অলোক আচার্য
বইমেলা হোক মানসম্পন্ন বইয়ের প্রকৃত লেখকের

মাঘের শেষ থেকেই প্রকৃতিতে ফাল্গুনের সুর শোনা যায়। প্রকৃতির এ পরিবর্তনের সঙ্গে যোগ হয় বইমেলা। বইমেলা শব্দটি শুনলেই মনের পর্দায় ভেসে উঠে অসংখ্য বই নিয়ে আয়োজিত একটি মেলা। আমাদের দেশে মূলত বইমেলা বলতে ফেব্রুয়ারিজুড়ে যে বইমেলার আয়োজন করা হয় সেটিকেই বোঝায়। স্বাধীন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী যত মেলা আছে, তার মধ্যে বইমেলা অন্যতম। ভাষার মাসে শুরু হয় এ বইমেলা। ভাষা আমাদের আবেগ আর বইমেলা আমাদের ঐতিহ্য। সুতরাং বইমেলা মূলত আমাদের আবেগ আর ঐতিহ্যের সমন্বয়। বইমেলা মানেই নতুন বইয়ের পাহাড় জমা, পাঠক-লেখক-প্রকাশকের মিলন মেলা। প্রিয়জনের সঙ্গে দেখা করা, খাওয়া-দাওয়া করা আর ঘুরে বেড়ানোর আবেদন তো থাকেই। বছর ঘুরে আবারও দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বইমেলা। প্রতিবার বইমেলার আগে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ থাকে প্রকাশকদের। কারণ অবশ্যই ব্যবসা। বছরজুড়ে বইয়ের ব্যবসার অবস্থা থাকে ভয়াবহ! বছরব্যাপী মানুষ বই-টই মানুষ খুব একটা কেনে না। ফলে এই একটা সময় প্রকাশকরা ব্যবসায় করার আশা করেন। এরপর প্রত্যাশা থাকে লেখকদের। লেখকদের লেখা বই বিক্রি হওয়ার সময় এটা। পাঠকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার একটা সুযোগ থাকে বইমেলায়। আর সবচেয়ে প্রত্যাশা কম থাকে যাদের তারা পাঠক শ্রেণি। কারণ তাদের লাভ লোকসান হওয়ার তেমন কোনো সুযোগ থাকে না। ইচ্ছে হলে কিনলাম আর না হলে না কিনলাম। কেউ জোর করবে না। তবে যদি সত্যিকারের পাঠক হন তবে তার প্রত্যাশা প্রথম দুই শ্রেণি থেকেও বেশি থাকে। তিনি বই কেনেন এবং লেখককেও যাচাই করেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বইমেলা বিস্তৃত হয়েছে। বইমেলার অনেক আগেই কোন লেখকের বই কোন স্টলে পাওয়া যাবে, কত দাম হবে এমনকি প্রি-অর্ডারের সুযোগও রয়েছে। যদিও এতে খুব বেশি লাভ হয় না। প্রচারের আরো মাধ্যম রয়েছে। বইমেলায় মিডিয়াগুলো বিশেষভাবে কাভার করে। লেখক-কবিকে হাসিমুখে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়। অথচ দেশের পাঠকদের একটি বড় অংশই তাকে চেনে না এমন অবস্থা। দেখা গেল ফেসবুকে লেখেন এমন কবির কদরই বেশি! তার বই পাঠক লাইন দিয়ে কিনছে। গত বছর এমনটা হয়েছিল। এজন্য গত বছরটার নাম হয়েছিল ‘ভাইরাল লেখকের বইমেলা’। এর সূত্রটা সোজা। আগে আপনি ভাইরাল হবেন তারপর বই লিখে মেলায় আনবেন। মান-টান সব চুলায় যাক!
