আরিফ মঈনুদ্দীন
উপন্যাস (পর্ব ৪৩)
তাহারা ফিরিয়া আসিলেন
একটি বিষয় স্যার, আমি আপনার সঙ্গে আপাতত নিভৃতে কাজ করে যাব। আমাদের ভেতরের আলাপ-আলোচনা আমরা দুজনই শুধু জানব। কেননা, আমার মেয়ে আর তার মাকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে বাগে আনতে হবে। ওদের আমার সঙ্গে একমত করানোর পর বিষয়টি খোলাসা করব।
ওরা কি দেশে থেকে যেতে রাজি হবে?
স্যার হতেই হবে। আমাদের কাজটি ভালো। আমার সিদ্ধান্তটাও ভালো। আর ভালোর সঙ্গে স্বয়ং মহান আল্লাহ্ আছেন। খারাপের সঙ্গে শয়তান, যেকোনো অবস্থায় মহান আল্লাহ আমাদের বিজয়ী করবেন।
বেশ ভালো বলেছ।
জি স্যার। আমার অটুট বিশ্বাস। আমি সফল হব। আর্থিক দিকটাও আপনি চিন্তা করবেন না। আমি তো যথেষ্ট করব। তারপর কারো দান-অনুদান পেলে পেলাম। না-পেলেও সমস্যা নেই। আমার সারাজীবনের সঞ্চয় এখানে ঢেলে দেব। একটি মাত্র মেয়ে। তার জন্য তেমন আর কী লাগবে। এটাও মহান সৃষ্টিকর্তার একধরনের খেলা। আমার যদি ছেলে থাকত তাহলে হয়তো এই সফল চিন্তার ধারাবাহিকতায় একটু ছেদ পড়লেও পড়তে পারত।
তাহের মাহমুদ মুগ্ধ কণ্ঠে বললেন, শফিক তোমাকে স্বয়ং বিধাতাই পাঠিয়েছেন। আমি আল্লাহর কাছে অনেক প্রার্থনা পাঠিয়েছি। এটার একটা গতি দেখে যদি মরতে পারতাম- এ রকম। অনেকের সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছি। কিন্তু ব্যবস্থা হাচ্ছিল না। শেষে তোমার কথাও মাথায় এসেছে- হয়তো কিছু আর্থিক সাহায্য-টাহায্য। এরচেয়ে বেশি ভাবতে পারিনি। কিন্তু সব থেকে বড় যে জটিলতা তা হলো কলেজ পরিচালনা। সেখানে আমি কী করব। একটি হতাশা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কিন্তু তুমি এখন যা শোনালে তাতে যে আমি কী পরিমাণ খুশি হয়েছি- তা ভাষায় ব্যক্ত করার মতো অভিধানে কোনো শব্দ নেই। এককথায় আমি প্রীত-মুগ্ধ-অভিভূত। আরেকটি বিষয় কি তুমি ভেবে দেখেছ?
কোন বিষয় স্যার?
এই যে দেখো- ঘটনা পরম্পরা। তোমার মেয়েকে নিয়ে তুমি ভাববে- ভিনদেশি কৃষ্টি সংস্কৃতিতে বিরক্ত হবে। ওদের প্রতি এক জাতীয় ঘৃণা জন্মাবে। তারপর তুমি সিদ্ধান্ত নেবে। এগুলো সব ওপরের পরিকল্পনা, নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ?
জি স্যার। না-বোঝার কোনো কারণ নেই। কিছুদিন থেকে আমিও ভেবেছি। দেশের টাকা খরচ করে লেখাপড়া করেছি। দেশের আলো-বাতাস-পানিতে বড় হয়েছি। দেশমাতৃকার জন্য কিছুই তো করা হলো না। এবার যদি কিছু করতে পারি।
ঠিক বলেছ, শুধু কিছু না। অনেক করতে পারবে।
আচ্ছা স্যার, আজাহার স্কুলে আছে? খাওয়ার সময় ওকে ডাকবেন। একসঙ্গে খাব।
তাহের উদ্দিন বললেন, হ্যাঁ আমি খাওয়ার সময়ে থাকলে বাপ-বেটা একসঙ্গেই খাই। মজার ব্যাপার হলো, ভালোমন্দ পাক হলে আমি শুধু খেতেও মাঝে মাঝে আসি। আর যেদিন থাকব না, সেদিন ওদের জানিয়ে দিই।
আচ্ছা স্যার, আজাহার তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ত। সম্ভবত মার্কেটিংয়ে । তাই না স্যার?
