ড. মুকিদ চৌধুরী
নাট্যোপন্যাস-২
আটই ফাল্গুন
আম্মা ঝটিতি চারদিক দেখলেন তীক্ষ্ম অনুসন্ধিৎসা দৃষ্টিতে, বুঝতে পারছেন- কী ঘটতে যাচ্ছে, কী হতে চলছে এবং এর প্রতিক্রিয়া কী হবে; তাই হয়তো গফুরের প্রতি সমর্থনের কোনো চিহ্ন তার মুখে নেই, বাস্তবতা যেন সব চিহ্নের অতীত; তাই তিনি নিশ্চুপ।
তখন দুই পথিক রিকশার পাশ দিকে এড়িয়ে যায়, একজন আরেকজন বলে- আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, কিন্তু ওরা উর্দু আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। আইন দিয়ে ওরা আমাদের শৃঙ্খলিত করতে চায়। এই শৃঙ্খল আমরা ভেঙে চুরমার করে দেব। পথিকের উদ্দেশে গফুর বলল, কিন্তু উর্দুর সঙ্গে আমার তো কোনো বিরোধ নেই। আমি উর্দু জানি। অবশ্য আমার আম্মা একেবারেই উর্দু বোঝে না। বাঙালি মেয়ে কি না, তাই আমাকেও উর্দুতে কথা বলতে নিষেধ করে।
আম্মার শরীরে ঢলে পড়া চাঁদের জোয়ার লাগে, বললেন, নারীরা প্রতিবাদ করতে জানে। ১৪৪-ধারা ওরাও মানে না। রাষ্ট্রভাষা উর্দু মানে না। হরতাল হরতাল, চলবেই চলবে।
গফুরের বুকে যেন আগের মতোই পাথর ফেটে জল চোঁয়াচ্ছে, বলল, হরতাল! কীসের হরতাল? সব দোকানপাট তো দেখছি খোলা। আর মনে মনে বলল, ভালোই হলো। পছন্দমতো শাড়ি, চুড়ি, আলতা, হাঁসলি কেনা যাবে।
আম্মা রিকশাটি এগিয়ে চলেছে। দেখতে পেলেন- বাস, রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি- সবই চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শুধু আমতলায় এসে সমাবেত হচ্ছে। পুলিশের বড়কর্তারা পায়চারি করছিল রাস্তায়। বন্দুক ও রাইফেলের নলগুলো রোদে চিকচিক করছিল। আমতলার সভা শুরু হয়। ছাত্রকণ্ঠে ধ্বনিত হয়, কোনো বক্তৃতার প্রয়োজন নেই। আমরা ১৪৪-ধারা ভাঙবই, ভাঙব। কিন্তু নেতা বলে ওঠেন, না, ১৪৪-ধারা ভাঙা যাবে না। আইন অমান্য করা যাবে না। ছাত্ররা প্রতিবাদ করে, না, না, তোমার কথা আমরা মানি না। তুমি বিশ্বাসঘাতক। তোমার কথা আমরা শুনব না। আমরা ১৪৪-ধারা ভাঙবই, ভাঙব। শৃঙ্খল আমরা ছিন্ন করবই, করব।
তলপেট থেকে খাঁড়ির মতো যে জায়গাটা নেমে গেছে কুঁচকি বরাবর, তার আশপাশে ঘামাচির মতো অজস্র ফুসকুড়ি একসঙ্গে যেন চুলকে উঠল। গফুর ভাবল, হাতের চেটো দিয়ে ডলে দিলে বুঝি শান্তি হয়; কিন্তু একজন বালিকার সামনে এমনটা করা উচিত নয়, তা ছাড়া কষে কষে ঘা আরো বেড়ে যাবে। তখনই সে দেখতে পেল পিস্তলে হাত রেখে চমকে উঠতে বড়কর্তাদের। ছোটোকর্তারাও ছুটে এসেছে সাধারণ পুলিশের পাশে। সেনাদের চোখেমুখে অবশ্য কোনো ভাবান্তর নেই, শুধু বড়কর্তাদের মুখের দিকে নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই, কেননা ওরা হুকুমের দাস।
আম্মা রিকশার সিটে বসেই স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছেন, আমরা ১৪৪-ধারা ভাঙবই, ভাঙব। কিন্তু বিশৃঙ্খলভাবে নয়। দশজন, দশজন করে বেরিয়ে পড়ব রাস্তায়। মিছিল করে এগিয়ে যাব প্রাদেশিক পরিষদ ভবনের দিকে। শপথের কঠিন দীপ্তিতে উজ্জ্বল দশজন দশজন করে বিভক্ত ছাত্রদল। দশজনের একটি দল পুলিশের মুখোমুখি হয়। ধ্বনিত হয়, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। বাংলা চাই। উর্দুর দাবি মানি না, মানবও না।
সেনারা ছুটে চক্রাকারে। তারপর ছাত্রদের ঘিরে দাঁড়ায়। ছাত্রদের বুকের সামনে রাইফেলের নল চিকচিক করতে থাকে। আমতলা, মধুর রেস্তোরাঁ, ইউনিয়ন অফিস, পুকুরপাড়- চারদিক থেকে ধ্বনি ওঠে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। একে একে দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দলটি বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়। ছাত্রদের ধরে খালি ট্রাকে তুলে নিচ্ছে সেপাইরা। বড়কর্তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা, কত ধরব? কত নেব জেলখানায়? ঢেউয়ের-পর-ঢেউয়ের মতো বেরিয়ে পড়ে ছাত্ররা। কাঁদুনে গ্যাস ছুড়ছে পুলিশবাহিনী। ছাত্রদের চোখ জ্বলছে, জল ঝরছে। হঠাৎ আম্মা চিৎকার করে ওঠেন, চোখে জ্বল দাও। এরই মধ্যে হুমড়ি খেয়ে ছাত্ররা এসে পড়েছে পুকুরে।
