মাহবুবা ফারুক

  ০৬ ডিসেম্বর, ২০২৪

মুক্তগদ্য

কান কথা

সৌন্দর্য রক্ষা ছাড়াও কান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ শোনার কাজ নিয়ে কান এসেছিল পৃথিবীতে দেহের সঙ্গী হয়ে। এক কান দুই কান ভাই-বন্ধু। এক কান যা শোনে, আরেক কান ঠিক তাই শোনে যদি অসুস্থ না থাকে। একজনেরটা অন্যজন শুনেই মেনে নেয়। কখনো বিরোধিতা করে না। অনেকটা দুই চোখের মতোই। মানুষ দুই কানকেই সমান যত্ন করে। সমান গুরুত্ব দেয়। এক কানে শোনার পর আরেক কানকে আর জিজ্ঞেস করে না সত্য-মিথ্যা নিয়ে। আবার দুটো কান আছে বলেই ভাবে না একটা কান না থাকলে না থাক। একটা দিয়েই চলবে। একটাকেই তেল দিই। আর কান কাটা গেলে এক কান, দুই কানের হিসেব নেই। ফলাফল সমান সমান। পুরোই গেল। কান বিগড়ে গেলে একটা ভালো আছে ভেবে বসে থাকে না কেউ। না নেয় সান্ত¡না। দুটোই ভালো রাখার জন্যে ডাক্তারের কাছে দৌড়ায়।

তো যা বলছিলাম। কানের কাজ হলো প্রথমত শোনা। নিজের সিন্দুককে সমৃদ্ধ করা। মুখের কারণে প্রায়ই ভাণ্ডার খালি হয়ে যায়। তাতে সে শোনা বন্ধ করে না। আবার জমানোর কাজে ব্যস্ত হয়। মুখের ওপর কিছুটা অভিমান হয় কখনো হয়তো। তবে নিজের কাজ করেই যায়। এরপর যদি ইয়ার ফোন লাগিয়ে, চশমার বোঝা দিয়ে চোখের বাড়ির বাড়তি দায়িত্ব দেওয়া হয়, দুল পরার জন্যে ছিদ্র করে করে চালুন বানিয়ে দেওয়া হয়, তখন কেমন লাগে কানের? আর শাস্তির জন্যে কান টানা তো অনেকের কাছে খুবই প্রিয় কাজ। অনেকটা তেঁতুল খাওয়ার মতো। দোষটা যদিও শুধু অংক টিচারকেই দেওয়া হয়। বিষয়টা আসলে তা না। চুল টানার চেয়ে কান টানা বেশি মর্যাদার অধিকারী। না-হলে শরীরে এত জায়গা থাকতে কানটাই কেন টানার জন্যে এত পছন্দ হবে? কানটাও ভাই! কোনো কারণে লজ্জা পেলে সে সবার আগে লাল হয়ে বসে থাকে। শোনার পর এটা তার অতিরিক্ত দায়িত্ব। কান গরম হওয়া সহজ ব্যাপার নয়। কানের রং স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ঠান্ডা না হওয়া অবধি কারো সামনে যাওয়া অস্বস্তিকর। সবার আগে তখন কানটাই চোখে পড়ে। এটা কি লুকিয়ে রাখা যায়? হাত-পা ধরে টানলেও তো হয়। কানমলা না হয়ে হাতমলা বা পা মলা হতে পারতো না? তাহলে লাল হাত পা লুকিয়ে রাখা যেত। এত কথা কেন বলছি? কান থেকে কথা আরেক কানে যায়। সেই কথা বদলে যেতে যেতে আরেক কথা হয়ে যায়। এটা কি কানের দোষ? কান তো যা শুনেছে তাই শুনেছে। বাড়িয়ে বানিয়ে বললটা কে? সে তো শুধু প্যাকেট করে রাখে। খায় কে? মুখকে দোষ না দিয়ে কানকে দোষ দিলে সুবিচার হয়? শোনার জন্যে ভাবার জন্যে সে কি সাহায্য করছে না? একশো ভাগ করছে। এই উপকার গ্রহণ করে তারপর তাকেই অপরাধী করা! শুনিনি বা শুনেছি মিথ্যে করে কেন বলা? কান কিন্তু তখন বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয় না। সে ন্যায়পরায়ণ। যা হয় তাই শোনে। একটুও কম বা বেশি নয়। শোনে নিজের ঘরেই রাখে আর শুধু মনকে বলে। মন যদি ভেঙেচুরে সেটাকে পাল্টে ফেলে, কান তখন কী করবে?

এই যে কদিন আগে ভালো করে কানে শুনতে পাইনি তখন বুঝেছি- না-শোনা কী কষ্টের। ঠান্ডা লেগে, কানে পানি গিয়ে পুরো কারফিউ। একশো চুয়াল্লিশ ধারা। ডাক্তার বললেন ডাস্টবিন হয়ে গেছে। আহা ঢাকা শহরের ইজ্জত রেখেছে!

দশ দিন। এককথার অন্য জবাব দিয়েছি আন্দাজে বা ঠোঁট নড়া দেখে। না শুনে দিব্যি বসে আছি জবাব না দিয়ে। ইশ! কী ভেবেছে অন্যরা?

