শাকিলা নাছরিন পাপিয়া
জীবন এত দীর্ঘ কেন?
আমি মৃত্তিকা। সর্বংসহা ধরণীর মতো লক্ষ্মী মেয়ে। এই যে সকালবেলা কলম খুঁজতে গিয়ে একটা লম্বা চওড়া মাঝারি ওজনের চড় আমার স্বামী ফর্সা গালে বসিয়ে দিলেন, তাতে কিছু মনে করিনি।
বরং গালে হাত বুলাতে বুলাতে, ছলছল চোখে হাসিমুখে তাকে দেখিয়ে দিলাম- কলমটা তার পকেটে। ছোট্ট একটা সরি উচ্চারণ করে তিনি চলে গেলেন। আমিও কাজে মন দিলাম।
বিছানার ওপর হাত-পা নেড়ে তিন মাসের ছোট্ট যে মেয়েটি খেলছে, সে আমার মেয়ে চেতনা।
ওর জন্মে এ বাড়ির কেউ খুশি হয়নি।
প্রথম সন্তান ছেলে হবে, বৃদ্ধ বয়সে বাবার সংসারের হাল ধরবে,
বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। এ প্রত্যাশা ছিল কায়েসের পরিবারের।
অবশেষে আঙুর ফল টকের মতো কায়েস বলেছে, প্রথম সন্তান কন্যা হয় ভাগ্যবানের।
পরেরটা কিন্তু ছেলে চাই।
আমি খুব লক্ষ্মী বউ।
আমার চেতনা নামটি হিন্দু নাম বলে সবাই যখন বাতিল করল, আমি তখন একটুও প্রতিবাদ করিনি। এমনিতেই আমার নাম নিয়ে কত অভিযোগ!
চেতনার বাবা ফিরতে ফিরতে রাত ১২টা।
ঘুমে ঢুলু ঢুলু চোখে অপেক্ষা করি।
প্রতিদিনই রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে ঘরে ফিরে কায়েস। আগে ওর অশ্লীল বাক্যে অবাক হতাম। এখন হই না। খেতে বসে কোনো তরকারীই পছন্দ হয় না।
এক্ষেত্রেও রাগারাগিতে কিছু মনে করি না।
আসলে সময়টাই সব।
সময়ে একদিন সব ঠিক হয়ে যায়।
যে যত মেনে নিতে পারে, সে ততটাই লক্ষ্মী মেয়ে।
এভাবে এক দিন সবকিছু মেনে নেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করব বলেই হয়ত বাবা নাম রেখেছিলেন মৃত্তিকা।
দুই.
পূর্ণিমার চাঁদ, জোছনার প্লাবন আমার নয়। বিড়বিড় করে নিজেকে বলি। অন্ধকারে স্পষ্ট হয় যে মুখটি, তাকে মুছে ফেলতে চাই প্রাণপনে।
তবু সে স্পষ্ট হয়। তার নিঃশ্বাস অনুভব করি ঘাড়ে। অদৃশ্য স্পর্শে আমি রোমাঞ্চিত হই। কানের কাছে ফিসফিস শব্দ ‘বউ, আমার লক্ষ্মী বউ’।
আচমকা ভুলে যাই অন্ধকার ঘর, স্বামী, সন্তান সব। এখন দাঁড়িয়ে পুকুর ঘাটে, চাঁদের রহস্যময় আলোয় এক বলিষ্ঠ বাহুর বন্ধনে। যার বলিষ্ঠ বাহু আমায় সাহস জোগায়, যার বিস্তৃত বক্ষ আমায় আশ্রয় দেয়, যার স্পর্শ আমায় জগৎ সংসার ভুলিয়ে দেয়। আমার মাঝে জেগে ওঠে অন্য এক আমি।
হঠাৎ চেতনা কেঁদে ওঠে। আমি চমকে তাকাই। নিজেকে আবিষ্কার করি কায়েসের বুকের মাঝে। শীতল হয়ে যাই সহসাই। কায়েস বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, ধাৎ।
আমি পাথর হয়ে তাকিয়ে থাকি চেতনার দিকে। আমার ছোট্ট মেয়ে চেতনা। কায়েস পাশ ফিরে শুতে শুতে বলে, কী যে হয় তোমার বুঝি না। মুহূর্তেই পাল্টে যাও।
ঘোরলাগা দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকি। কোথায় আছি হঠাৎ বুঝতে পারি না।
শূন্য বুকে হাহাকার করে ওঠে। মেয়েকে চেপে ধরি বুকের মাঝে। দুচোখের প্লাবনে আমার রাজকন্যা ভিজে যাচ্ছে।
আমি ফিসফিস করে নিজেকেই বলছি, এত বড় একটা জীবন আমি কী করে পাড়ি দেব?
