আরিফ মঈনুদ্দীন
উপন্যাস (পর্ব ৪০)
তাহারা ফিরিয়া আসিলেন
তারা এখন দাগনভূঁঞা বাজার পার হচ্ছেন। দাগনভূঁঞা থেকে এই আঞ্চলিক মহাসড়ক সোজা ডানদিকে চলে গেছে চৌমুহনী হয়ে মাইজদী কোর্ট- নোয়াখালী সদর। বাঁ দিকে চলে গেছে দাগনভূঁঞা উপজেলার দুধমুখা বাজার হয়ে নোয়াখালীর কবিরহাট উপজেলা। গাড়ি এখন দুধমুখা বাজারে। বাজারের মাঝখানে এসে দুটি রাস্তা দুদিকে চলে গেছে। বাঁ দিকে কোম্পানীগঞ্জ সদর- বসুরহাট। ডানদিকে স্কুল রোড হয়ে সোজা ভূঁইয়ারহাট- কবিরহাট- তারপর সুন্দলপুর। শফিক সাহেব বললেন, শরীফ এখন ডানদিকে সোজা চলে যাও। গাড়ি স্কুল রোড হয়ে দুধমুখা হাইস্কুলের সামনে এলে শফিক সাহেব বললেন, শরীফ একটু থামো তো।
শরীফ গাড়ি থামাল।
শফিক সাহেব প্রীতিকে লক্ষ্য করে বললেন, শোনো এই দুধমুখা উচ্চবিদ্যালয়ের ছাত্র ছিল এমন একজনের সঙ্গে ব্লুমসবারিতে আমাদের ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনে পরিচয় হয়েছে। পরিচয় থেকে পরে খাতির। তিনিও প্রফেসর। পদার্থ বিজ্ঞানের। নামটা হলো ইকতিয়ার উদ্দিন। আমাদের সময়ে ইকতিয়ার উদ্দিন এসএসসিতে এই স্কুল থেকে বোর্ডে দশম স্থান দখল করে হইচই ফেলে দিয়েছিল। সেই সুবাদে স্কুলটাও নাম কামিয়েছিল। এখন তা ধরে রাখতে পারছে কি না জানি না। এইজন্যে একটু থামলাম। স্কুলের প্রতি একটু সম্মান দেখালাম। এ এলাকার আরেকজন মানুষকে আমি চিনি, তাজুল ইসলাম ইঞ্জিনিয়ার। তিনি এখানের দুধমুখা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছুদিন পড়ার পর ঢাকায় চলে গেলেন। তারপর একসময় বুয়েট থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করে পানি উন্নয়ন বোর্ডে সহকারী ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজে যোগ দেন। শেষ পর্যন্ত তিনি প্রমোশন পেতে পেতে চিফ ইঞ্জিনিয়ার হয়েছিলেন। তিনি হাইড্রোলজির ওপর এমএস করার জন্য যখন লন্ডন এসেছিলেন, তখন আমার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাদের বাড়ি দুধমুখা থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে সেবারহাট রোডে চন্ডিপুর মুন্সী বাড়ি। শরীফকে বললেন, শরীফ এবার যাও।
প্রীতি বললেন, জায়গাটির নাম দুধমুখা কেন? জানো কিছু?
হ্যাঁ এটা আমি জানি। তোমার যেমন কৌতূহল হচ্ছে। আমারও হয়েছিল। আমি ইকতিয়ার উদ্দিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। দুটো কারণ সে বলেছে। একটি হলো এখানে আশপাশে কোনো একটি ‘খাঁ’ বাড়ি আছে। ওই বাড়ির গোড়াপত্তনকারী নাকি ‘দুধুম খাঁ’- তার বংশধররা বলেন, দুধুম খাঁ-এর নামানুসারে এই বাজারের নাম দুধমুখা। দ্বিতীয় কারণটি হলো এখানে বাজারের মাঝখান বরাবর চার রাস্তার মুখ বা মাথা আছে। এই এলাকায় প্রচুর গরুর দুধ পাওয়া যেত। প্রতিদিন সকালবেলায় ওই চার রাস্তার মুখে দুধের হাট বসত এইজন্যই দুধমুখা। অবশ্য দুধুম খাঁদের এই দাবি তারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। কারণ এলাকার প্রভাবশালীদের কাছে তাদের এই দাবি ধোপে টেকেনি। তারা দ্বিতীয় কারণটি বলতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
গাড়ি এখন ভূঁইয়ারহাট পার হয়ে কবিরহাট অতিক্রম করছে। শফিক সাহেব বললেন, পথ আর বেশি নেই। শিউলি মামণি খারাপ লাগছে কী?