কত সাধ্যি সাধনা করেছি। কিছুতে কিছু হয়নি। ফোনের শব্দ শোনার জন্যে বিপরীত কান ব্যবহার করেছি। সেও তো তারই জমজ ভাই তাই না? তবু কিছুটা সাহায্য করেছে অস্বীকার করি কি করে? কানে তেল দিয়েছি। তেল মারা আমার স্বভাবে নেই। তবু কত্ত কত্ত তেল ঢেলেছি কানের পায়ে! উঁহু তার মেজাজ ঠিক হয় না। মন ভরে না। বৃষ্টিতে ভিজলে কেন? জবাবে যা বলি কোনো জবাবই তার মনঃপুত হয় না। গরম সেঁক দিয়েছি। লাভ নেই। কান গরম হয়ে যায়। তারপর ডাক্তার কবিরাজ খোঁজ খোঁজ। একজন বড় ডাক্তার বললেন, কানের বয়স বেড়ে পুরোনো হয়ে গেছে। আর আগের মতো হবে না। কান নিজের কথা নিজে এমন শুনে কেমন করে সইবে? তার দুঃখে চোখবন্ধু জল ফেলল। আরেকজনের কাছে গেলাম। বড় হাসপাতাল। তারচেয়েও বড় ডাক্তার। তিনি অফিস টাইমে নিজস্ব কাজে ব্যস্ত ছিলেন। দরজায় নক করাতে খুব বিরক্ত হলেন। বের হয়ে এমন ব্যবহার করলেন যে, মনে মনে ভাবলাম- কানে না-শোনা মঙ্গল। বাবা চক্ষুরত্ন, তোমরাও না দেখ এসব। এই সেবা সহ্য করতে কদিন সময় নিলাম। চামড়া মোটা করে আবার চললাম। সদয় হয়ে ডাক্তার জানতে চাইলেন কী সমস্যা। বললাম, ঘরে বসে অথবা রাস্তাঘাটে যখন-তখন সমুদ্রের ডাক শুনি শোঁ শোঁ। কারো কথা শুনি না। ব্যথা। কানের দরজা বন্ধ। অকারণে কানে হাত চলে যায়। নিজের হাত হোক তবু কান ধরতে কি ভালো লাগে? কান ধরা কোনো সুখের কাজ নয় নিশ্চয়। কোনো অন্যায়ও করিনি যে, এই কাজ করতে হবে।

ডাক্তার পাঠালেন যন্ত্রভর্তি ঘরে। ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল। ওরে কান, কী ঝামেলায় ফেললি আমাকে। মনে মনে কানকে ধমক দিলাম, বোঝ এবার মজা। ভেবেছো আমাকে জ্বালাবে আর আমি সয়েই যাব। এখন টের পাবে সোনার চাঁদ। বুঝবে ডাক্তার কাকে বলে। একটু মায়া হলো। তাই সান্ত¡নাও দিলাম- একটু তো সইতে হবে। ওয়ান টাইম জীবন।

ভাবছি কানের কি আরো কষ্ট বাকি? ডাক্তার কি আমার কথা শুনবেন? খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বাতাস দিয়ে কানের কলিজার ভেতর পর্যন্ত পরিষ্কার করা হলো। আমার চিৎকার তিনি কানেই তুলেন না। কান ধরে খোঁচাখুচি সেরে হাসলেন। কানের রাজত্ব শত্রুমুক্ত হলো। জিজ্ঞেস করলেন কেমন লাগছে। বললাম, দ্বিগুণ শুনতে পাচ্ছি। আগের চেয়ে বেশি শুনতে পাচ্ছি। তিনি তার চেম্বারের ঠিকানা ধরিয়ে দিলেন। পরবর্তীতে সেখানেই যেতে বললেন। আহা, মানুষ নয় গো ফেরেশতা। উঁউঁ। ভিজিটের কথা মনে করে ঢোক গিলে বলেছি, আচ্ছা। দোয়া করবেন যেন ভালো থাকি। এইবার চোয়াল কটমট। অন্য কাজে মন দিলেন। আমি লজ্জিত হলাম। ডাক্তারের কাছে ভালো থাকার দোয়া চাইলে হয়?

ঝেঁটিয়ে সব মন খারাপ দূর করে বাড়ি এলাম। ওহ, কিছু ওষধ তো আনতে হয়। এনেছি। নিয়মমতো সেবন চলছে। কানকে হাতে-পায়ে ধরছি আর বিগড়াস না বাপ। বাইরের সব শুনতে হবে কেন? সব ময়লা, পানি, ঠান্ডালাগা সব তোর দরকার? ঝামেলা ছাড়া ভালো লাগে না? যেটুকু কাজ সেটুকু করে শান্তিতে থাকিস। এই যে নানা কিসিমের কষ্ট পাচ্ছি আর তোকে বারবার ওষুধ দিয়ে বিরক্ত করছি, তোর কি ভালো লাগছে? আমার তো কেউ কানে ধরলে ভালো লাগে না।

‘ফুলের কানে ভ্রমর এসে চুপি চুপি বলে যায়।’ আমার কানে ভোমরা না-হয় না-বলুক কিছু। কানের সোনা দিয়ে না-হয় না চড়লাম কারো নৌকায়। কানের মাথা খাওয়া কারো জন্যে সুখের না। কানে ফুঁ নেওয়ারও আমার দরকার নেই। কারণ কান টানলে আমার মাথাও চলে যাবে। ওরে বাবা, কান তোর ক্ষমতা আমি টের পেয়েছি। কান নিয়ে কান্না চাই না আর। চাই না কানাকানি করার কান। কানাঘুষোও না হোক। ‘কান’ উৎসবে যেতে হবে না শুধু এক বালিশে দুই মাথা রেখে কানে-কানে কথা শুনতে পারলেই চলবে। কান সখা তোরা ভালো থাকিস।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close