আরিফ মঈনুদ্দীন
উপন্যাস (পর্ব ৩৯)
তাহারা ফিরিয়া আসিলেন
আমি যে বলিনি এটা বুঝলে কীভাবে? তোমরা মা-মেয়েতো সেদিন বলছিলে সবাইকে সারপ্রাইজ দেবে, আমি তোমাদের কথোপকথন শুনেছি।
ড্রাইভার শরীফ হোসেন বলল, স্যার এবার নামুন। দেখেন কী সুন্দর রেস্টুরেন্টে এসেছি।
শফিক তাকিয়ে সাইনবোর্ড দেখেন- হাইওয়ে ইন। নামটা দেখেই ভালো লাগল। পথের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নাম। এটাও একটা ভালো কৌশল। তিনি হাতের ঘড়িতে তাকিয়ে দেখেন সন্ধ্যা ৭টা। ক্ষুধাও লেগেছে বেশ।
প্রীতি গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল, এতক্ষণ তো ক্ষুধার কথা মনে ছিল না। রেস্টুরেন্ট দেখে তো ক্ষুধা বেড়ে গেল মনে হচ্ছে। শিউলি কী বলিস?
ঠিক তাই আম্মু। আমি তোমার মেয়ে না? তোমার ক্ষুধা বেড়ে গেলে আমারটা বসে থাকবে কেন? আমারটাও লম্বা হয়ে যাচ্ছে।
এদের মা-মেয়ের কথা শফিক সাহেব এনজয় করছেন। তিনি যথারীতি উৎফুল্ল মেজাজে বললেন, তোমাদের সুন্দর সুন্দর কথা কিন্তু আমি লক্ষ করি আমার খুব ভালো লাগে।
প্রীতি মুগ্ধকণ্ঠে বললেন, শেষপর্যন্ত এ নিয়েই তো তোমার বাহুডোরে আছি। তা না হলে কী যে হতো?
শফিক বললেন, কিছুই হতো না। আরেকটি পথ বেরিয়ে পড়ত। সে যাই হোক। আশা করি আমাদের এবারের বেড়ানোটা আনন্দময় হবে।
ড্রাইভারকে গাড়ি পার্কিংয়ের সুযোগ দিয়ে তারা পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন।
পার্কিং করে এসে শরীফ বলল, চলুন স্যার।
সবাই রেস্টুরেন্টে ঢুকল। রিফ্রেশ রুমের ক্রিয়াকর্ম সেরে এসে ড্রাইভার বলল, স্যার ওপরে এসি আছে। তবে খাবার ভালো নিচে। গরম তো তেমন লাগছে না। আমরা নিচেই বসি। কী বলেন, স্যার।
ঠিক আছে বসো।
শফিক সাহেব স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে একটি টেবিলে বসলেন। ড্রাইভার নিরাপদ দূরত্বে অন্য একটি টেবিলে বসল। শফিক বললেন, তোমরা কি ভাত খাবে? এখন তো সবেমাত্র সন্ধ্যে ৭টা। পরোটা সবজি, গরুর মাংস খেতে পারো। বাড়িতে কিন্তু তোমাদের জন্য পাক হচ্ছে। এখন ভাত খেলে বাড়িতে খেতে পারবে না। বাড়িতে ভাইজান-ভাবি খুব আগ্রহ করে পাক করেছেন। না খেলে কষ্ট পাবে।
শিউলি বলল, ঠিক আছে আম্মি পরোটা গরুর মাংস এবং সঙ্গে সবজিও নাও।
নাশতা শেষ করে সবাই চা নিয়ে বসেছে। চায়ের গন্ধটা বেশ ভালো লাগছে।
শফিক সাহেব বললেন, চায়ের রংটা তো মনোমুগ্ধকর।
শিউলি চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, আব্বু শুধু রং না, খেতেও বেশ হয়েছে।
প্রীতিও বলল, চা ভালো হয়েছে।
শফিক সাহেব চা খেতে খেতে বললেন, এই চায়ের জন্য ‘হাইওয়ে ইন’কে মনে থাকবে। কী বলো?
শিউলি বলল, আব্বু ঠিক বলেছ। এদের ক্যাশ কাউন্টারের লোকগুলোকে ধন্যবাদ দিয়ে যেও।
শফিক সাহেব বের হওয়ার সময় ক্যাশে বসা লোকটিকে বললেন, আপনাদের নাশতা বেশ ভালো লেগেছে। বিশেষ করে চা-টা অত্যধিক ভালো হয়েছে। আমরা রীতিমতো এনজয় করেছি। আপনাকে ধন্যবাদ।
ক্যাশের লোকটি বলল, আপনাকেও ধন্যবাদ। খারাপ হলে সবাই চেঁচামেচি করে। গালমন্দও করে। কিন্তু ভালো হলে কেউ বলে না। আপনি বলেছেন, এইজন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ।
হাইওয়ে ইন থেকে বের হওয়ার পথে ডান দিকে তারা একটি কামরায় মিষ্টির পসরা সাজিয়েছে। শফিক সাহেব ভেতরে ঢুকে দেখলেন বেশ দৃষ্টিনন্দন চমচম। খেতে কেমন কে জানে- তিনি বললেন, আপনাদের চমচম তো দেখতে বেশ ভালো। খেতে কেমন হবে?