শিউলি বলল, না আব্বু, খারাপ লাগছে না। আমার কাছে সবই নতুন লাগছে এবং যথারীতি ভালো লাগছে।
প্রীতি বললেন, ওর কাছে তো ভালো লাগবে। দিনদুপুরে হলে আরও বেশি ভালো লাগত। অবশ্য দিনদুপুর তো ফুরিয়ে যাচ্ছে না। ওকে এসব জায়গা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখিয়ে নেব।
শফিক সাহেব বললেন, আমিও তোমার মতো ভাবছি।
গাড়ি বাড়ির দরজায় এসে গেছে। ঐতিহ্যবাহী সুন্দলপুর মুন্সী বাড়ি। এ বাড়ির নামডাক আছে। ইলিয়টগঞ্জ মুন্সী বাড়িতে এদের আত্মীয়তা আছে। কুমিল্লার ইলিয়টগঞ্জ মুন্সী বাড়িতে আছে ঢাকার নবাবদের আত্মীয়তা। কোম্পানীগঞ্জের মোহাম্মদনগরে কেঞ্জাতলী মুন্সী বাড়িও ওদের আত্মীয় বাড়ি। ওই বাড়ির পূর্বপুরুষরা সুদূর আরব দেশ থেকে এসে বাংলা মুল্লুকে ধর্ম প্রচারের কাজ করেছেন। সমাজ কাঠামোতে একটি নির্ধারণী সূচক আছে, কার সঙ্গে কার আত্মীয়তা। আত্মীয়তার সম্পর্কের মাধ্যমেই সামাজিক মর্যাদা ঠিক করা হয়। অর্থাৎ কার কতটুকু ওজন (মর্যাদা) আত্মীয়তার দ্বারাই পরিমাপ করা হয়। অবিশ্যি লেখাপড়া এবং ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার কারণে এর কিছুটা হেরফের হলেও মূল সূচক নিয়ে টানাটানি কিন্তু থেকেই যায়।
গাড়ির হর্ন শুনে হেডলাইটের আলো দেখে একগাদা লোক এসে হাজির হলেন। বড়ভাই, ভাবি ও বাচ্চাদের মধ্যেও চলছে হুড়োহুড়ি। চাচাত-জেঠাত ভাই এবং ওই ভাবিদের কেউ কেউ তাদের বাচ্চারাও এই উষ্ণতায় দ্বিধাহীনভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। শফিক সাহেবের ভীষণ ভালো লাগছে। তিনি সবাইকে ঘরে আসতে অনুরোধ করলেন।
বড়ভাই আজিজ আহমেদ পূর্বাহ্নেই ঘরদোর পরিপাটি করে সাজিয়ে রেখেছেন। বাড়ির সদর দরজাসংলগ্ন প্রথম ঘরটিই শফিক আহমেদের ঘর। যারা এসেছিলেন প্রায় সবাই ঘরে গিয়ে বসেছেন। চাচাত ভাই মনির আহমেদ স্কুল শিক্ষক। গনি আহমেদ অবসরপ্রাপ্ত সরকারি চাকুরে। জালাল আহমেদ ব্যবসায়ী। আরো কয়েকজন আছেন তারা শহরে থাকেন, একজন অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব। একজন পিডিবির প্রধান প্রকৌশলী। আরো একজন আছেন একটি প্রাইভেট ব্যাংকের ডিমডি। নারীরা ভেতরে মিসেস শফিক আহমেদ এবং শিউলির সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। বড়ভাই আজিজ আহমেদ সাহেব সবাইকে মিষ্টান্ন দিয়ে আপ্যায়ন করছেন। বেশ বড় সাইজের চমচম। দুটো করে প্লেটে দিয়ে বললেন, আমি খেয়ে দেখেছি। ভাই বড়ই মজাদার মিষ্টি নিয়ে এসেছে। খেয়ে দেখেন।
মেয়েদের মিষ্টি বিতরণের দায়িত্বে আছে আজিজ আহমেদের স্ত্রী গুলনাহার বেগম। সবাই খুব মজা করে মিষ্টি খাচ্ছেন।
মিসেস গনি আহমেদ বললেন, ভাবি মজার মিষ্টি তো। কোথা থেকে এনেছেন রে ভাই?