এ থেকে ধারণা করা যায়, দেশে সাহিত্যের গতি-প্রকৃতি কোন দিকে যাচ্ছে। ভাইরাল হওয়ার পর আপনি যা লিখবেন পাঠক সেটাই কিনবে। আপনি ততদিনে বিখ্যাত! হুমায়ূন আহমেদের পর এ দেশে বইমেলার কোনো স্টলে উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায়নি। অর্থাৎ কেউ পাঠককে টানতে পারেনি। এটা পাঠকদের দুর্ভাগ্য। পাঠকদের আরো একটি দুভার্গ্য আছে। সেটি হলো বইয়ের দাম। বাজারে সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বইয়ের দামেও সেই আঁচ লেগেছে। কিন্তু পাঠক বাড়তি দামে বই কেনার মতো যুক্তি যদি খুঁজে না পান তাহলে গুঁড়ে বালি। মানে প্রকাশক ও লেখকদের আশা ভঙ্গ হওয়া। অধিকাংশ লেখক অবশ্য নিজের গাঁটের টাকা খরচ করে বই প্রকাশ করেন! ফলে বইয়ের দাম বৃদ্ধি মেলায় বই বিক্রির ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে গত কয়েকটি বইমেলায়। এই জায়গা এবার ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। কারণ পরিস্থিতি সেটা বলে না। তবে পাঠকদের কথা এবং ব্যবসায়ের কথা মাথায় রেখেই বইয়ের দামে একটু বেশি কমিশন বা ছাড়ের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
শুধু স্টল আর লেখক-প্রকাশক বাড়লেই তো হবে না, বইমেলার মূল উদ্দেশ্য তো পাঠককে টেনে আনা। সেই কাজটি ঠিকঠাক হচ্ছে না। মেলায় দর্শনার্থী আসে বেশি, পাঠক কম! এরা বই কিনে না, ঘুরে বেড়ায়। যে প্রকাশনীগুলো নামে মাত্র প্রকাশনী এবং মানহীন বই নিয়ে মেলায় আসছে, সেসব প্রকাশনীকে বরাদ্দ দেওয়ার খুব দরকার আছে বলে মনে হয় না। মান নিয়ে বইমেলার শেষে প্রশ্ন তোলার থেকে ভালো হয় আগেই মানের দিকে লক্ষ্য রেখে মৌসুমি প্রকাশকদের বিরত রাখা। শুধু প্রকাশকদের ঠেকালেই তো হবে না। এ থেকে মৌসুমি লেখকরাও দায় এড়াতে পারেন না। বইমেলায় একটা বই প্রকাশ করেই বিখ্যাত হওয়ার দৌড়ে নামেন তারা! ভাব এমন যে, মেলায় বই প্রকাশ হলেই সে বিখ্যাত লেখক! ওই কিছুটা ঈদসংখ্যার লেখকের মতো অবস্থা! এখনকার ঈদ সংখ্যাগুলো তেমন কেউ না পড়লেও ঈদসংখ্যায় লেখার জন্য ভিড় জমে যায় সম্পাদকের দপ্তরে! এদের আবার সেজেগুজে সারাদিন টিভি ক্যামেরায় সাক্ষাৎকার দেওয়ার জন্য ছোটাছুটি করতে করতেই দিন শেষ হয়ে যায়! তারপর সেই ছবি আবার ফেসবুকে আপলোড করা! লেখক হওয়া তো চাট্টিখানি কথা না! একইসঙ্গে লিখতে হয়, প্রচার করতে হয়, বিক্রিও করতে হয়! বিক্রি না হলেও সমস্যা নেই, হাসি হাসিমুখ করে পরিচিতজনদের হাতে গছিয়ে দেওয়া যায়! পয়সাওয়ালা লেখকরা অনেকেই চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠককে টানার চেষ্টাও করেন। আসলে পাঠক তাতে সাড়া দেন না। পাঠক খোঁজেন লেখক। প্রকৃত লেখক। যার লেখা তাদের বইয়ে ধরে রাখতে সক্ষম হবে। যারা সত্যিই ভালো লিখছেন তাদের বই এমনিতেই বিক্রি হয়। পাঠকই বই খুঁজে বের করে। এত ঝামেলার দরকার হয় না। এই সমস্যার কোনো সমাধান নেই। কারণ প্রতি বছর অবশ্যম্ভাবীভাবেই বৃদ্ধি পাবে প্রকাশনীর সংখ্যা এবং লেখকের সংখ্যা। টাকা দিলেই তো মানহীন লেখাগুলোও বই আকারে প্রকাশিত হচ্ছে! সংস্কৃতির এ দায়ভার কার কাঁধে বর্তাবে? জাতিকেই বইতে হবে! বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক।
