ড. মুকিদ চৌধুরী
নাট্যোপন্যাস-৫
আটই ফাল্গুন
প্রথমে দৃষ্টি ফিরিয়ে আম্মার মুখমণ্ডলে রাখল, তারপর ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বলল, তুমি বড্ড তিলকে তাল করো, আম্মা। তুচ্ছ কথা নিয়ে হইচই করতে তোমার ভীষণ পছন্দ। কোন কাজটি তোমার কাছে অন্যায় বলে মনে হয় বলো তো?
ছেলের মুখে এমন স্পষ্ট ভাষায় অভিযোগ শোনার অভ্যাস নেই আম্মার; তাই হয়তো তার মুখখানা হতাশায় অসম্ভব করুণ হয়ে উঠল। তিনি জানেন, তার পুত্রবধূর পেটে বজ্জাতি আর লাগানো-ভাঙানোর স্বভাব রয়েছে, এসব শুনেও তার ছেলের মুখে কোনো দিন খই ফোটতে দেখেননি; সাত চড়েও রা করে না; কিন্তু এখন, সমস্ত পরিবেশটাই যেন এক দুঃসাহসিক স্পর্ধার জালে বাঁধা পড়ে গেল। শরিফের কথায় আম্মা প্রীত হলেন না, এবার সমস্ত সাহস বুকে সঞ্চয় করে, ভুরু কুঁচকে তীব্রস্বরে বললেন, তাহলে আমার কী করা উচিত বল? মাকে পদদলিত করে স্ত্রীর পদচুম্বন! বেশ!
আম্মার বিরক্ততিক্ত মুখভঙ্গি দেখে শরিফের অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল, মনের ভেতরে একটা গভীর অভিমানে ছায়া পড়ল, আম্মার প্রতি তার দুর্বলতা অবশ্য সম্পূর্ণ অন্য ধরনের, তাই বুকের ভেতরটা আর্দ্র হয়ে উঠল, তবে মাথার মধ্যে ঠিকই আগুন জ্বলছে, আজকাল তার মাথা যখন-তখন জ্বলে ওঠে। আম্মার দিক থেকে সে মুখ ফিরিয়ে নিল, দৃষ্টিতে ভীষণ অধৈর্য, যেন অর্ধেক ক্ষয়ে-যাওয়া আর অর্ধেক সুতোয় বাঁধা; আর তার মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মেজাজ একেবারে খাট্টা হয়ে গেছে। এই মুহূর্তে সে এই ঘর থেকে পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে, কিন্তু পারল না, বরং মা ও ছেলের মাঝখানের চেয়ারটি টেনে শব্দ করে বসল। প্রচণ্ড রাগে এবং ভয়ংকরভাবে চোখ পাকিয়ে আম্মা তার ছেলের দিকে তাকালেন, সঙ্গে সঙ্গেই শরিফ আবার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল; তারপর মাধুর্যের ঘাটতি ধারণ এবং ভুরুভঙ্গি করে নীরস গলায় বলল, কানিজ তোমার মন মতো সেবা করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
গর্জে উঠলেন আম্মা, অসন্তোষের গলায় বললেন, কেমন সেবা করছে তা আমার জানা আছে। সে এক নম্বর মিথ্যুক।
শরিফ যেন একমুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল, আম্মার এই আকস্মিক ঘোষণা সে প্রত্যাশা করেনি, মুখে অনেক ক্রুদ্ধরেখার সৃষ্টি হলো; সে যেন মাঝ দরিয়ায়, শ্বাসনালিতে ভাতের টুকরো যেন ঢুকে গেছে, শ্বাস বন্ধ, মরার দশা; কল্পনার হাতে নিজের পিঠেই যেন চাপড় দিতে থাকে, কেননা খাঁচার পাখির মতো তার মনে সৃষ্টি হয়েছে ভয়, উৎকণ্ঠা; তবু রাগে তার মুখটা একেবারে বিবর্ণ, রাগটা একেবারে পৌঁছে গেছে চরম সীমায়, তাই তীক্ষèস্বরে বলল, এই তো তুমি আবার গালমন্দ শুরু করে দিলে।
হঠাৎ আম্মা তার আরাম কেদারা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন, এই ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার অভিলাষে; কারণ, এই মুহূর্তে তার কাছে সন্তানস্নেহ বলে কিছুই নেই, জেদটাই সবচেয়ে বড়ো। আম্মার এভাবে ঘরত্যাগে শরিফের বুকের ভেতর আবেগটা হয়তো একটু উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল, তাই নিজেকে আত্মসমর্পণে নমনীয় করতে বাধ্য হল, সেও চুপি চুপি আম্মার পেছন পেছন এগিয়ে এল। আম্মা তবু রান্নাঘরের দিকে চলতে লাগলেন, আর প্রবল ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের মধ্যেও জীবনে এই প্রথম আম্মার মনে হলো যে, শরিফের দিকে ফিরে তাকিয়ে ছেলের মাথার চুলের মধ্যে আঙুল ডুবিয়ে একটু আদর করতে; তখনই তার চোখে দুই বিন্দু জল দেখা দিল, তিনি তার ছেলের দিকে ফিরে না তাকিয়েই দ্রুতগতিতে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলেন।