প্রীতি বললেন, মিয়ারবাজারের আগে ‘হাইওয়ে ইন’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট আছে। আমরা ওখানে নাশতা খেয়েছি তো। রেস্টুরেন্ট লাগোয়া একটি মিষ্টি দোকানও আছে। ওখান থেকে আপনাদের জন্য মিষ্টি নিয়ে এলাম। শিউলির বাবা কিন্তু খেয়ে দেখে তারপর কিনেছেন।
মিসেস গনি বললেন, না ভাবলাম, কাছে-কিনারে কোনো বাজারে হলে সাহেবকে দিয়ে কিনাতাম।
ড্রইংরুমের আসরে মিষ্টি খেয়ে টিস্যুপেপার দিয়ে হাত মুছতে মুছতে মনির আহমেদ বললেন, তা শফিক এবার কতদিনের সফরে এলে?
শফিক সাহেব নির্বিকারভাবে বললেন, দেখি কত দিন থাকা যায়।
রাত ৯টার মতো বাজে। আজিজ আহমেদ বললেন, তাহের স্যার বলেছেন যত রাতই হোক তুমি এলে যেন তাকে জানাই।
শফিক ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, তাকে জানিয়েছেন?
না, আমি জানাই নি। তোমার সঙ্গে কথা বলার অপেক্ষা করছিলাম।
তাহলে চলেন যাই স্যারের সঙ্গে দেখা করে আসি। মিয়া বাড়ি তো বেশি দূরে না। এক-দেড় কিলোমিটার হবে...হাঁটতে হাঁটতে চলে যাব।
তাহের উদ্দিন মাহমুদের দরজায় গিয়ে টোকা দিলেন। আজিজ আহমেদ।
ভেতর থেকে আজাহার বলল, দরজায় কে এসেছেন?
আজহারের কণ্ঠ আজিজ আহমেদের চেনা তিনি বললেন, আমি মুন্সী বাড়ির আজিজ। আমার সঙ্গে ভাই প্রফেসর শফিক আহমেদ এসেছেন।
আজাহার দরজা খুলে মেহমানদের অভিবাদন জানাল। সালাম দিয়ে বলল, আসুন আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি। বাবা আপনাদের খবরের অপেক্ষায় আছেন।
ঘরে ঢুকে বাতির আলোয় আজাহারকে দেখে শফিক বললেন, তুমি আজাহার? বেশ সুন্দর হয়েছ তো দেখতে। তা হেডমাস্টার সাহেব, স্কুল কেমন চলছে?
আজাহার মুচকি হাসি ঠোঁটে ধরে রেখে বলল, ইনশাআল্লাহ ভালো আংকেল, আমি কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক গল্প শুনেছি। আপনি বাবার আদর্শ ছাত্র। বাবা আমাকে আপনার মতো হতে অনুপ্রাণিত করতেন।
তাদের কথা চলতে চলতে ভেতর থেকে তাহের উদ্দিন মাহমুদ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বললেন, শফিক এসেছে নাকি?
বলতে বলতে তাহের স্যার ড্রইংরুমে এসেই শফিককে জড়িয়ে ধরলেন। প্রায় ত্রিশ সেকেন্ড তিনি বুকের মধ্যে ধরে রাখলেন। ধরে রেখেই বললেন, তোমাকে আমি কতটুকু পছন্দ করি তা তুমি জানো না। অর্থাৎ তুমি যা জানো তারচেয়ে বেশি। তুমি বাড়ি আসবে বলেছিলে। সেদিন থেকে আমি অপেক্ষায় আছি। বেশ কিছু কথা জমা হয়ে আছে।
"