আপনি হয়তো চটকদার বিজ্ঞাপন আর নাম দেখে একটি বই কিনলেন এবং সেটি পড়ে যদি আপনার বই সম্পর্কে বীতশ্রদ্ধ ভাব জেগে উঠে তাহলে দেশের সাহিত্য নিয়েও বিরূপ ধারণা জন্মাতে বাধ্য। তবে এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সাহিত্যচর্চার এবং বিকাশের অন্যতম কেন্দ্র হলো বইমেলা। সৈয়দ মুজতবা আলী বলেছিলেন, বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না। দেউলিয়া না হলেও পাঠক ঠকে এটা সত্যি। যদি আশা করি বইমেলার জন্যেই দর্শনার্থীরা আসবে এবং একটা করে বই কিনে বাড়ি ফিরবে, তাহলে সেটা উচিত হবে না। কারণ পাঠক তার পছন্দ মানের বই না পেলে কেন বই কিনবে? কয়েক বছর হিসাব করে দেখা হয়েছে, প্রকাশিত বইয়ের বড় অংশই মানহীন ছিল। প্রশ্ন হলো, মানহীন বই দিয়েই একটি পুরো বইমেলা কেটে গেছে এবং পরের বছরও তারা আবার বই প্রকাশের সুযোগ নিয়েছে এবং মেলায় থেকেছে। এখানেও সমস্যা রয়েছে। এত মানসম্পন্ন লেখক আমরা কোথায় পাব। তা ছাড়া মেলার পরিধি আগের থেকে ছোট হলে সেটিও সমালোচনার মুখে পড়তে পারে। উভয় সমস্যা রয়েছে। এত এত বই লিখে, পকেটের টাকা দিয়ে ছাপিয়ে কী লাভ হলো যদি তার সাহিত্যিক মানই না থাকল বা যদি বানান ভুলে ভরা বই হলো অথবা তার প্রচ্ছদের মান নিম্নগামী হলো? এখানেই প্রশ্ন হলো, আসলেই কি এভাবে কোনো ভালো লেখক হয়ে ওঠা সম্ভব? ভালো লেখকের পেছনে প্রকাশকেরও দায় বা দায়িত্ব থাকে। যেন তেন লেখা মুদ্রিত করে বই বানিয়ে বিক্রি করে একজনকে লেখক আখ্যায়িত করার কাজটি তো প্রকাশকই করছেন। যদি ভালো লেখক না হতে পারা যায়, সে কীভাবে একটি ভালো বই পাঠককে উপহার দিতে পারেন? বইমেলা শুরু হলেও বই প্রকাশের ব্যস্ততা থাকে। মাসের শেষদিকেও প্রচুর বই আসে। বলাই বাহুল্য, এসব বই এত দ্রুত বের করতে হয় যে, প্রায়ই বানান ভুল এবং বিভিন্ন অসঙ্গতি দেখা যায়। অথচ একটি বইয়ের পেছনে যে শ্রম দিতে হয়, তা আর কেউ-ই দিতে চান না। কারণ এই সময়ে হাতে প্রচুর কাজ প্রকাশকের। তারপর আবার প্রতি বছর কোত্থেকে সব প্রকাশনী এসে হাজির হয় বই প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিয়ে, যাদের সারা বছর দেখ পাওয়া যায় না। একটি বই প্রকাশের ক্ষেত্রে বানানের প্রুফ রিডিং, প্রচ্ছদ, বইয়ের গেটআপ ইত্যাদি নানা বিষয় রয়েছে, যার দেখভালে সময় দরকার হয়। যখন একটি জায়গায় খুঁত থাকে, তখন তা একটি অসম্পূর্ণ মানহীন বইয়ের কাতারে নাম লেখায়। এত মানহীন বই দিয়ে কী করব আমরা? বইমেলায় আমরা মানহীন, ভাইরাল বইয়ের জগত থেকে বের হয়ে মানসম্পন্ন বই এবং প্রকৃত লেখকের দেখা পাব, এ আশা করতেই পারি।
"