আমিরুল হাছান

  ২৯ নভেম্বর, ২০২৪

হাসসান ইবনে সাবিত

রাসুলের সভাকবি

হাসসান ইবনে সাবিত। একজন আরবি কবি। নবীজি (সা.) তাকে অনেক ভালোবাসতেন। ভালোবেসে সভাকবির আসনে বসিয়েছেন। ‘আস সুবুহু বাদাম্মিন তালা আতিহি’র মতো অমর নাত ও অসংখ্য অপ্রতুল কবিতার জনক কবি হাসসান ইবনে সাবিত। তিনি ৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় জন্মগ্রহণ করেন। বনুখাজরাজ গোত্রের উত্তরসুরী এই মহান সাধক ছিলেন একজন শব্দযোদ্ধা। তিনি রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে বেশ কিছু জিহাদে অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধের ময়দানে কবি কী করবেন? এমন ভাবনা যাদের, তাদের বলছি- হাসসান ইবনে সাবিতের কবিতা তলোয়ারের চেয়ে কম নয়। বিধর্মীদের উচ্ছৃঙ্খল কথার জবাবে তিনি কবিতার বর্শা নিক্ষেপ করতেন। তাতেই ইসলামের শত্রুদের মুখ বন্ধ হয়ে যেত। অন্যদিকে সাহাবা যোদ্ধাদের জন্যে তার কবিতা ছিল সাহসের পারদ। মুজাহিদরা তার যুদ্ধগাঁথায় উদ্ধুদ্ধ হয়ে বীরদর্পে এগিয়ে যেতেন। আর শত্রুদের জাহান্নামে পাঠাতেন।

কবিরা ভ্রমণপিপাসু হবেন, এটাই স্বাভাবিক। হাসসান ইবনে সাবিত তো জাতকবি। তিনিও যৌবনের কিশতিতে তারুণ্যের পাল তুলে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করেছেন। আলহিরাহ, দামেস্ক ও প্রাচীন আরবের জিল্লাক নগরী ছিল তার ভ্রমণের জন্যে প্রিয় জায়গা। হিরার রাজপ্রসাদেও যাতায়াত ছিল এই কবির। তবে গাস্কনীয় সম্রাটদের প্রতি দুর্বলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। কবির সঙ্গে সেই সম্রাটদেরও সখ্য ছিল।

হাসসান ইবনে সাবিত, শৈশব থেকেই কবি হিসেবে পরিচিত। কবিতাকেই করেছেন রুটিরুজির মাধ্যম। প্রাক-ইসলামি যুগে যেসব আরবভূমিতে রাজত্ব করেছেন। কাব্য প্রতিভায় সম্মানের আসন অলঙ্কৃত করেছেন, হাসসান ইবনে সাবিত তাদের মধ্যে অন্যতম।

মদিনায় ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নেই তিনি ইসলাম কবুল করেন। ইসলামের শীতল ছায়ায় সিক্ত হন। তখন তার বয়স ছিল ষাট বছর। ইবনে সাদ বর্ণনা করেন, ‘তিনি ষাট বছর জাহিলিয়াতের কবি ছিলেন এবং পরবর্তীকালে ষাট বছর ছিলেন ইসলামের কবি।’

হাসসান ইবনে সাবিত, বয়সে যদিও বড় ছিলেন কিন্তু চিন্তা-চেতনায়, ক্ষুরধার কাব্যপ্রতিভায় সিংহের মতোই শক্তিশালী ছিলেন। তিনি দুই হাজারেরও বেশি ব্যাঙ্গ কবিতা ও উপাখ্যান লিখেছেন। তিন থেকে বিশ লাইনের কবিতা লিখেছেন এক হাজারেরও বেশি। নবীজিকে নিবেদিত অসামান্য কবিতা লিখে উপাধি পেয়েছেন ‘শায়িরুর রাসুল’।

নবীজিকে জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন। ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ তার একটি বিখ্যাত কবিতার নাম ‘তোমার তারিফ’। কবি হাসসান ইবনে সাবিত লিখেছেন- ‘তোমার চোখের মতো ভালো চোখ পৃথিবীতে নেই/এবং কোনো মাতা এমন সুন্দর পুত্র আর/প্রসব করেনি বিশ্বের কোথাও।’

হাসসান বিন সাবিতের কবিতার একটি অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো, কবিতায় পবিত্র কোরআনের বাক্যাংশ ব্যবহার করা। নবীজি তার কবিতা মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। মসজিদে নববিতে তার জন্যে আলাদা একটা মিম্বারও তৈরি করা হয়েছিল। কবি সেই মিম্বারে দাঁড়িয়ে মুনাফিক, কাফিরদের নিন্দাসূচক কাব্যের জবাব দিতেন। কখনো কখনো স্বয়ং নবীজি বলতেন, ‘হে হাসসান ইবনে সাবিত, আমার পক্ষ থেকে উত্তর দাও।’