তিন.
চমৎকার গান গাইত জামিল। গ্রামের এক বিয়ে বাড়ির অনুষ্ঠানে গান শুনেই প্রেমে পড়ে গেলাম তার।
এক কান দুই কান করে অভিভাবকদের কানে পৌঁছে গেল খবর।
দুই পরিবারই শেষ পর্যন্ত সম্পর্কটা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল।
আমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলে বিয়ে।
জামিলের অনার্স শেষ। ঢাকা ইউনিভার্সিটির হলে থাকে তখনো।
স্বৈরশাসক এরশাদের শেষ সময়। উত্তাল ঢাকা শহর।
জামিলের কথা শুনতাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। চোখে স্বপ্ন আর বুকে আগুন। গণসংগীত গেয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরত ওদের সাংস্কৃতিক দলটি। গানের মধ্যে ছিল আগুন আর মুক্তির কথা।
জামিল তখন এমনভাবে কথা বলতো, মনে হতো এই স্বৈরশাসকের পতনের পরই সব সমস্যার সমাধান।
গণতন্ত্র আসবে। মুক্তি আসবে। আসবে বৈষম্যহীন সমাজ।
আমি তাকিয়ে থাকতাম ওর মুখের দিকে। পৃথিবীর কোনো ভয়ই যেন স্পর্শ করত না তখন।
আমি বসেছিলাম পুকুর ঘাটে। মন খারাপ। ঢাকা শহর উত্তাল। জামিল প্রায় এক মাস হয়ে গেল গ্রামে আসে না। চিঠি লিখেছে।
আমি একাত্তর দেখিনি। দেখেছি ৯০-এর আন্দোলন। অপেক্ষায় কেটে যায় সময়। আতঙ্কে কাটে সময়।
জামিল এলো ঢাকা থেকে। পুরো গ্রাম এলো সঙ্গে।
কফিনে এসেছিল জামিল।
শেষ পর্যন্ত কী হয়েছিল মনে নেই। পুরো একটা বছরের কোনো স্মৃতি মনে ছিল না।
চার.
আকাশে বিশাল একখানা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে পৃথিবী। বড় বড় অট্টালিকার ফাঁক দিয়ে একটুকরো আকাশ।
ঢাকা শহরে না আছে আকাশ, না জোছনা।
মন কেমন করা এই জোছনায় দরজা খুলে চলে যেতে মন চায় দূরে বহু দূরে।
একই চাঁদ। তবু শহর আর গ্রামে তার চেহারা আলাদা।
গ্রামের মেঠোপথ, শস্যখেত, সবুজ গাছে চাঁদের আলোর মায়াবী রূপ।
ঘরছাড়া জোছনা ডাকে। সব ছেড়ে সিদ্ধার্থের মতো দেশান্তর হতে মন চায়।
আকাশে আছেন তিনি। যিনি তাকিয়ে আছেন আমার পানে।
বিড়বিড় করে তাকে বলি, আরো কতদিন বাকি?
এক মিথ্যাবাদী আমায় বলেছিল, স্বৈরশাসকের পতনের পরই ঘুচবে আঁধার। আলোর স্বপ্ন দেখিয়ে নিজেই সে হারাল গাঢ় অন্ধকারে।
আমি দীর্ঘ এক জীবনের হাহাকার নিয়ে বসে থাকি মুক্তির অপেক্ষায়।
জীবনের পথ এত দীর্ঘ কেন?
"