হ্যাঁ। আচ্ছা তার সম্পর্কে তোমার কৌতূহল থাকাই স্বাভাবিক। বলছি শোনো ওর গল্পটা বলি। আজাহারকে এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক বানাব এটা আমার পরিকল্পনায় ছিল। যদিও তাকে কখনো বলিনি। লেখাপড়ায় সে বেশ ভালো। মাশাআল্লাহ। তার রেজাল্ট বের হলে দেখা গেল অল্পের জন্য প্লেস করতে পারেনি। রেজাল্ট হিসেবে দেখা গেল তার স্থান চতুর্থ। তিনজনকে শিক্ষক হিসেবে নিয়ে নিল। আর তাকে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমার জন্য পাঠিয়ে দিলেন। তার রেজাল্টের পরই তার সঙ্গে কথা বললাম। পিতৃভক্ত ছেলে। এটাকেই নিয়তি মেনে নিয়ে এককথায় রাজি হয়ে গেল। এখানে একটি মজার বিষয় কি খেয়াল করেছ? যদি সে প্লেস করে ফেলত তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের অপার পেয়ে যেত। তখন হয়তো আমিও তাকে হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক হওয়ার বিষয়ে বলতে পারতাম না। সে কিন্তু প্লেস করার মতোই ছেলে। কোনো-একটা কারণে রেজাল্টে একটু হেরফের হয়েছে এবং আমি মনে করি কারণটা এটাই। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতায়ালা আমার পবিত্র চাওয়া পূরণ করেছেন। তারপর তাকে ট্রিচার্স ট্রেনিং কলেজে পাঠালাম। এমএড করল। ইংরেজিতে সে বরাবরই ভালো তারপরও এক বছর ইংরেজিতে পড়ালাম। আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটে পাঠিয়ে ছয় মাসের একটি ইংরেজি কোর্স করালাম। তারপর পাক্কা প্রধান শিক্ষক বানিয়ে স্কুলে বসিয়ে দিলাম। একটা বিষয় তো তুমি ভালোই জানো। ভালো শিক্ষক না হলে ভালো ছাত্র পয়দা হবে কোত্থেকে। আমাদের দেশে দেখা যায়, ‘যার নাই কোনো গতি, সে করে পণ্ডিতি’ অবস্থা এরকম। শিক্ষকরাই লেখাপড়া জানে না- ছাত্ররা জানবে এটা আশা করি কীভাবে। আমার মতে, শিক্ষকতা পেশাকে দেশের এক নম্বর পেশা ঘোষণা করা উচিত। মানে আমলাদেরও ওপরে। অবস্থা এমন হবে যে, সব ভালো ছাত্রের আরাধ্য পেশা হবে শিক্ষকতা। সেই হিসেবে তাদের সুযোগ-সুবিধাও বলবৎ করা হবে। তখনই কেবল এদের মানুষ গড়ার কারিগর বলা যাবে।
স্যার এখানে একটা বিষয় আছে।
কী?
