ড. মুকিদ চৌধুরী
নাট্যোপন্যাস-৩
আটই ফাল্গুন
শরিফ আজ তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছে, যদিও সূর্য ক্রমে পশ্চিম দিগন্তে ঢলে পড়েছে আর আকাশ ক্রমেই মুক্তো ফলের ছায়াবৎ ধূসর রং ধারণ করেছে; বাগানের ফুলগুলো বাতাসকেই অভিনন্দন জানাচ্ছে। এই এমন এক নীরব, নিস্পন্দন মুহূর্তে, যদিও সারা প্রকৃতি জুড়ে এক দুর্লভ সৌন্দর্য বিরাজ করছে, তবু শরিফ আম্মা আম্মা উথাল শব্দে বাড়ি কাঁপাছে। শরিফের মাথায় হাজার দুশ্চিন্তা।
একসময় সন্ধ্যা নেমে আসবে, তারই অল্পকাল গত হলে বিজলিবাতি তার হলুদপ্রভাব বিস্তার করবে, পুনর্বার মানুষ রাত্রির উষ্ণতায় নিজেকে নিমজ্জিত করবে। ক্রমেই ঘন অন্ধকারে ছেঁয়ে যাবে আকাশ; আর অনতিদূরে শীর্ণ পাহাড়ি পথের ধারে, তরল মৃত্তিকা যেখানে, তারই পাশে দণ্ডায়মান বৃক্ষরাজিতে মাঝেমধ্যে বায়ু অনর্গল উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠবে; এরই তটে ছোট্ট শহরতলীতে বিবশ আর উদ্বিগ্ন ক্ষুদ্র এক জনগোষ্ঠী আশ্রয় নিয়ে বিনিদ্র সময় ব্যয় করবে; যদিও এই জনগোষ্ঠীর একদলের কোনো অস্বাভাবিক ভাব নেই, প্রতিবিম্ব নেই; শুধু বাস্তবতাই তাদের অস্তিত্ব; ওদের বিশ্বাস প্রতিটি মুহূর্তই বাস্তবতা ভিন্ন অপ্রাকৃতিক প্রকৃতি কিংবা অপ্রাকৃতিক পার্থিব বিষয়গুলো- নিষ্ক্রান্ত, নিশ্চল, বিমূঢ়; ওরা প্রত্যেকেই যেন জ্ঞানদীপ্তিতে আলোকিত; আর অন্যদল নির্বোধ-অজ্ঞান-মুর্খ; তারাই ভাগ্যদেবতাকে নির্ভর করে বেঁচে রয়েছে; তাদের ধারণা যে, চির অন্ধকারাচ্ছন্ন অবরুদ্ধ জীবন ভাগ্যদেবতাই নব্যালোধারায় প্লাবিত করবে, তখন তাদের কষ্ট ও শূন্য জীবন বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। ফলে এই দুই গোষ্ঠী নিয়ে যে শহরতলী, তা একদিকে নশ্বর-ক্ষয়শীল-ভঙ্গুর আর অন্যদিকে অনশ্বর-অবিনাশী-অভঙ্গুর। যেহেতু এই শহরতলীর মানুষগুলো মৃন্ময় আর অনিত্য, তাই তাদের কারো কারো মন চৈত্ররুক্ষ-অগণন অন্ধকারে আচ্ছন্ন। এও সত্য যে, এই শহরতলীর মতোই এর সমস্ত প্রাণীও গতিহীন আর গতিশীল, স্থাবর আর জঙ্গম; ফলে সুখ কিংবা দুঃখে কোমল নিষাদ, মাত্রা নেই হাস্যরসে কিংবা করুণরসে- সকলই নিক্ষত্রা। এসব প্রাণীর ভিড়ে- এই অগণিত বহুর মধ্যে একজন হচ্ছেন আম্মা; তিনি চক্ষুহীন, জিভহীন বিরাট শূন্যতায় ও অব্যক্ত বার্ধক্যের মহাব্যোমে জর্জরিত। আম্মা অতীব প্রাচীন হলেও একটি অধুনা আরাম কেদারায় বসে আছেন এবং একটু আগে আটই ফাল্গুনের প্রত্যেকটি ঘটনা তার চোখের ওপর ভেসে ওঠে, এই ঘরের আবছা আলো-আঁধারি পরিবেশেও তার মনে পড়ে আটই ফাল্গুনের কথা- কেন মনে পড়ে, কেন তিনি সবকিছু ভুলে যেতে পারেন না; না পারা যায় না, আটই ফাল্গুন এখনো তাকে ছোবল মারে, তাকে তিনি ভুলতে পারেন না, হারিয়ে যেতেও না, আটই ফাল্গুন অতীত নয়, স্বপ্ন নয়, কেবলই বর্তমান; আটই ফাল্গুনের কথা আম্মা যতই মনে করেন ততই রক্তাক্ত হন, এক হাঁটু রক্ত জমে ওঠে তার মনে; কিন্তু এখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ, আত্মতুষ্ট, তার নিষ্পলক চক্ষুদ্বয় সেলাইয়ের সুচে আঁটকানো, স্থির- কেননা তার মধ্যে তিলেক পরিমাণ চাঞ্চল্য নেই, শুধু হিমেল বায়ুর ছলাৎ মাঝেমধ্যে তার শীর্ণ পদদ্বয়ে আঘাত করে। অন্তবন্ত, অন্তরঙ্গ দেহে যে বৈরাগ্য আনার পক্ষে যথেষ্ট