মাজহার মান্নান

  ০১ নভেম্বর, ২০২৪

জসীম উদ্দীনের কাব্যে ইসলামি উপজীব্য

‘বিংশ শতকে সাহিত্য গগনে/উঠেছিল এক রবি/মরমী চেতনায় স্ফুরিত/পল্লী বাংলার কবি।’

জসীম উদ্দীনকে আমরা সবাই পল্লীকবি হিসাবে জানি। গ্রামবাংলা এবং লোকজ সংস্কৃতি তার কাব্যের প্রাণ। কিন্তু তার কাব্যে মরমিবাদ, সুফিবাদ, আধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামি উপজীব্য কতটা প্রভাব বিস্তার করেছিল, সে বিষয়ে খুব কমই জানি। এ লেখায় সে বিষয়ে আলোকপাত করার চেষ্টা।

বাল্যকাল থেকেই পল্লীকবির তাম্বুলখানা গ্রামে আমার যাতায়াত ছিল। বাড়ি থেকে আধাঘণ্টার পথ তাম্বুলখানা। কবির বাড়ি দর্শনে প্রতিদিনই মানুষের ভিড় লেগে থাকে। অনেকে যায় সময় কাটাতে, কেউ যায় বিনোদন খুঁজতে, কেউ যায় গবেষণার উপাদান সংগ্রহে, আবার কেউ যায় তার কাব্য প্রেমে পড়ে। আমি চেষ্টা করেছি তার কাব্যের বহমাত্রিক উপজীব্য খুঁজে বের করতে। জসীম উদ্দীনের কাব্যে লালনের মরমিবাদের ছাপ স্পষ্ট। মরমি প্রেমতত্ত্ব, মিস্টিসিজম, অতিন্দ্রীয় ভাববাদ, অধিবিদ্যক উপমা, নান্দনিক অলংকরণ তার কাব্য দর্শনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কাজী নজরুলের ইসলামি গান ও গজল দ্বারা জসীম উদ্দীন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন, যেটার প্রমাণ মিলে জসীম উদ্দীনের জারি, সারি ও মুর্শিদি গানে। প্রথমেই আসি জসীম উদ্দীনের মাস্টারপিস ‘কবর’ কবিতা প্রসঙ্গে। এই কবিতায় একজন বৃদ্ধ কীভাবে তার আপনজনকে পর্যায়ক্রমিক হারান এবং একপর্যায়ে তিনি বিমূূর্ষ হয়ে পড়েন শোকে। তিনি ভাবতে থাকেন তিনি আর এত শোক নিতে পারছেন না। তিনি এটাও ভাবেন, তার জীবন যেন কেয়ামত। তিনি তার নাতিকে খোদার কাছে মোনাজাত করতে আহ্বান জানান। আল্লাহর করুণা ভিক্ষা চান।

‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে/মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর/মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর/জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান/ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু- ব্যথিত প্রাণ।’

জসীম উদ্দীনের কবিতার এই পঙ্ক্তিতে বেশ কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে, যেগুলো ইসলামি উপজীব্যের অন্তর্ভুক্ত। মজিদ (মসজিদ), আযান, কেয়ামত, মোনাজাত, খোদা, রহমান, ভেস্ত (বেহেশত), নসিব ইত্যাদি শব্দগুলো ইসলামি জীবনবোধের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। তা ছাড়া বৃদ্ধের যে বুকফাটা আর্তনাদ, সেটাও ইসলামি রীতিতে প্রতিপাদিত।

কাজী নজরুলের সঙ্গে জসীম উদ্দীনের একটি আত্মিক যোগাযোগ ছিল। নজরুল জসীম উদ্দীনের তাম্বুলখানার বাড়িতে গিয়েছেন, সাহিত্য আসর করেছেন। নজরুলের ইসলামি গজলের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন জসীম উদ্দীন। নজরুল কবি জসীম উদ্দীনকে একটি কবিতা লিখে উপহারও দিয়েছিলেন। জসীম উদ্দীন সেটা হারিয়ে ফেলেন। স্মৃতিচারণ করে নজরুল লেখেন- ‘আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ, নদীর তীরে ডিঙি তরী পথিক ধরা ফাঁদ।’ কবি নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে আর জসীম উদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ সালে। আবদুল মান্নান সৈয়দ লেখেন- তারা দুজনে দূরে বাস করলেও তারা ধন্য হয়েছেন একালের মুসলমান সমাজের অন্তরে। উপমহাদেশে ইসলামি সাহিত্যের বিকাশে এরা দুজনেই বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন। জসীম উদ্দীনের কবিতায় আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য লক্ষ্যণীয়। ‘দর্গা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নী আসে ভারে; নৈলা গানের ঝংকারে গাঁও কান্দে বারে বারে।’ (নক্সীকাঁথার মাঠ)। কবি জসীম উদ্দীন লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। বহু সংস্কৃতির সান্নিধ্যে তিনি এসেছিলেন। তার কাব্যে ইসলামি উপাদান এক বিশেষ স্থান জুড়ে আছে। ‘ওগো কল্যাণী! কহ কহ তুমি কেবা দরবেশ, তোমার লাগিয়া মন-মোমবাতি পুড়ায়ে করিলো শেষ।’ (রূপবতী)