শফিক বললেন, বিষয় হলো। সব মানুষ প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উঠলে অশিক্ষিতরা তো আমাদের শাসন করতে পারবে না।
ওটা বলতে গেলে তো অনেক কথা। তবে একটা জায়গায় আজও এ জিনিসটা বজায় আছে। যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। ওখানে যারা প্রথম সারির তারাই শুধু শিক্ষকতার সুযোগ পায় এবং এটা ওদের আরাধ্যও বটে। এই জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সর্ব মহলেই পূজনীয় থাকেন।
শফিক বললেন, এটা স্যার ঠিক বলেছেন, আচ্ছা স্যার একটা বিষয় একটু আলাপ করি।
বলো-
আমার মেয়েটি সম্পর্কে বলি, ও লেখাপড়ায় বেশ ভালো। ও তো আর জানে না আমরা লন্ডন ফিরে যাচ্ছি না। ওর লন্ডনের লেখাপড়াও এখানে দরকার নেই। ওর কেন যেন একটা খেয়াল চাপল সে ভবিষ্যতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হবে। সাবজেক্টেও নিয়েছে ওরকম। এখন আমি চাচ্ছি আজাহার ওকে একটু লেখাপড়ায় সাহায্য করুক।
তাহের মাহমুদ বললেন, এটা কোনো সমস্যা না। সাহায্য করবে। আমি বলে দেবো। আচ্ছা আমরা খাওয়ার পর একটু কলেজ ক্যাম্পাসে যাব। তুমি দেখে আসবে। লোকেশনটা দারুণ। তোমার বেশ ভালো লাগবে।
শফিক বললেন, স্যার আমিও ওরকম ভাবছিলাম। আপনার সঙ্গে মিলে গেল।
তাহের উদ্দিন মাহমুদ যথারীতি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললেন, আমার অনেক কিছুই তোমার সঙ্গে মিলে যাবে। তুমি আমার ছাত্র না।
দুজনে কথা বলতে বলতে খাওয়ার সময় হয়ে এল। বাবুর্চি মোতাহার এসে অনুমতি চাইল- খাবার লাগিয়ে দেবে কি না।
তাহের উদ্দিন বললেন, হ্যাঁ। খাবার টেবিলে সাজিয়ে দাও। আমি যা যা বলেছি মেনু ওভাবে ঠিক আছে তো?
জি স্যার, একদম ঠিক আছে।
আচ্ছা।
বাবুর্চি তার কাজে গেল। তাহের উদ্দিন মাহমুদের চেম্বারের এক পাশে চার সিটের একটি ছোট ডাইনিং টেবিল আছে। মোতাহার এটা-ওটা নিয়ে আসছে। তাহের মাহমুদ বললেন, আজকের মেনুটা শোনো, তোমাকে বলি, দেশি কই মাছ দিয়ে আনাজ কলা। একেবারে দেশি মুরগির রেজালা। মসুরির ডাল। আরেকটি জিনিস তোমার পছন্দ হবে কি না জানি না। আমার দারুণ পছন্দ- কুমড়ার শাক মসুরির ডাল দিয়ে পাক করা হয়েছে। এই তরকারিটা আমি বললেই কেবল করে। আজ আমি বলে দিয়েছি। মুখে দিলে দেখবে খাঁটি অমৃত। পাকটা ঠিকমতো হওয়া চাই। মোতাহার রেসিপিটা ভালো জানে। আমি মাঝে মাঝে ওকে এটা করতে বলি।
স্যার আপনি এই বয়সে খেতে পারেন তো ভালোভাবে?
বলছ কী। আমি খুব খেতে পারি। মাশাআল্লাহ খেতে না-পারার রোগগুলো নেই। সবই খাই, তবে পরিমিত-পরিমাণে।
সুস্বাস্থ্যের জন্য আপনাকে অভিনন্দন।
তোমার অভিনন্দন গ্রহণ করলাম। তোমার স্বাস্থ্য কেমন?
মাশাআল্লাহ। ভালো আছি স্যার।
মোতাহার টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। তাহের উদ্দিন মাহমুদ ইন্টারকমে আজাহারকে ডাকলেন।
কল করার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আজাহার চলে এল। শফিক সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলল, আমি তো জানি আংকেল আপনি আসবেন। আমার ক্লাস ছিল তাই এতক্ষণ আসতে পারিনি।
ইটস ওকে। এখন তো এলে, একসঙ্গে লাঞ্চ করব। লাঞ্চ করতে করতে তোমার সঙ্গে কথা হবে।
তিনজন ডাইনিং টেবিলে বসেছেন। তাহের মাহমুদ ও শফিক আহমেদ একদিকে। আজাহার বসেছে দুজনের মুখোমুখি।
মোতাহার প্লেটে ভাত পরিবেশন করছে। তাহের মাহমুদ বললেন, ঠিক আছে তুমি প্রথমবার দাও। পরে আমরা যে যার মতো নিয়ে-টিয়ে খাব। তুমি কিচেনে যাও। প্রয়োজন হলে ডাকব।
শফিক আহমেদ বললেন, স্যার ঠিকই বলেছেন। আমাদের দিতে-টিতে হয় না। প্রয়োজনমতো নিয়ে নিয়ে খাব।
"