ানক, ভীষণ ভয়াবহ- কখনও পাতালের অগ্নিতে জল ঢালে, আবার কখনও আকাশে ঝড় তোলে; কিন্তু এই মুহূর্তে, এই পরিস্থিতিতে সহসা আগুনেই জল পড়ল, বিশেষ করে বুদ্ধিমান শরিফের এই মোক্ষম সময়ের কথায়, সে বলল, তুমি জানো, এই কাজটা আমার কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ। অন্যথায় যেতাম না। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি, আম্মা।
শরিফ সত্যিই সবকিছু সুন্দরভাবে গুছিয়ে বলতে জানে, ভারি চমৎকার তার ভাষা। তবে তার মন ভারাক্রান্ত আত্মসচেতনার যন্ত্রণায়। নূতন কর্মজীবনের নতুন তীব্র স্রোতে নিজে ভাসিয়ে দিতে চাইলেও এখন, এ মুহূর্তে, তার পায়ের তলার শক্ত মেঝেয় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না, সমতারক্ষার্থে ব্যর্থ হল; আম্মার উদ্বিগ্ন ক্রমেই যেন নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে তা সে স্পষ্টই উপলব্ধি করতে পারছে। আম্মাও শরিফের কথায় শিহরিত, তার মুখ শুকিয়ে উঠেছে, কণ্ঠও তৃষ্ণিত, তাই তিনি কোনও কথা বলতে পারলেন না, নিশ্চুপ থাকা ছাড়া তার পক্ষে আর কোনও উপায় নেই, শুধু মনে মনে বলে চললেন, দ্বিরুক্তি বা বাদপ্রতিবাদের আর কোনও সুযোগ রইল না। আম্মাকে বাক্যহীন দেখে শরিফ একটু সচকিত হলেও একঝোঁকে বলে ফেলল, প্লিজ আম্মা, অমত কর না।
কিসে অমত?
আম্মার অনেক মূর্তি শরিফ দেখেছে, কিন্তু ঠিক এ মূর্তিটি বোধ হয় সে এর আগে কখনো দেখেনি, তাই ফিকে গলায় বলল, তোমার পছন্দমতোই একজন নার্স রাখতে চাই।
নিজের কথায় নিজেই প্রীত হল শরিফ। আম্মা এদিক-ওদিক তাকিয়ে উদাস গলায় বললেন, তোর মনোবাসনা পূরণের জন্য আমাকে আর কী কী করতে হবে, পুত্র?
শরিফ মাথা নত করল। শরিফের মুখে আর কোনও কথা নেই, সে নির্বাক। আম্মার ওপর একটা রুদ্ধ অভিমান তার অন্তরের বন্ধ দ্বারের চৌকাঠে চটি জুতোর আঘাত করতে থাকে, ফলে তার বুকের মধ্যে কী যেন কী একটা শক্ত হয়ে পাকিয়ে উঠল, এই অহেতুক যন্ত্রণার চেয়ে দৈহিক যন্ত্রণা সহ্য করা হয়তো অনেক বেশি সহজ; তাই হয়ত মনে মনে বলতে লাগল, আম্মাকে ছেড়ে যাওয়ার ভাবনাটি ভীষণ ভয়ংকর, তার চেয়ে আরও বেশি সাংঘাতিক। পলকহীন চোখে চেয়ে থাকে শরিফ; এই মুহূর্তে নিজের প্রতি এক তীব্র ঘৃণাবোধ জেগে ওঠে, গ্লানির অজস্র বাহুর কঠিনবন্ধনীতে যেন তাকে চেপে ধরে।
রান্নাঘরে কানিজ উবু হয়ে মেঝে পরিষ্কারে ব্যস্ত থাকলেও তার মন যেন মহাকাশে বিচরণ করছে, বিরাট অনৈসর্গিক জ্যোতির্ম-লে তার চিত্ত ও চিন্তা যেন হারিয়ে যাচ্ছে, ক্রমশ তার শরীরও অশরীরের পরিণত হয়ে চলেছে; আর তাই হয়তো ভেজা ন্যাকড়ের ভেজা শব্দভাঙার মধ্যে কখনও কখনও মুখ তুলে দরজার দিকে তাকিয়ে কী যেন বিড়বিড় করছে, হয়তো-বা করছে না, কিন্তু যখন তার অস্পষ্টস্বর প্রকাশ পাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে তার কণ্ঠে রয়েছে গভীরমিলনাভিলাষী হরিণীর সুর; তার এই কর্মকাণ্ড দরজার পার্শ্বে দাঁড়িয়ে, নিশ্চুপে, অন্য-একজন দেখে চলেছেন, তাকে ক্রমাগতই কানিজের কর্মকাণ্ড রোমাঞ্চিত করছে, ব্যক্তিটি আর কেউ নয়, স্বয়ং আম্মা। কানিজের এই কর্মকাণ্ড আম্মার ধৈর্যচ্যুতি এবং অতি-উগ্র আগ্রহের কারণ হয়ে উঠেছে, ভেজা ন্যাকড়ের ভেজা শব্দগুলোও যতটুকু না আম্মাকে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দিচ্ছে না, তার চেয়ে বেশি কানিজের অস্পষ্ট শব্দগুলো যেন তাকে অস্থির করে তুলছে, তিনি বারবার উদগ্রীব হয়ে কানিজের দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিচ্ছেন, এবং পরক্ষণেই আবার কানিজের ওপর দৃষ্টিস্থাপন করছেন, এ কারণেই হয়তো-বা তার মনে হচ্ছে কানিজ তাকেই লক্ষ করে কিছু-একটা বলছে; তবে এও সত্য যে, তিনি কানিজের মুখ থেকে স্পষ্ট কিছু শোনার জন্যই অপেক্ষা করছেন। তাছাড়া এও সত্য যে, কানিজকে নিয়ে তার অন্তরে ভয়জনিত ক্লীব অবিশ্বাসের অনর্গল শ্লোকধারা উৎসারিত হয়ে চলেছে, মনে হচ্ছে, তাদের সম্পর্ক অনেক আগেই বাধাবিগ্রহ হয়েছে; তাই হয়তো একসময়ের প্রজ্জলিত সম্পর্ক নির্বাপিত হতে হতে আজ নিঃশেষিত প্রায়; এজন্যই হয়তো-বা কানিজকে আর আম্মা চিনতে পারছেন না, কিংবা বিরক্ত হয়েই চিনতে চাচ্ছেন না।
"