কবি জসীম উদ্দীনের কাব্যের মূল উৎস গ্রামবাংলার লোকজ সংস্কৃতি, রীতি-নীতি। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ মুসলিম। তাই তাদের সংস্কৃতিতে ইসলামের ব্যাপক প্রভাব দৃশ্যমান। মানস কবি জসীম উদ্দীন ইসলামি উপমা প্রয়োগে মুনশিয়ানা দেখিয়েছেন। তার আখ্যান কাব্যের মূল উপাদান লোকজ থেকে নেওয়া। কাহিনি বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে, শব্দ চয়নে, উপমা চিত্রকল্পে, লোককাব্যে, পুথিঁ সাহিত্যে মরমিবাদের ছাপ স্পষ্ট। জসীম উদ্দীনের কাব্যে সম্প্রতির পরিচয় অনেক গভীরে। হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস, এদের দ্বন্দ্ব-সংঘাতকে ঘৃণা করে নিরপেক্ষ থেকেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কবি লিখেন- ‘এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে, মাথার ওপর একই আকাশ ভাসছে রঙের নীলে।’ (সোজন বাদিয়ার ঘাট)। জসীম উদ্দীনের এই কাব্যিক চরণগুলো লালনের সেই সাম্যবাদী চেতনাকে স্মরণ করে দেয়- ‘হিন্দু খ্রিষ্টান আর মুসলমান, রক্তে বর্ণে নেই ব্যবধান।’

জসীম উদ্দীন তার কাব্যে গ্রামীণ জনপদ, গ্রামের মানুষের জীবন, তাদের সংস্কৃতি, তাদের দর্শন, তাদের ধর্ম, তাদের বিশ্বাসসহ সব কিছুকে নান্দনিকতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তার কাব্যের আলোচনার মানুষগুলোর বেশির ভাগ মুসলিম। তারা ইসলামি ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। খোদায় ভক্তি, ইহকাল, পরকাল, মরমিচেতনা, ইসলামি সংস্কৃতি তাদের জীবনচলার প্রধান নির্দেশনা। কবি জসীম উদ্দীন সেগুলোই তার কাব্যে তুলে ধরেছেন উপমা দিয়ে, অলংকরণ করে। প্রকারান্তরে তার কাব্যের বিষয়গুলো ইসলামি ভাবধারাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। কবি জসীম উদ্দীন তার প্রেমকাব্য সাজিয়েছেন বৈষ্ণব, বাউল আর মরমিবাদের আলোকে। তার বালুচর কাব্য ১৭টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলোয় তার দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্মুখী মনে হয়েছে। এক ধরনের ঐন্দ্রিক ভাবতত্ত্বের গন্ধ পাওয়া যায় তার কাব্যে। দুর্বিষহ যাতনা ভোগ করেও যে প্রেম নিঃস্বার্থ হওয়ার মন্ত্র শেখায়, সে প্রেম যেন তার কাব্যকে আলোকিত করেছে। তার কাব্যে আধুনিক পরাবাস্তবতার দৃশ্য অনুপস্থিত। বরং মরমি ও সুফি সাধকের মতো তিনি চরিত্রায়ন করেছেন। বালুচরের অনেক কবিতা ত্রিপদী ছন্দে লেখা হয়েছে। ইসলামি কাব্যে ত্রিপদী ছন্দ বেশ জনপ্রিয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জসীম উদ্দীনের এই ছন্দে ইসলইম কাব্যের ছন্দের প্রভাব রয়েছে। ‘বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে, কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া গাঁয়ের ঘরে?’

