আরিফ মঈনুদ্দীন

  ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ৩৮)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

শফিক সাহেবকে কনুই দিয়ে আলতো করে গুঁতো দিয়ে প্রীতি গলা নামিয়ে বললেন, এ্যাই তুমি বকবক বন্ধ করো তো। গাড়ি চালানোর সময় ড্রাইভারের সঙ্গে এত কথা বলতে নেই।

নিম্নস্বরে বললেও প্রীতির কথা ড্রাইভার শরীফ শুনে ফেলেছে। সে বলল, না ম্যাডাম কোনো সমস্যা নাই- আমাদের কথা বলার অভ্যাস আছে।

প্রীতি ড্রাইভারের কথার উত্তর দেওয়া প্রয়োজন মনে করলেন না। শফিক সাহেবও কথা বলা কমিয়ে দিয়েছেন। শিউলি ফিসফিস করে বলল, আব্বু, আম্মু ঠিকই বলেছে। কথা বলতে বলতে ড্রাইভার অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলবে।

শফিক সাহেব স্নেহের সুরে বললেন, ধুর বোকা মেয়ে, অলক্ষুণে কথা বলিস না তো।

গাড়ি ৩০০ ফিট রাস্তা পেরিয়ে কাঞ্চন ব্রিজে উঠেছে। রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম নেই। টোলপ্লাজায়ও ভিড় হয়নি। শফিক সাহেব ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বললেন, এই রুটে ঢাকা-চট্টগ্রাম রোডে উঠবে কোন দিক দিয়ে।

শরীফ হোসেন বলল, এখন চট্টগ্রাম রোডে ওঠার জন্য এটা ঢাকা শহর বাইপাস রোড। এখান দিয়ে ভুলতা হয়ে মদনপুর দিয়ে আমরা চট্টগ্রাম রোডে উঠব। ভুলতা চৌরাস্তায় সুন্দর একটা ফ্লাইওভার হয়েছে। বামদিকে নরসিংদী-সিলেট, ডান দিকে কাঁচপুর হয়ে ঢাকা। আমরা যাচ্ছি ভুলতা পার হয়ে মদনপুর। এখান দিয়ে আসার কারণে ঢাকা শহরের জ্যামে পড়তে হইল না। স্যার এখান দিয়ে আর বাড়ি যাননি?

আমি তো বিদেশে থাকি। শেষবার এখান দিয়ে গেলাম কি না মনে করতে পারছি না। সেবার রাতে গিয়েছিলাম।

কিছুক্ষণের মধ্যে ভুলতা ফ্লাইওভার পার হয়ে গাড়ি মদনপুরের রাস্তায় উঠেছে। এভাবে সরাসরি গেলেই মনদপুর- ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। বেলা থাকতে থাকতে এই প্রায়-অচেনা জায়গাগুলো পার হচ্ছেন দেখে শফিক সাহেবের ভালো লাগছে। দেখতে দেখতে গাড়ি মহাসড়কে উঠে পড়েছে। ছেলেটা ড্রাইভার হিসেবে ভালো। সুন্দর চালায়। নিজের গাড়ি হওয়ায় যত্ন করে চালাচ্ছে। এতে যাত্রীদেরও আরাম হয়। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দেখে তিনি অবাক হয়ে বললেন, বাহ! বেশ সুন্দর রাস্তা করেছে তো সরকার।

ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে না বললেও শরীফ সায় দিয়ে বলল, এ আর কী সুন্দর দেখছেন স্যার। আসল সুন্দরটা দেখবেন দাউদকান্দি ব্রিজ পার হওয়ার পর। এদিকটা আগের করা তো মেরামত করেছে। তবে স্যার মেঘনা এবং দাউদকান্দি ব্রিজ এখন দুইটা করে চারটা হয়েছে। ব্রিজগুলো ধরেন চারে চারে আট লেইন। দেখতে ভারী সুন্দর! গাড়ি চালাইয়া মহাআরাম।

শফিক সাহেব নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, হুঁম ভালোই বলেছ। যেমন মহাসড়ক তেমন মহাআরাম।