সেলসম্যান ছেলেটি বলল, স্যার একটি টেস্ট করে দেখবেন?
দাও তো একটা দেখি।
খেতেও বেশ ভালো। উনি বললেন, ঠিক আছে এখান থেকে দশ কেজি চমচম দাও।
ড্রাইভারকে ডেকে বললেন, এগুলো তোমার বাঁ পাশে সিটের নিচে রেখে দাও।
ড্রাইভার শরীফ আবার গাড়ি ছাড়ল। সবার ভেতরে কেমন শান্ত-সমাহিত ভাব। শরীফের আচরণেও তেমনটি বিদ্যমান এবং কী আশ্চর্য মনে হচ্ছে- এই টিপটপ মাইক্রোবাসটির আচরণেও শান্ত-সমাহিত ভাব এসে গেছে। এরা সবাই ফ্রেশ হয়ে নাশতা খেয়ে কেমন এক তৃপ্তিদায়ক ভ্রমণের শেষাংশে অবস্থান করছে। ড্রাইভার শরীফ গাড়িতে আলতো করে পালকের ব্রাশ চালিয়েছিল কিছুক্ষণ আগে। গাড়ি তার খাদ্য হিসেবে সিএনজিও নিয়েছে। তার মানে হলো এই যান্ত্রিক যানবাহনটিতেও প্রাণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেও চড়নদারদের সঙ্গে সমান তৃপ্তিদায়ক অবস্থানে আছে। শুধু আদর- চাই সেটা প্রাণীকে হোক অথবা অপ্রাণীকে- দিলেই ফল ফলতে দেরি হয় না। একটি শরীরে আরেকটি মনে। দুটোরই ধারক মানুষ নিজে।
গাড়ি ফেনীর কাছাকাছি এসে গেছে। ড্রাইভার বলল, স্যার মহিপাল হয়ে যাবেন নাকি একটু আগে ফেনী বিসিক শিল্পনগরীর বিপরীত দিক দিয়ে একটি রাস্তা আছে। পাঁচগাছিয়া বাজার হয়ে ফেনী নোয়াখালী রোডে ওঠা যায়। এটাও নোয়াখালীর লোকদের জন্য মহিপাল বাইপাস। ট্রাফিক জ্যাম থেকে বাঁচা যায়।
তুমি তো দেখি সব চেনো। তোমার বাড়িও কি নোয়াখালী নাকি?
বাড়ি নোয়াখালী স্যার- ঠিক আছে। তার থেকে বড় কথা। আমরা তো রেন্ট-এ-কার চালাই। এসব আমাদের চিনতে হয়।
শফিক নিজের সামান্য হিসাবের হেরফের বুঝতে পেরে বললেন, ও হ্যাঁ। তাইতো। ঠিক আছে তুমি তোমার মতো যাও। মহিপালে আমাদের কোনো কাজও নেই।
গাড়ি পাঁচগাছিয়া বাজার পার হয়ে নোয়াখালী সড়কে উঠেছে। ড্রাইভারের গাড়ি চালানো দেখে শফিক সাহেবের বেশ লাগছে। ড্রাইভার কেমন নির্লিপ্ত নির্বিকার। ভয়-শঙ্কাহীন শুধু গাড়ি চালাচ্ছেই না, সে ঠিকমতো ড্রাইভিংটা উপভোগও করছে। তিনি একটি গাড়ি কিনবেন বলে ভেবে রেখেছেন। এরকম একজন ড্রাইভার খুঁজে বের করতে হবে। তারা এখন জায়লস্কর উচ্চ বিদ্যালয় এবং বিজিবি ক্যাম্প অতিক্রম করছেন। সামনে সিলোনিয়া বাজার। রাত হয়ে গেছে। বাইরে ভালো দেখা যাচ্ছে না। এতক্ষণে সিলোনিয়া বাজার ছেড়ে বেকের বাজার পার হয়ে মাতুভূঁইয়া অতিক্রম করছেন, ডান দিকে সালামনগর। ভাষাশহীদ আবদুস সালামের গ্রাম। মাতুভূঁইয়া ব্রিজের ডান পাশে ভাষা শহীদ আবদুস সালাম মেমোরিয়াল কলেজ। দিনের বেলায় এই জায়গাগুলো ভালো করে দেখবেন।
"