কবি জসীম উদ্দীনের কাব্যে যে প্রেমের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তা সাধারণ প্রেম নয়, লোকজ প্রেমও নয়, প্রেম- ভাবনার ক্ষেত্রে কবি বেছে নিয়েছেন বাংলার ধর্মভিত্তিক প্রেম সাধনার ঐতিহ্য। প্রেমের যে উদার, মাহতা গীত হয়েছে যুগ যুগ ধরে, সেই প্রেমই উঠে এসেছে তার কাব্যে। তার প্রতিদান কবিতায় ফুটে উঠে উদার প্রেমের অমিয়বাণী- ‘আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর/আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।’ ইসলামি নৈতিকতার সৌহার্দ আর মর্মবাণী যেন কবির কবিতা জুড়ে। যে কবিকে ‘বিষে ভরা বান’ দিতে চায়, কবি তাকে ‘বুক ভরা গান’ দিতে চান। ইসলামের সেই বাণী- কেউ তোমার প্রতি হিংসা করলেও তুমি প্রতিহিংস হবে না। কবির কাব্যের পরতে পরতে যেন ইসলামের সেই বাণীই মূর্তমান। কবি তার কাব্যে লোকজ ভাষার সঙ্গে দেশি-বিদেশি ভাষাও ব্যবহার করেছেন। ‘জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়।’ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন স্তরে সুফিবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জসীম উদ্দীনের সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। তার ‘নক্সীকাঁথার মাঠ’ কবিতায়ও সুফিবাদের প্রভাব স্পষ্ট। ‘বন্ধুর বাড়ি, আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী/উইড়া যাওয়ার সাধ ছিল, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি।’

কবি জসীম উদ্দীন বেশ কিছু মুর্শিদি গান রচনা করেছেন। ও তুমি আইসোরে দয়াল আমার মুর্শিদেরে/দয়াল আমার কাণ্ডারি হইয়ো রে। তিনি ইসলামি ভাবধারার অনেক জারি গান লিখেছেন। কোরবানির জারি, ইউসুফের জারি, হাসানের বিষপান, দেহতত্ত্ব, কুলসুমের মেজবানি, মক্কার জন্মনামা জারি, হাজেরার বনবাস, জহরনামা জারি উল্লেখযোগ্য। তার পরিচিত উপন্যাস বোবা কাহিনিতেও ইসলামি উপজীব্য দৃশ্যমান। পালাগান, গাজির গান, লোকগীতি, জারী-সারি, ইসলামি গান, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, উর্দু গান, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদিসহ সব ধরনের শিল্প-সংস্কৃতিতে তার পাণ্ডিত্যের প্রমাণ মেলে। আধ্যাত্মিকতা তার কাব্যে যেন এক নবমাত্রার উন্মেষ। ‘আমার সোনার ময়না পাখি/কোন দেশেতে গেলা উইরা রে/দিয়া মোরে ফাঁকি।’’ তার আধ্যাত্মিক ইসলামি গান পাঠকমনে শান্তির পরশ বোলায়। ‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিল না আমারে/পাপ পুণ্যের বিচার এখন মানুষে করে।’ এ ছাড়া তার লেখা ‘যোগী ভিক্ষা ধরো’, ‘আগে জানি নারে দয়াল তোর পিরিতে’- ইত্যাদি আধ্যাত্মিক গান তার সাহিত্য কর্মকে যেন আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। বিখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কবির সহযোগিতায় বেশ কিছু ভাটিয়ালি ও মরমি গান গেয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তিনি বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গানও লিখেছেন। তবে ইসলামি ভাবধারার মরমি গানগুলো কবিকে অমর করে রাখবে। ‘উজান গাঙ্গের নাইয়া’, ‘নদীর কুল নাই কিনার নাই’, ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে’। তার ইসলামি ভাবধারার গানগুলো মুসলিম পাঠক হৃদয়কে দোলা দেয়। পবিত্র জীবনের অনুষঙ্গ জোগায়। কবির ধর্মীয় অনুভূতি কতটা যে প্রকট, তার প্রমাণ মেলে যখন তিনি লিখেন- ‘আমার হাড় কালা করলাম রে/আমার দেহ কালার লাইগা রে।’

জসীম উদ্দীন ‘তারাবি’ কবিতায় ইসলামি উপজীব্যকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। মহিমান্বিত তারাবির অসামান্য কাহিনির হৃদয়ছোয়া বর্ণনা, কবির ধর্মভীরুতা, ধর্মের প্রতি আবেগ ও শ্রদ্ধা কবিতাখানিকে অমর করে তুলেছে। যান্ত্রিক ও নগর সমাজের ধর্ম বিমূখতার রুঢ় চিত্র ফুটে উঠেছে তারাবি কবিতায়।

কবি জসীম উদ্দীনের গীতিকাব্যগুলো বাংলা গানের ঐতিহ্যের এক মূর্তধারক ও বাহক। তিনি ১০ হাজারের বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close