ড. মুকিদ চৌধুরী

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

নাট্যোপন্যাস-৭

আটই ফাল্গুন

শরিফ ছুটে টুকরোগুলো ঝাড়ু দিয়ে তুলে নিতে লাগল। আর আম্মা চায়ের পেয়ালা এভাবে ভেঙে যাওয়ায় কেতলিটি বন্ধ করে দিয়ে ছেলের দিকে তীক্ষèদৃষ্টিতে তাকিয়ে আচমকা একটু সতর্ক হলেন, তবু ভুরু কুঁচকে বলে ফেললেন, হাত? কী যে বলছিস পাগলের মতো! যা বলছিস এ সম্বন্ধে তোর কি কোনো ধারণা আছে?

টুকরোগুলো তুলে আবর্জনা রাখার মাঝারি আকারের পাত্রে ফেলতে ফেলতে শরিফের মন সংকুচিত হয়ে উঠল, যদিও সে জানে আম্মা তাকে সত্যিই অসম্ভব ভালোবাসেন; শুধু তা-ই নয়, আম্মার যা-কিছু আশা-আকাঙ্ক্ষা সবই তাকে ঘিরে, বলতে গেলে একমাত্র তারই জন্য তিনি বেঁচে আছেন, ছেলের জন্য কিছু করতে সত্যিই তার ভীষণ ভালো লাগে- চা বানিয়ে দেওয়া কিংবা রুমালে ফুল তোলার মতো কাজগুলোর মধ্যে সত্যিই আনন্দ পান। তা ছাড়া শরিফ যেন নিজের শরীরের প্রতি যত্ন নেয় সেজন্য তিনি তাকে বারবার মিনতি করেন। এসব ভাবতে ভাবতেই শরিফ বলল, আম্মা, তুমি আমার কথা কেন বুঝতে চাও না? তুমি না বুঝলে, বলো তো, আমার আর কে আছে বুঝবে?

ছেলের কথায় এবার আম্মার মনটা একটু দুলে উঠল, কিন্তু পরক্ষণেই একটা ছবি চোখের পাতায় ভেসে উঠতেই সব নষ্ট হয়ে গেল, ছেলের প্রতি মায়ার ভাটা পড়ল। আম্মা তীক্ষè ও ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, তাই তো বলছি, সেই মেয়েটির মধ্যে সন্দেহ-বাতিক একটা মেজাজ রয়েছে, সে সবসময় বকে। বিশেষত ...।

শরিফের সংযম অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া সংযত না হয়ে, না ভেবেচিন্তে কখনো সে কিছু করে না, যদি-বা করে, অন্তরালে করে; জীবনের সমস্ত অসংযম তার গোপনীয়। আম্মার ইঙ্গিতের বর্শার আঘাতে গা আহত হলেও সে শুধু বলল, বিশেষত!

শরিফের স্বরের যুগপৎ দৃঢ়তা ছিল। আম্মা চেয়ে রইলেন একদৃষ্টিতে পুত্রের দুটি চোখের পানে, তারপর সচেতন হলেন, তার দ্বিধা নেই কোনো কিছুতেই; এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় শুধু ছটফট করছেন, এ যেন দেবদূতের গায়ের জীর্ণমলিন পোশাক, ফুলের গায়ে কাদা। আম্মা ডুকরে ওঠে বললেন, শোন শরিফ, আমি কিছুই বলতে চাইনি... কিন্তু তোকে যদি একান্তই বলতে হয়, তাহলে শোন, ওই মেয়েটির ওপর আমার সন্দেহ হয়।

শরিফ যেন দেবমূর্তি, যেন শিবের ছাচে ঢেলে তার দেহটি সৃষ্টি করা হয়েছে। সৌম্য, প্রশান্ত, নিখুঁত, বিশাল দেহ তার; চওড়া বুক; পেশিবহুল সুডৌল বাহু; অন্যের দৃষ্টি তাকে দেখে মুগ্ধ হয়। সে তার পেশিবহুল সুডৌল বাহুদ্বয় রান্নাঘরের আইল্যান্ডের ওপর রেখে এবং রাগ চেপে কোনোরকমে বলল, সন্দেহ? কানিজকে তোমার সন্দেহ হয়?

আম্মার মুখ দেখে কোনো কিছুই বুঝতে পারছে না শরিফ, কেবল তার কপালে কয়েকটি চিন্তারেখা উদ্ভাসিত আর চোখের পলক পড়ছে অনিয়মিতভাবে। আম্মা দৃঢ়কণ্ঠেই বললেন, অবশ্যই। সে আমার জিনিসপত্র চুপিচুপি চুরি করে নেয়।

চুরি! তোমার কোন জিনিসটা সে চুরি করেছে, বলো তো?

আমার তসবি।

তসবি?

শরিফের ঠোঁট কয়েকবার কাঁপতে থাকে। খুব দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারিত তসবি শব্দটি যেন আর্তনাদের মতো শোনাল। সে বড় বড় শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছে, অথচ পারছে না। আম্মা এগিয়ে এলেন; তিনি কিছুটা বিরক্ত, কিছুটা আতঙ্কিত, তবে মনে মনে কৌতূহলী না হয়ে পারেন না, আসলে তিনি দেখতে চান শরিফ কী করে। শরিফ অবশ্য ঝগড়া করতে আসেনি, এসেছে মা ও স্ত্রীর মধ্যে একটা সুসস্পর্ক বজায় রাখার জন্য, কিন্তু এখন সে মনে করছে, এই কাজটাও ভালোভাবে করতে পারবে না, আম্মা ও তার স্ত্রীর সম্পর্কের ফাটল ঝালাই করার কৌশল তার কাছে অজানা। শরিফের মুখের দিকে তাকিয়ে আম্মা বললেন, হ্যাঁ, তসবি। মক্কা শরিফ থেকে আনা যে তসবিটি পড়ে প্রতিদিন নামাজ শেষে তোর মৃত বাবার জন্য দোয়া করি, সেই তসবিটি।

শরিফের ঠোঁট দুটি যেন সঙ্গে সঙ্গেই শ্বেতবর্ণ ধারণ করল, যদিও সে আম্মার সবটুকু ভালোবাসা নিংড়ে সে বড় হয়ে উঠেছে, তবু কানিজের কথা ভাবলে তাকে নিঃশব্দে নেমে যেতে হয় পাতালে। এই মুহূর্তে সহানুভূতির ডালি আম্মার চেয়ে কানিজের দিকেই বেশি, তাই হয়তো সে কিছুক্ষণ নীরব রইল। এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা তার মধ্যে দেখা দিল, পাথরের মতো স্থির সে। তারপর বলল, হয়তো তুমি হারিয়ে ফেলেছ?

ছেলের দিকে তীক্ষèদৃষ্টিতে তাকিয়ে আম্মা বললেন, কখনো না।

শরিফ কী বলবে, ভাবছে; শুধু অপরিসীম একটা ধিক্কারে দীর্ণবিদীর্ণ মনে নিশ্চুপে বলতে থাকে, আল্লাহ তুমিই একমাত্র সাক্ষী।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close