আরিফ মঈনুদ্দীন
উপন্যাস (পর্ব ৪২)
তাহারা ফিরিয়া আসিলেন
স্কুল ক্যাম্পাসে ঢুকেই শফিকের মনটা কেমন উদাস উদাস হয়ে গেল। এক রকমের ভালোলাগা তাকে টেনে নিয়ে গেল অতীতের সেই দিনগুলোয়। আহারে যদি একবার ওই দিনে যাওয়া যেত। নামকরা ছাত্র হিসেবে তার কী কদর! ভাবাই যায় না- একটি ছাত্র- এত ভালোবাসা-স্নেহ-সম্মান পেত? ভাবতে ভাবতে সে চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয়। স্কুল ভবনগুলো আগের চেয়ে অনেক সুন্দর হয়েছে। তিন দিকে দালান সামনে প্রশস্ত মাঠ। মাঠ বরাবর সামনে ধুধু প্রান্তর। প্রান্তরের শেষ প্রান্তে স্কুল ঘরের মতো কী-একটা দেখা যাচ্ছে। তারপর গ্রাম। দৃশ্যটা সুন্দরই বটে! চারদিক দেখে-টেখে তাহের উদ্দিন স্যারের চেম্বার খুঁজে বের করলেন। চেম্বারের দরজায় দাঁড়াতেই তাহের মাহমুদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। তিনি যথারীতি দাঁড়িয়ে বললেন, আসো আসো। আমি তোমার জন্যই অপেক্ষা করছি।
শফিক সালাম দিয়ে এগিয়ে গেলেন।
তাহের মাহমুদ চেয়ারে বসতে বসতে সামনের চেয়ার দেখিয়ে বললেন, বসো বসো। চা খাবে? আগে এককাপ চা খাও। যদিও তোমার বাসার মতো হবে না, তারপরও খাও।
ব্যক্তিগত পিয়ন সালামতকে ডেকে চায়ের কথা বললেন।
দুজন দুকাপ চা নিয়ে বসেছেন। তাহের মাহমুদ বললেন, আচ্ছা এবার বলো। তোমার সার্বিক খবর কী?
প্রফেসর শফিক আহমেদ একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস গোপন করে বললেন, সার্বিক খবরই আপনাকে বলব। তার আগে বলুন তো স্যার স্কুলের মাঠ বরাবর সম্মুখের প্রান্তরের শেষ মাথায় স্কুলঘর-টাইপ লম্বা একটি ঘর দেখলাম। ওটা কী?
তাহের মাহমুদ যে আলাপটি করার জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, প্রফেসর শফিক সরাসরি ওদিকেই যাচ্ছেন বুঝতে পেরে তাহের সাহেবের চেহারার ঔজ্জ্বল্য বেড়ে গেছে। তিনি ঠোঁটে হাসি জাগিয়ে বললেন, ওটাই তো তোমার সঙ্গে আলাপ করব।
শফিক সাহেব কৌতূহলী চোখে তাহের সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক তাই স্যার?
তবে আর বলছি কী? শোনো ওটা হলো সুন্দলপুর কলেজ। এটা এখন একটি নামসর্বস্ব প্রতিষ্ঠান। ওই পাড়ার মোকসেদ ব্যাপারীর ছেলে মফিজুর রহমান থাকতেন আমেরিকায়। ওখানে ব্যবসা-বাণিজ্য করে বেশ পয়সাকড়ি করেছেন। একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা ছিল তার স্বপ্ন। তার স্বপ্নটার আরেকটু ব্যাখ্যা করি। মফিজুর রহমানের বাবা মোকসেদ ব্যাপারী ছিলেন মেট্রিক পাস। তৎকালে এই এলাকায় কোনো কলেজ ছিল না। যার জন্য তিনি আর পড়তে পারেননি। তাই তিনি মফিজকে অনুরোধ করে গিয়েছেন যদি সামর্থ্যবান হতে পারে তাহলে যেন এই এলাকায় একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। তখন থেকে মফিজুর রহমান এই স্বপ্ন লালন করে আসছিলেন। যখন সামর্থ্যবান হলেন তখন আর দেরি করলেন না। আমেরিকা থেকে এসে আমার সঙ্গে পরামর্শ করলেন। আমিও যারপরনাই উৎসাহ দিলাম। ওখানে তার নিজের কিছু জায়গা ছিল তার সঙ্গে মিলিয়ে আরো কিছু কিনে পাঁচ বিঘার একটি প্লট করলেন। তারপর কর্মযজ্ঞ শুরু করলেন। জায়গা ভরাট করে আপাতত আধাপাকা অর্থাৎ ওপরে টিনের ছাউনি দিয়ে লম্বা একটি এল-টাইপ দালান দাঁড় করালেন। আর অফিসঘরের জন্য ফাউন্ডেশন দিয়ে চারতলার পরিকল্পনা করলেন একতলার কাজ প্রায় শেষ। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো- ভদ্রলোক হঠাৎ না-ফেরার দেশে চলে গেলেন। তার মৃত্যুর পর আমি আমেরিকায় যোগাযোগ করেছিলাম তার ছেলেমেয়েরা এতে কোনো উৎসাহ দেখাল না। বলল, আমরা এ ব্যাপারে আর মাথা ঘামাচ্ছি না। দেশেও আমাদের আশার কোনো পরিকল্পনা নাই। আপনার কথা বাবা আমাকে বলেছেন। ওখানের জায়গাটি তো তিনি কলেজের নামে দিয়ে গেছেন আপনি পারলে বাকি কাজ করেন। তা না হলে আমরা এ ব্যাপারে কিছু করতে পারব না। আমি উৎসাহ নিয়ে আলাপ করতে চাইলাম- ছেলেটি বলল, এ বিষয়ে আমি আর কোনো কথা বলে সময় নষ্ট করতে চাচ্ছি না। আমি বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হলেও আর কথা বাড়ানোর রুচি খুঁজে পেলাম না। এখন আমি তোমার সঙ্গে কী কথা আলাপ করব তা তো বুঝেই ফেলেছ। আমি...