এবং অঢেল, তা আম্মার শরীর পরিদৃশ্যে সত্য বলে প্রমাণিত হয়। চোখের ওপর কপালের পাশটায় মাঝেমধ্যে হিমেল বাতাসের স্পর্শে কিঞ্চিৎ কুঞ্চিত হয়ে ওঠে; নিশ্বাসে-প্রশ্বাসে ফুলে ওঠে শুধু নাসিকা গহ্বর; বিশুষ্ক চামড়াবরণের কঙ্কালসম মুখমণ্ডলটি যেন দেয়ালে ধাক্কা খাওয়া বিজলির দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়; তার দিকে তাকালেই সম্যক উপলব্ধি হয়, অর্থাৎ মুখমণ্ডল দর্শনে, স্নায়ু শুষ্ক পাতার মতো মৃদুমন্দ কেঁপে উঠছে; একসময় মানসপটে যে-স্মৃতি উদ্বেলিত ছিল, এবং তা অনুধাবনে বিনয়ী হতে গিয়ে অহংকারী হয়ে উঠতেন- এখন তা ভগ্নাংশ মাত্র; মন যেন বিতৃষ্ণার অতলে, তবু বিরূপাচরণের জন্য তার মনে কোনো উদ্বেগ নেই; বরং একের-পর-এক দীর্ঘশ্বাস পরিত্যাগ করে- প্রতিটি দীর্ঘশ্বাসই যেন দীর্ঘতম জীবনের শেষ পরিণতি এবং জীবনযুদ্ধে পরাজিত হওয়ার মানাভিমান- একমনে সেলাই করে চলেছেন। আম্মার প্রবীণদেহে ঠিকই উদ্ভাসিত- এলোমেলো, হিজিবিজি- কালের নিষ্ঠুর ক্ষতচিহ্ন আর অসংখ্য ঘুণাক্ষর। মনে হয়, এই শরীরে পাপ বা পুণ্য করার যোগ্যতা আর আর নেই। আর তাই হয়তো তার চক্ষুদ্বয় ভাববর্ণহীন, যদিও কখনো ক্লান্তিতে নিমীলিত হয়; আবার যখন সঙ্গোপনে অব্যক্তের লীলাসহচরী সৃষ্টির বীজ সঞ্চয়ের বাসনায় জাগ্রত হয়ে ওঠে, তখন এই জাগ্রত চক্ষুদ্বয়ে সেলাই করে যাচ্ছেন একমনে আর তখন তার ওষ্ঠদ্বয় কখনো বিচ্ছিন্ন, কখনো-বা একত্রিত হয়; যখন বিচ্ছিন্ন থাকে তখন কুঞ্চিত ঠোঁটের অপরিসর ফাটল দৃষ্টিগত হয় আর এই অপরিসর ফাটল বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল ঠোঁটের ওপর চমকে জমা হয়, পরক্ষণেই অতর্কিতে জিভটি একবিন্দু, একবিন্দু করে মুখগহ্বরে ঠেলে দেয়; কোনো কোনোটি যেন দুঃসহ পীড়িত মর্মান্তিক কীটপতঙ্গ, কেননা তাদের মতোই কণ্ঠনালি দিয়ে নিচে নেমে যায়; তবে কণ্ঠনালির নড়ার শক্তি আগের মতো নয়, বয়সের কারণেই লোপ পেয়েছে; বিনা সংকোচে আগের মতো নিচে নামতে পারে না, মাঝেমধ্যে শব্দও হয়; পান-আহারের সময়ও শব্দ হয়; তবে আম্মা প্রৌঢ়শিলার মতোই অনড়, একমনে মনভোলানো থুতনি নেড়ে ধৈর্য সহকারে সেলাই করে চলেছেন। আর তার কান- এই কর্ণদ্বয় কি শরিফের ডাক শুনতে পায় না? যদিও স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে সেই ডাক- আম্মা, আম্মা, তুমি কোথায়? এই ডাক এফোঁড় ওফোঁড় করে যায় বাড়ির নীরবতা।
জানালার পাশেই রাখা রয়েছে একটা রেডিও, কিন্তু এটিকে স্পষ্টভাবে দেখার তেমন আলো নেই, প্রয়োজনও নেই, আরাম কেদারায় আসন নেওয়ার আগেই আম্মা এটি চালু করে দিয়েছিলেন, এই কারণেই তিনি শোনছিলেন একজনের আটই ফাল্গুনের ব্যাখ্যা। ব্যাখ্যাগুলো তার মনে স্বতঃনৈরাশ্যের সঞ্চার করে চললেও তার হাতের কাজ থামেনি। অগ্নি নির্বাপিত করার উদ্দেশ্যে জল নিক্ষেপের ফলে যেমন হস্ হস্ শব্দ এবং অনর্গল ধূম্ররাশি- বিচিত্র আকারে কুণ্ডলী- সৃষ্টি হয় এবং এসব অতিক্রম করে অন্তর্হিত অস্বস্তিকর ধোঁয়ার গন্ধ উদ্দাম হয়ে ওঠে, সেইরকম আম্মা প্রতীয়মান সমস্ত কিছুর মধ্যে আটই ফাল্গুনের চিরসত্যটির সন্ধান করেন- এই বিষয়ে তিনি সুনিশ্চিত। তিনি করুণ চোখে রেডিওটির দিকে একবার তাকিয়ে, পরক্ষণেই হৃদয়ের নিভৃততম বিশ্বাসে সেলাইয়ে মনোনিবেশ করলেন।
"