রান্নাঘরে আম্মার পাশে শরিফ এসে দাঁড়ালেও তিনি একবারও তার দিকে তাকালেন না, বরং ওর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে নির্লিপ্তনিরাসক্ত এবং মৌনভঙ্গিতে চায়ের কেতলিটি অন করে দিলেন। কেতলি অন করার আওয়াজটি ছাড়া সবই নির্লিপ্তনিরাসক্ত, যদিও কেতলিটি মৃদু কাঁপছে; কিন্তু শরিফের তো আর নিরাসক্তি আসে না। সে যেমন চতুর তেমনই সৎ, স্বভাবে বেশ গম্ভীর, তার চেহারায় যদিও কিছুটা রুক্ষতার ছাপ এই মুহূর্তে রয়েছে তবু চোখদুটি যেন ঘনকালো মৌনগভীর, মুখমণ্ডলে জানার অধীর আগ্রহের ভাব পরিস্ফুটিত, যদিও তা ছিন্নবৃন্ত ফুলের মতোই ক্ষণস্থায়ী; তাই হয়তো সে বলে উঠল, কানিজ আমাকে বলেছে তুমি ওকে গালমন্দ করো।
আম্মার ভুরুদ্বয় আপনা থেকেই কুঁচকে উঠল, চোখেমুখে আবারও বিরক্তির ছাপ; যদিও তার সমস্ত অবয়বে ব্যক্তিত্বের ছাপ সুস্পষ্ট এবং হৃদয়ে ছেলের প্রতি অপরিমেয় স্নেহোত্তাপ, কেননা তার পেছনেই উৎকণ্ঠিত শরিফের মুখ; আম্মার মনে হল বেহালার ছড় টানার মতো অভিমানী সুরেরই শরিফ তার কথাগুলো বলেছিল। ছেলের করুণ মুখটি ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার মনে হল, কানিজটা কে? তার মুখটি তিনি যেন দেখেছেন, খুব ভালো করেই দেখেছেন, খুব চেনা, হয়তো ওই মুখের আদল কোথায় দেখেছেন, অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছেন না এই মুহূর্তে; তাই ছেলের প্রতি বিরক্তি প্রকাশে কৃপণ না হয়ে বললেন, শোন শরিফ, এই কানিজটা কে? কোনো দিন ওর সঙ্গে দেখা হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে না।
আম্মা, তুমি জানো কানিজটা কে। আর শোনো, তোমার বিদ্রুপবাক্যে সে কেঁদেছে। শরিফের বয়স চল্লিশ, কিন্তু কথার বাঁধুনি শুনলে একুশ ভাবতে কঠিন নয় না। হবেই বা কেন, দুই পুরুষের খাস তালুক এই শহরে, যে-শহরে কৃষির কোনো চাষ খুঁজে পাওয়া যায় না, এই শহরে তো শুধু চাষ হয় কথার আর রঙিন বিজলিবাতির।
কী! বিদ্রুপবাক্য! আম্মা কাঁধ ঝাঁকালেন। তারপর যোগ করলেন, হয়তো-বা কখনো বকেছি, তাই বলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেল নাকি, যদিও এই ঘটনা সম্বন্ধে আমি অবগত নই, যদিও এমন ব্যবহার সম্পর্কে কিছুই মনে করতে পারছি। তা ছাড়া কানিজটা কে তা-ই তো আমার জানা নেই।
আম্মার ভাবভঙ্গি দেখে শরিফ কিছুই বুঝতে পারল না, অক্ষমই বটে, তাই হয়তো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিব্রতভাবে বলল, তুমি ওর ওপর হাতও তুলেছে। আর তাই সে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে।
ছেলের কথা শোনামাত্র আম্মার হাত থেকে চায়ের পেয়ালাটি মেঝেয় পতিত হলো, তারপর ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ল। চীনামাটির টুকরোর বিভীষিকা ছড়িয়ে পড়ল রান্নাঘরের দরজার চৌকাঠ পর্যন্ত।
"