ড. আফরোজা পারভীন
প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদ
বাংলাদেশের পাঠক নিবিষ্ট হয়ে দেশের বই পড়তে শিখল লেখক হুমায়ূন আহমেদের কল্যাণে। ওপার বাংলার শংকর আর নিমাই ভট্টাচার্য যখন এ দেশের মধ্যবিত্তের লাইব্রেরি দখল করে গৃহিণী আর কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের হাতে হাতে ঘুরত, তখন এক ঝটকায় তাদের ফিরিয়ে আনলেন হুমায়ূন। ফেরালেন তার জাদুকরী ভাষা দিয়ে। ভাষা দিয়ে যে ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করা যায়, মোহমুগ্ধ করা যায়- তা হুমায়ূনই দেখালেন। সহজ সরল অকপট স্বচ্ছন্দ ও গতিময় ভাষার লেখা নিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন বইপ্রেমীদের কাছে। তার সংলাপের হিউমারে মন্ত্রমুগ্ধ পাঠক! কী উপন্যাস, কী গল্প- সবেতেই একই কারিশমা। পাঠকের মনে হতে লাগল, তার কথাই বলছেন লেখক, তার ঘরের ঘটনাই তুলে ধরেছেন। তার গৃহকর্মীই আছেন গল্পে। তার মা-খালা বা দাদিরই যেন এটা গল্প। মুগ্ধ পাঠক বিহ্বল চিত্তে তার লেখায় নিজেদের ছবি ও যাপিত জীবনের চালচিত্র দেখে বিস্মিত হলেন। নাগরিক মধ্যবিত্তের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার এমন অনবদ্য রূপায়ণ হুমায়ূন আহমেদের আগে কেউ করতে পারেননি। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণি, কৌতূহলী তরুণ আর চঞ্চল কিশোরী তার গল্পে নিজেদের খুঁজে পেল।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমাদের সাহিত্যে আরবি, ফার্সি, তৎসম, তদ্ভব শব্দের ব্যবহার ছিল। হুমায়ূন আহমেদ প্রথাগত ভাষা ব্যবহার করেননি। নিজেই তৈরি করছেন তার উপন্যাসের কাহিনির উপযোগী এক গদ্যভাষা। সে ভাষা সচল, ফুরফুরে, প্রাঞ্জল। ছোট ছোট বাক্যে এগিয়ে নিয়েছেন কাহিনি। এমন কিছু হিউমারাস শব্দ তিনি ব্যবহার করেছেন, যা পাঠককে বিনোদন দিয়েছে। পাঠক-মন হয়ে উঠেছে চনমনে, আনচান।
শুধু ভাষা নয়, গল্প বলার সম্মোহনী শক্তি ছিল হুমায়ূন আহমেদের। এই শক্তিই তাকে খ্যাতির শীর্ষে নিয়ে যায়। হুমায়ূন হয়ে উঠেন সময়ের শ্রেষ্ঠ এবং জনপ্রিয় কথাশিল্পী। তার কাহিনি অন্যরকম। খুবই মজার এবং কৌতূহলোদ্দীপক। বর্ণনায় থাকে টানটান উত্তেজনা। ঘটনার বিন্যাস, নাটকীয়তার চমৎকারিত্ব, বিশ্বাসযোগ্য ও বৈচিত্র্যময় চরিত্র সৃষ্টি এবং গভীর অন্তর্দৃষ্টি তার লেখাকে নিয়ে গেছে অনন্য মাত্রায়। তাকে পৌঁছে দিয়েছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
হুমায়ূন আহমেদ উপন্যাস নিয়েই সাহিত্যক্ষেত্রে আবির্ভূত হন। তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘নন্দিত নরকে’ (১৯৭২)। এরপর প্রকাশ হয় ‘শঙ্খনীল কারাগার’। নতুন লেখক হয়েও আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠক-মন জয় করে ফেললেন হুমায়ূন। সাহিত্যের ইতিহাসে এমন ঘটনা খুব একটা ঘটেনি।
হুমায়ূনের উপন্যাসে থাকে সুন্দর, নিটোল কাহিনি। কাহিনিকে তিনি সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে নির্মাণ করেন। কাহিনির পুরোটা তিনি কঠোর হাতে গভীর মনোনিবেশে নিয়ন্ত্রণ করেন। কাহিনি কোথা থেকে শুরু হয়ে কোথায় কোথায় যাবে, কেমনভাবে যাবে- তার পুরোটাই নখদর্পণে রাখেন। তিনি জানতেন- উপন্যাসে পাঠক এমন গল্প শুনতে চায়, যা কৌতূহল জাগিয়ে তোলে। পাঠক শুনতে চায় নতুন কিছু, অবাক করা কিছু- যা তাকে উৎকণ্ঠায় রাখবে। সারাক্ষণ ভাববে- এরপর কী ঘটবে? এই উৎকণ্ঠাটাই যদি সৃষ্টি না করা যায়, তাহলে লেখকের মৃত্যু ঘটে। এ জায়গাতে তিনি সম্পূর্ণ সক্ষম। তার সংলাপ ছোট, সংক্ষিপ্ত অথচ তীর্যক। তিনি কাহিনিতে মাঝে মাঝে এমন সব অভাবনীয় ঘটনা ঘটান, যা পড়ে দর্শক চমকে গেলেও আমোদিত হয়। এটাই হুমায়ূন আহমেদের ‘স্টোরি টেলিং’য়ের আশ্চর্য কৌশল।