তিনি খুব আগ্রহ নিয়ে চারদিকে সবুজ গ্রাম বাংলা দেখছেন। শেষ বিকেলের রক্তাভ আলোয় কেমন রহস্যময়ী রহস্যময়ী লাগছে প্রকৃতিকে। আরো লাগছে কতই-না আপন। বিদেশ যাওয়ার পর থেকে এবারের মতো করে কখনো দেখেননি নিজের দেশকে। এবার স্বয়ংক্রিয় মেজাজে পুরো দেশ এসে ভর করেছে মাথায়। আর যেহেতু তিনি বিদেশে যাচ্ছেন না, বেড়াতে হয়তো যাবেন সেটা ভিন্ন কথা। এইজন্য নিজের বুকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ। কেমন এক উষ্ণ পরশ থেকে থেকে তার হৃদয়-মন-মননে নরম হাওয়ার আদরের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে। গাড়ি মেঘনা ব্রিজ পার হয়েছে। দাউদকান্দি ব্রিজ পার হয়েছে। তিনি আর কথা না বলে গভীর মনোযোগে এসব দেখছেন এত ভালোলাগা মনের কোণে কীভাবে যে লুকিয়ে ছিল। অবাক হয়ে তিনি তা-ই ভাবছেন। ড্রাইভার তো ঠিকই বলেছে দাউদকান্দি ব্রিজ পার হওয়ার পর রাস্তা তো আরো ভালো লাগছে। আন্তর্জাতিক স্টাইলের রাস্তা হয়েছে। এইজন্য রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট বিভাগকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলেন তিনি।

স্বামীর চেহারার ওপর দৃষ্টিপাত করে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে প্রীতি বলল, কী ব্যাপার তুমি কবি হয়ে গেলে নাকি? তোমার চেহারার ঔজ্জ্বল্য বেড়ে গেছে হঠাৎ। মনে হচ্ছে তুমি সৃজনশীল ভাবনায় আক্রান্ত। ঠিক আক্রান্ত বলা ঠিক হচ্ছে না। ভাবনায় ডুবে আছ মনে হচ্ছে। আনন্দ চেপে রাখা মুশকিল হলে মানুষকে যেমন দেখা যায়- তোমাকে ওরকম লাগছে। আমি কি ঠিক বলেছি? এই যেমন ধরো- মেয়েদের যখন বাচ্চা পেটে হয় তখন শারীরিক পরিবর্তন দেখে বলা যায়। তদ্রূপ কবিদের চেহারা দেখে আসন্ন প্রসব বেদনা টের পাওয়া যায়।

শফিক বললেন, মনে হয় ঠিক বলেছ।

অবশ্যই ঠিক বলেছি। ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি।

শফিক মনোভাবের পাশ কাটিয়ে হালকাভাবে বললেন, ধুর পাগল। এটা আর এমন কী? নিজের দেশে এসেছি। খুশি লাগতে পারে না?

শিউলি পেছন থেকে বলল, আম্মু ঠিকই বলেছ, আব্বুকে অনেক খুশি খুশি মনে হচ্ছে।

শিউলির নাক টিপে দিয়ে শফিক বললেন, আরে মামণি আনন্দে না থাকলে তো বেড়িয়ে মজা নেই। আনন্দে থাকো।

গাড়ি কুমিল্লা বিশ্বরোড পদুয়ার বাজার অতিক্রম করছে। নূরজাহান রেস্টুরেন্ট দেখে শফিক সাহেব বললেন, এ্যাই শরীফ হোসেন, গাড়ি একটু স্লো করো।

শরীফ গাড়ির গতি কমিয়ে দিয়ে বলল, বলেন স্যার। এখানে একটা বড় সড় রেস্টুরেন্ট দেখলাম- নূরজাহান নাম। এখানে থামাও একটু নাস্তা-পানি করি-

ড্রাইভার বলল, এটা না। আরেকটু গেলে আরও ভালো রেস্টুরেন্ট আছে।

শফিক বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে, ওটা সত্যিই ভালো তো?

জি স্যার, আপনাদের নিয়ে যাই। গেলেই তো বুঝতে পারবেন। তারপর খাওয়াদাওয়া করেও বুঝতে পারবেন।

তোমারই তো জানার কথা। ঠিক আছে যাও।

শিউলি মাকে উদ্দেশ্য করে হাসিমুখে ফিসফিস করে বলল, আচ্ছা আম্মি খাওয়াদাওয়া করার পর যদি বুঝতে পারি খারাপ- তখন কি আবার ভালো রেস্টুরেন্ট খুঁজব?

শফিক সাহেব বললেন, আমার মামণি তো সুন্দর বলেছে। সুন্দর কথা বলার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ।

প্রীতি বললেন, আচ্ছা ভালো কথা। বাড়িতে খবর দিয়েছো তো? ঘরটা পরিষ্কার-টরিষ্কার করে রাখার জন্য।

শফিক বললেন, ওটা চিন্তা কোরো না। ভাইজানের সঙ্গে কথা হয়েছে- এরই মধ্যে সব ঠিকঠাক করা হয়ে গেছে। শুধু তোমাদের বাড়িতে খবরটা দিইনি ইচ্ছা করে। একটু সারপ্রাইজ দেব ভাবছি। তুমি তো বলোনি নিশ্চয়ই?

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close