কেমন যেন ধোঁয়াটে হয়ে যায় সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। তবু বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল টপকে ঝাঁকে ঝাঁকে ছাত্র এগিয়ে যায় মেডিক্যাল ব্যারাকের দিকে। আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। পুলিশের গাড়িগুলো মেডিক্যাল ব্যারাকের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়। বড়কর্তারা হুকুম দিতে থাকে, আন্দোলন এখনই শেষ করতে হবে। বড়কর্তারা আরো সেপাই চায়, আরও গাড়ি চায়, আরো অস্ত্র চায়। একে একে সবই আসে। সঙ্গে ছাত্ররাও। আন্দোলন তীব্র গতি ধারণ করে। কার শক্তি আছে একে স্তব্ধ করার? পুলিশ আর ছাত্রদের মধ্যে ইটের যুদ্ধ অব্যাহত থাকে।
গফুর বলে, কী হচ্ছে এসব?
আম্মা কোনো উত্তর দেন না।
গফুর ভাবার চেষ্টা করে, কিন্তু নিজের ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে কারণ নির্ণয় করতে পারে না। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে, আকাশে একটুকরোও মেঘ নেই। সূর্যটা ঈষৎ ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। পলাশের ডালগুলো লাল রং মেখে নুয়ে পড়েছে। বাতাসও নিথর। হঠাৎ গুলির শব্দ বাড়তে থাকে। মুহূর্তে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে যায় সবাই- ছাত্র, জনতা, মানুষ। শুধু আকাশে উড়তে থাকে শকুনগুলো।
আম্মা আজও ১৯৫২-এর আটই ফাল্গুনের কথা ভুলতে পারেননি। আজও নিজ মনেই বলেন, ছাত্র-জনতা-মানুষের ওপর গুলি চালিয়ে ছিল ওরা। কতজন মারা গেল তার কোনো হিসাব নেই। ১৯৫২-এর আটই ফাল্গুন সূর্য ডুবেছিল ঠিকই। সুতোর মতো সরু জলের লহরিও যেন বালির ওপর দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে চলেছিল। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছিল। ঘন অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছিল সমগ্র নগরী। এই ঘন অন্ধকারেই মৃতদেহগুলো সরিয়ে ফেলে পুলিশবাহিনী। ঢুকরে কেঁদে উঠেছিলেন আম্মা।
আজও কান্না বুকে নিয়ে নগ্নপদে আটই ফাল্গুনে এগিয়ে চলে বাঙালি শহীদ মিনারের দিকে। অসংখ্য পতাকা পতপত করে উড়ে আকাশে-বাতাসে। বাঙালি সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো অসংখ্য ঢেউ তুলে এগিয়ে চলে ভবিষ্যতের দিকে। কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ঝরে পড়ে মৃত্তিকায়, বৃষ্টির মতো। ঝরে প্রতিটি আটই ফাল্গুনে, তবু ফুরোয় না।
আম্মা? তুমি কোথায়?
শরিফ ডেকে চলে, কিন্তু আম্মার কোনো সাড়াশব্দ নেই। শরিফের উদ্বেগ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে, এই উদ্বেগের পেছনে রয়েছে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা, এক দিন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়েন আম্মা। শহরের এক বিস্তীর্ণ প্রান্তরের কোণে, ক্রিকেট খেলার মাঠে, এক বেঞ্চিতে বসেছিলেন তিনি। সামনে সবুজ মসৃণ মাঠটি যেন কমলা আলোর সমুদ্রে স্নান করছিল। আর এই আলোর পটভূমিতে কয়েকটি বালক খেলায় ব্যস্ত ছিল। অস্তগামী সূর্যের কমলা আলোয় আম্মাকে আবিষ্কার করে শরিফ। এখনো আম্মার সাড়াশব্দ না পেলে তার ভয় হয়, এখন সে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজছে, আম্মার সন্ধানে; কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না।
"