তাহের উদ্দিন কথা শেষ করার আগেই শফিক বললেন, আমি বুঝেছি স্যার। এখন মফিজ সাহেবের বাপের অছিয়ত এবং তার স্বপ্নের সঙ্গে আপনার স্বপ্নও যুক্ত হয়েছে।
তাহের উদ্দিন সতৃপ্ত কণ্ঠে বললেন, একেবারেই ঠিক বলেছ। তুমি আমাকে কীভাবে সাহায্য করতে পারো চিন্তা করে দেখো। তুমি বুদ্ধিমান মানুষ। আলেকমান্দকা ইশারাই কাফি।
প্রফেসর শফিক সাহেবের ভেতরের উত্তেজনা চোখেমুখে ফেটে পড়ছে। তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাহের স্যারের কথা শুনেছেন। শুনতে শুনতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজের ভেতরে প্ল্যান তৈরি হয়ে গেছে। তিনি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললেন, স্যার আমি অবাক হয়ে ভাবছি- প্রকৃতি কী সুন্দর খেলা খেলে! হিসেব-নিকেশ করে আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছে। আমার ভেতরে আনন্দের বন্যা বয়ে যাচ্ছে।
তাহের মাহমুদ বললেন, তোমার কথায় বেশ রহস্য আছে বলে মনে হচ্ছে। তুমি এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করবে এটাও বুঝলাম। কিন্তু তোমার উচ্ছ্বাস-আনন্দে আরো কিছু যেন আছে। কী, আমি ঠিক বলেছি?
আনন্দে শফিক সাহেবের চোখে পানি এসে যাওয়ার অবস্থা। তিনি বললেন, আপনি স্যার ঠিকই অনুমান করেছেন। আমি এমন কিছু আপনাকে এখন শোনাব যা আপনার মনেও আনন্দের জোয়ার বইয়ে দেবে।
তাহের উদ্দিন মাহমুদ অবাক হয়ে তাড়া দিয়ে ঠোঁটের হাসিকে আরও প্রলম্বিত করে বললেন, তাহলে বলো বলো আর তো দেরি সইছে না।
শফিক সাহেব বললেন, আপনি শুধু আমার আর্থিক সাহায্য নয়- অনেক বড় অংশগ্রহণও বলতে পারেন। আমার সত্যি গল্পটা এবার শুনুন... একটি কথা স্যার, আমি এখন আপনার সঙ্গে যা বলব তা শুধু আপনি এবং আমার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকবে এটা আর কাউকে আপাতত জানানো যাবে না। কেন জানানো যাবে না- তা অবিশ্যি কথা বলার পরে আপনি নিজেও বুঝতে পারবেন। আমি কিন্তু স্যার এবার লন্ডন থেকে একেবারে চলে এসেছি।
তাহের উদ্দিন বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, বলো কী!
জি, বলছি স্যার। শুনুন...
প্রফেসর শফিক সাহেবের চলে আসার পেছনের পুরো গল্পটা রেখে ঢেকে যতটুকু বলা যায়- লন্ডনের পারিবারিক জীবন ও ছেলেমেয়েদের চলাফেরা বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা দিলেন। নিজের বিতৃষ্ণার কথা। বোধ-বুদ্ধি-বিবেচনার কথা। সবকিছু বলার পর দম নেওয়ার ভঙ্গিতে একটু থামলেন। সম্মুখে রাখা গ্লাস থেকে একটু পানি খেলেন।
তাহের উদ্দিন মাহমুদের বিস্ময়ের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলল, শফিকের গল্পের চেয়েও বেশি হলো এই কারণে যে, তিনি এই বিশাল কর্মযজ্ঞ নিয়ে যেখানে থেমে আছেন। সেখান থেকে একটি ঝলমলে শুরুর জন্য সৃষ্টিকর্তা কী চমৎকার ব্যবস্থাই-না করে দিলেন! তার ভাবনায় বিষয়টি আরও তৃপ্তিদায়ক মনে হচ্ছে। সেটি হলো, কলেজ প্রতিষ্ঠাই তো শেষ কথা না, এর পুরো পরিচালনায় দায়িত্ব একজনকে দিতে হবে। মানে একজন অধ্যক্ষ লাগবে, শফিক তো সবদিক থেকেই উপযুক্ত। দেখা যাক... ভেবেটেবে নিয়ে তিনি বললেন, তারপর বলো।
আমি ভাবছি আপনার মতো থাকলে আমি কলেজের দায়িত্ব নিয়ে নেব।
কী বলছো তুমি! আমি তো নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না। আমিও হুবহু তোমার মতো করেই ভাবছি। তুমিই কলেজের প্রিন্সিপাল। কমিটির মূল দায়িত্বে আছি আমি। মানে সভাপতি। আর যারা আছেন তারা সবাই আমার ওপর আস্থাশীল। আমি যা করব, সবাই তা স্বেচ্ছায় মেনে নেবেন। আমি তো খারাপ কিছু করবই না- এটা তারা শতভাগ নিশ্চিত।
"