ড. মুকিদ চৌধুরী
নাট্যোপন্যাস-১০
আটই ফাল্গুন
আম্মার চোখের সব জল এক লহমায় চুষে নেয় তার বুকের ভেতর টগবগে সাহারার আতপ্ত বালুকারাশি যেন। আম্মা মটমটিয়ে বললেন, তুই কীভাবে জানিস, ওখানে আমি আমার মূল্যবান জিনিসপত্র রাখি?
শরিফের বুকের ভেতর দুদ্দাড় শব্দে মহাপ্রলয়ের নাচন শুরু হলো, সে যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে আগ্রাসী নদী পাড়ের মৃত্তিকাকে কত সহজেই গিলে খাচ্ছে; মাটির চাঙ্গড় ভাঙা ঝুপঝাপ শব্দের তীব্র কোলাহলে সে দুহাতে কান-চাপা দিয়ে বাঁচতে চাইল। আম্মার কথায় শরিফের স্পৃহার একটা বড় ছেদ পড়লেও তার কাছে এর কোনো সদুত্তর নেই, কেননা আম্মার বিস্ফোরিত চোখমুখের সামনে দাঁড়ানো ছেলে এইমাত্র যা শ্রবণ করল, সেই কথার প্রত্যুত্তরের কোনো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না; তাই হয়তো সে বলতে বাধ্য হলো, জানি, ব্যস।
এ বাক্যের বাকচাতুর্যে মুক্তির কোনো দিশা ছিল না। জানি ও ব্যস- এই দুইয়ের দুস্তর ব্যবধান সম্বন্ধে সেও যেন অবগত নয়, ফলে সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আর-এক তীব্র সত্যকে স্বীকার করার সাহস একমুহূর্তেই যেন বাতাসে মিলিয়ে গেল। কিন্তু আম্মার কর্ণকুহুরে ক্রমাগতই বেজে চলল- জানি, ব্যস; তাই হয়তো আম্মার চোখ দুটি জ্বলজ্বল করে উঠল, মুখটি আরক্ত হয়ে গেল। এরই মধ্যে তিনি রান্নাঘরের সিংকে নামাজের জন্য অজু করেছিলেন, ভালো করে মোছাও হয়নি, তাই চুল এখনো ভেজা; ভেজা চুল থাকা সত্ত্বেও মাথা এমন গরম হয়ে গেল যে, তিনি বাধ্য হয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললেন, তুই কি লুকিয়ে লুকিয়ে আমার আলমারি তল্লাশ করিস? আমাকে সত্য কথাটি বল্।
কোলের ওপর ডান হাতের তালুতে বা হাতের তালু স্থাপন করে মেরুদণ্ড সোজা করে বসেছিল শরিফ, সে আনন্দ ও বেদনার অতীত; তবু ধীর, স্থির, বিকারহীন মূর্তির মতো সংহত ও সচেতন। তার মাথার ভেতর শতসহস্র বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছে; তাই হয়তো মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো, না।
শরিফের এমন ‘না’ শব্দে এবং তার এমত আচরণে দারুণ অবাক হলেন আম্মা; তার চোখ দুটি যেন অঙ্গারের মতো জ্বলছে, মিটিমিটি; মুখমণ্ডলটি হ্যারিকেনের ম্লান আলোর মতো উদ্ভাসিত। আম্মা সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে পুত্রের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন যে, শরিফ তার আলমারি গোপনে তল্লাশ করে; ফলে মনের মধ্যে নানা প্রশ্নের উদয় হতে শুরু করে। নিজের ভেতরেই ভীষণ রাগ হয়। মনের উদিত হওয়া প্রশ্নগুলো মুখে উচ্চারণ না করলেও বজ্রগম্ভীর ধমকের আওয়াজে বললেন, তাহলে তুই কীভাবে জানলি... মানে... আমি যে সেখানে মাঝেমধ্যে আমার মূল্যবান জিনিসপত্র রাখি?
কিছুক্ষণের জন্য শরিফ আচ্ছন্ন হয়েছিল একটা ঘোরের মধ্যে। মৃত্তিকার গড়া ভঙ্গুর প্রতিমার মতো তার অন্তর যেন চুরমার হয়ে যাচ্ছে। মুমূর্ষ জন্তুর মতো তার দেহটা থরথর করে কাঁপছে। চোখের গভীরে খেলে বেড়াচ্ছে অতীতের সাতরং স্মৃতি। আম্মার সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে মনে করে নিজের প্রতিই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল সে, আর মনে মনে বলল, এ কী আকস্মিক সর্বনাশের সূচনা ঘটল! আর প্রকাশ্যে বলল, মনে করতে পারছি না। হয়তো দুর্ঘটনাক্রমে কোনো একসময় এটি খুলে ফেলেছিলাম।
এ কথা বলে যেন শরিফের চোখের তারায় ফুটে উঠল একরমক সহানুভূতির চিহ্ন। কিন্তু আম্মার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণই তিনি লড়ে যাবেন। আঁচলে ভালো করে চোখ মুছলেন আম্মা। এখন তার মুখ দেখে কে বলবে একটু আগে তিনি ক্ষেপে ছিলেন! তিনি তার দুর্বলতা দূর করে- কোনো দিকেই তার যেন কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই- শোয়ার ঘরের দিকে এগিয়ে চললেন। আম্মা চলে যাচ্ছেন দেখে শরিফ অজানা এক আতঙ্গে শিউরে ওঠে, কূলকিনারা ভেবে পাচ্ছে না সে, জীবনে এত অসহায় নিজেকে কোনো দিনই মনে হয়নি, তার চোখের চামড়ায় ভাঁজ পড়ে, বলতে থাকে- তুমি আবার কোথায় যাচ্ছো? আমি তোমার কোনো জিনিস স্পর্শ করিনি, আম্মা।
আম্মা তবু চলে গেলেন তার লুকানোর জায়গা দেখতে, শোয়ারঘরে। আম্মার মনটা খারাপ হয়ে আছে, ধীরে ধীরে আলমারি খুঁজতে থাকেন, কিন্তু মুখে কোনো কথা নেই, কিন্তু মনে মনে বলতে থাকেন, ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ছাড়া আমার মতো মানুষ এখানে জীবন কাটায় না।
"