লেখালেখির প্রথমদিকে তার উপন্যাস রচিত হয়েছে পরিবারনির্ভর কাহিনির ভিত্তিতে। পরে উপন্যাসের কাহিনি ও পটভূমিতে নতুনত্ব আনেন। নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনই হয়ে ওঠে তার প্রধান ফোকাস। এর সঙ্গে লোকজীবন, লোকসংস্কৃতি যোগ করেছেন। বৃহত্তর ময়মনসিংহ এলাকা বিশেষ করে নেত্রকোনা, সিলেট অঞ্চলের সমাজজীবন নানাভাবে উঠে এসেছে তার রচনায়। ভাটি অঞ্চলের ক্ষয়িষ্ণু জমিদার, সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ, বাউল, ফকির, গাতক তার লেখায় গভীর মমতায় জায়গা পেয়েছে। ময়মনসিংহ, নেত্রকোনার আঞ্চলিক ভাষা, প্রবাদ প্রবচন, শ্লোকসহ নান্দাইল, নীলগঞ্জ, গফরগাঁও, পাকুন্দিয়া, গৌরীপুর এরকম অনেক গ্রাম, জনপদের নাম পাওয়া যায় হুমায়ূনের লেখায়।
বর্ণনামূলক রীতির উপন্যাসেও অনন্য হুমায়ূন আহমেদ। তিনি কখনোই ছকবাধা পথে চলেননি। বর্ণনামূলক উপন্যাসের সুবিধা এটাই যে, পাঠক নিজের কল্পনাকে কাহিনির সঙ্গে মিশিয়ে উপন্যাসের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। তার এ-ধারার উপন্যাস ‘জোছনা ও জননীর গল্প’, ‘বাদশা নামদার’, ‘দেয়াল’, ‘মধ্যাহ্ন’ ইত্যাদি।
মিসির আলি এবং হিমু চরিত্র হুমায়ূন আহমেদের অনন্য সৃষ্টি। এই সিরিজের উপন্যাসগুলোয় হুমায়ূন আহমেদ চরিত্রকথনরীতির সার্থক প্রয়োগ করেছেন। তিনি বাংলা কথাসাহিত্যে অনেক কালজয়ী চরিত্র উপহার দিয়েছেন। হিমু, মিসির আলি ছাড়াও আছে শুভ্র, রূপা। এ চরিত্রগুলো কালোত্তীর্ণ, অমর চরিত্র।
তিনি উপন্যাসের আঙ্গিক-প্রকরণ নিয়েও পরীক্ষা-নিরীক্ষা কম করেননি। ফলে তার কোনো লেখাই একেবারে নিম্নমানের, পড়ার অযোগ্য এ কথা কখনই শোনা যায়নি। কোনো কোনো লেখা বিশেষ খ্যাতি পেয়েছে ঠিকই, তবে সব লেখাতেই সাধারণ মান বজায় রাখতে সমর্থ হয়েছেন তিনি।
হুমায়ূন আহমেদ একজন বড় মাপের ছোটগল্প লেখকও। তার ছোটগল্প লেখার কৌশল অনন্য সাধারণ। এখানেও আছে সেই ভাষার কারুকাজ। আঁটসাঁট বুননে, ছোট ছোট শব্দে, প্রাঞ্জল গতিময় ভাষায় বেশকিছু ভালো ছোটগল্প লিখেছেন। তার ছোটগল্পের বৈশিষ্ট্য এটাই যে, তিনি গল্পে একটিও বাড়তি শব্দ ব্যবহার করেননি। তার গল্প মেদহীন, একেবারে ঝরঝরে। তিনি গল্পে সেটুকুই বলেছেন, যা বলতে চান বা বলা প্রয়োজন। তার গল্পে কৌতুকপূর্ণ সংলাপ থাকে, থাকে মজার মজার ইঙ্গিত। সত্যি বলতে কী, এখানেই তিনি আলাদা। তার গল্পে কখনই অপ্রাসঙ্গিকতা আসেনি। তার লেখা ‘নিশিকাব্য’, ‘শীত ও অন্যান্য গল্প’, ‘মৃত্যুগন্ধ’, ‘১৯৭১’ অসাধারণ। এছাড়া ‘চোখ’, ‘খাদক’, ‘জলিল সাহেবের পিটিশান’ মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার মতো গল্প।
হুমায়ূন আহমেদ প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, গান, ভ্রমণ-আখ্যান, আত্মজীবনী, ব্যক্তিগত রচনা, রস-রহস্য, নাটক, চলচ্চিত্র, ছোটদের রচনা, বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনি লিখে গেছেন। তার লেখার বৈচিত্র্য একদিকে নতুনত্ব এনেছে, অন্যদিকে সমৃদ্ধ করেছে আমাদের সৃষ্টিসম্ভার। দেশের বিপুলসংখ্যক পাঠকের মনে আজও তিনি অম্লান। আজও পাঠক বইমেলায় গিয়ে তার বই খোঁজে। এর চেয়ে সাফল্য একজন লেখকের জীবনে আর কী হতে পারে!
"