এখানে স্পষ্ট প্রতিয়মান যে, রুচিশীল এবং সঠিক বাক্যের কবিতাকে নবীজি পছন্দ করতেন। তিনি সাবিতের জন্য আলাদা করে দোয়া করতেন। হাসসান বিন সাবিত (রা.)-এর কবিতা শুনে রাসুল (সা.) ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘হে হাসসান! আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার জন্য পুরস্কার জান্নাত।’

কবিদের মাঝে পৃথিবীতে জীবিত অবস্থায় রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে জান্নাতের বার্তা পাওয়া একমাত্র কবি তিনিই।

রাসুল (সা.) একবার হাসসানকে জিজ্ঞাস করলেন আবুবকরকে নিয়ে কোনো কবিতা লিখেছো? কবি বললেন, হ্যাঁ আল্লাহর রাসুল, লিখেছি। নবীজি বললেন, শোনাও। হাসসান ইবনে সাবিদ কবিতা শোনান। সেই কবিতাটি ছিল এমন- ‘রাসুলের সাথে আছেন সদা এক ছায়াতরু/সবাই জানে নবীর পর/ তিনি সৃষ্টির মাঝে সবার সেরা।’ কবিতা শুনে রাসুল (সা.) বললেন, ‘সাবিত, তুমি সতি?্যই লিখেছো এবং যা বলেছো, আবুবকর তার যোগ্য।

হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, কখনো কখনো নবীজি সবাইকে শুনিয়ে বলতেন, ‘হাসসানের জিহ্বা যতদিন রাসুলের পক্ষ হয়ে কবিতার বাণী শুনিয়ে যাবে, ততদিন তার সঙ্গে জিবরাঈল (আ.) থাকবেন।

আল্লাহ প্রদত্ত কাব্যপ্রতিভার শোকর জ্ঞাপন করে হাসসান ইবনে সাবিত বলতেন, ‘আমি যদি আমার জিহ্বার আগা (কবিতার লাইন) কারো মাথার ওপর রাখি, তাহলে সে মাথা ন্যাড়া হয়ে যাবে। আর যদি কোনো পাথরের ওপর রাখি, তাহলে তা বিদীর্ণ হয়ে যাবে।

আরবীয় কবিতায় কবিদের চারটি স্তর। যেমন- ১. জাহেলি বা প্রাক ইসলাম যুগের কবি। ২. মুখাদরাম অর্থাৎ যেসব কবি জাহেলি ও ইসলামি উভয় কাল পেয়েছেন। ৩. ইসলামি, যারা ইসলামের অভ্যুদয়ের পর জন্মগ্রহণ করেন বা কবি হয়েছেন। ৪. মহদাস আব্বাসি বা পরবর্তীকালে কবি।

হাসসান ইবনে সাবিত ছিলেন দ্বিতীয় স্তরের কবি। তিনি জাহেলি ও ইসলাম উভয়কাল পেয়েছিলেন। হজরত আবু উবায়দাহ বলেন, ‘তিনি জাহেলি আমলে আনসারদের কবি এবং রাসুল্লাহ সা.-এর নবুয়তের সময় শায়িরুর রাসুল। নবীজির ওফাতের পর সাবিত লিখেছিলেন- ‘তুমি ছিলে আমার নয়নের মনি/তোমার মৃতুতে আমি অন্ধ হয়ে গেছি/এখন অন্য কারো মৃত্যুতে আমার প্রতিক্রিয়াই হবে না।’

কবি হাসসান ইবনে সাবিত শেষ জীবনে ঠিকই অন্ধ হয়ে যান। আবদুল কাহির আল জুরজানি বলেন, হাসসানের রচিত কবিতায় সব পদের মধ্যে একটা সুদৃঢ় ঐক্য ও বন্ধন দেখা যায়। এমন কি সম্পূর্ণ বাক্যকে একটি দৃঢ় শক্তিশালী রশি বলে মনে হয়। কবি ও কবিতা পৃথিবীর সৃষ্টির শুরু থেকেই কালের মহান স্বাক্ষী। হাসসান ইবনে সাবিত কাব্যাকাশের ধ্রুবতারা।

হাসসান ইবনে সাবিত মূলত প্রতিবাদী কবি ছিলেন। তার কবিতায় ইসলাম ও মানবতার শত্রুদের বিপক্ষে যেমন ক্ষুরধার শব্দ ছিল, তেমনি ছিল রাসুলপ্রেমের বস্রায়ী গোলাপ। তিনি প্রথম জীবনে রাজ বংশীয়দের প্রশংসনীয় কবিতা লিখেছেন।

কবির বাবা এবং দাদা উভয়ই কবি ছিলেন। তার ছেলে আবদুর রহমান নাতি আবু সাঈদও কাব্যচর্চা করতেন। তার পরিবারে শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়মিত আলোচনা হতো। রাসুলের প্রিয় সাহাবা, প্রিয় কবি হাসসান ইবনে সাবিত সব সাহাবার প্রিয়জন ছিলেন। ইসলাম গ্রহণের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কবিতার মাধ্যমে ইসলামের খেদমত করে গেছেন। তিনি হজরত মুয়াবিয়া (রা.)-এর খিলাফতকালে ৫৪ হিজরিতে ১২০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close