বাসার তাসাউফ

  ২৫ অক্টোবর, ২০২৪

সুনীলের প্রথম কবিতা

বাল্যকালে অনেকেরই যেমন আকাঙ্ক্ষা থাকে বড় হয়ে লেখক হবে, তেমন কোনো আকাঙ্ক্ষা ছিল না সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। একটু একটু ইচ্ছে ছিল- বড় হয়ে ভূপর্যটক হবেন। এই ইচ্ছেটা হয়েছিল মূলত সে সময়ের কয়েকজন লেখকের গল্প পড়ে। তখন ম্যাট্রিক পরীক্ষা ছিল। ম্যাট্রিক পরীক্ষার ফল বের হতে তিন মাস সময় লাগত। এ তিন মাস সময়ে সুনীলের বাবা... তাকে বাড়ি আটকে রাখার জন্য একটি প্ল্যান করলেন। ...মহাশয়ের ধারণা ছিল- ছেলেটা দুপুরবেলা বাড়ির বাইরে বের হলে কুসঙ্গে পড়বে, বখে যাবে, বিড়িফিড়ি খেতে শিখবে। ...বাড়িতে টেনিসনের কাব্যসংগ্রহ ছিল। বইটি সুনীলের হাতে দিয়ে রোজ দুটো করে কবিতা অনুবাদ করতে বললেন তিনি। বাবাকে বেশ ভয় পেতেন সুনীল। তার নিষেধ অমান্য করার সাহস ছিল না। অগত্যা বসে বসে টেনিসনের কবিতা অনুবাদ করতে লাগলেন। তখন সুনীলের বয়স পনের কিংবা ষোলো বছর। দুয়েক দিন অনুবাদের সেই বিরক্তিকর কাজটি করার পর তার মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি এলো। ...অনুবাদগুলো মিলিয়ে দেখতেন না। শুধু টেনিসনের কবিতার লাইন আর সুনীলের অনূদিত লাইনগুলো গুণে গুণে টিক মেরে দিতেন। সুনীল ভাবলেন- যেহেতু বাবা কবিতা মিলিয়ে দেখেন না, তাহলে এত কষ্ট করা কেন? এর পরদিনই টেনিসনের কবিতার প্রথম লাইনটার মতো মোটামুটি মিল রেখে বাকিটা সুনীল বানিয়ে লিখলেন। কাজটি একেবারে সহজ মনে হলো তার কাছে। এভাবেই প্রথম কবিতা লেখা হয়ে উঠেছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের। সেই সব কবিতা কিন্তু সুনীল কোথাও সংকলন করেনি, এমনকি কোথাও ছাপতেও দেননি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল বিখ্যাত ‘দেশ’ পত্রিকায়। তখন বন্ধুর বোনদের সঙ্গে মেলামেশার সুযোগ খুব একটা ছিল না। একজন বন্ধুর বোনের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল সুনীলের। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারতেন না। দেখা হয়, কথা হয়, কিন্তু ভেতরে ভেতরে বিশেষ কিছু যে একটা ব্যাপার আছে, সেটি বলা হয়ে উঠে না। শেষে একটি বাঁকা পথ বেছে নিতে হলো। বন্ধুর সেই বোনকে উদ্দেশ্য করে লিখে ফেললেন একখানি চিঠি। তারপর ভাবতে লাগলেন, চিঠি মেয়েটির হাতে দেবেন কী করে? হাতে হাতে দেওয়ার সাহস হয় না। ডাকে পাঠালে বাড়ির অন্য কেউ সেটি খুলে ফেলতে পারেন। উপায়ন্তর না দেখে ‘একটি চিঠি’ শিরোনাম দিয়ে ‘দেশ’ পত্রিকায় পাঠিয়ে মনের কোণে সুপ্ত বাসনা নিয়ে বসে রইলেন, যদি ছাপা হয় তাহলে মেয়েটি হয়তো পড়বে। তখন ‘দেশ’ পত্রিকা রাখা হতো মেয়েটির বাড়িতে। কিন্তু কবিতা পাঠালে যে ‘দেশ’-এ ছাপা হয় না, সে কথা কিন্তু সুনীল জানতেন না। তাকে অবাক করে দিয়ে সম্পাদক সেই কবিতা ছেপে দিলেন, সময়টা ১৯৫১ সালের। তখন ‘দেশ’ পত্রিকায় বিখ্যাত লেখকদের গল্প ও প্রবন্ধ ছাপা হতো বেশি। কবিতা তেমন ছাপা হতো না। দুয়েকটি ছাপা হতো, তাও বড় কোনো লেখার তলায়। কোথাও হয়তো প্রবন্ধ শেষ হয়েছে, তলায় খানিকটা জায়গা বের হলো, সেখানে একটি কবিতা বসে গেল। এজন্যই বোধ হয় অচিন্ত্যকুমার সেন ঠাট্টা করে বলেছিলেন, ‘গদ্যের পাদদেশে স্থান হয় বলে কবিতার আরেক নাম পদ্য।’

‘দেশ’-এ ছাপা হয়ে গেল সুনীলের প্রথম কবিতা, কবিতার আদলে আসলে সেটি একটি চিঠি। মেয়েটি পড়ল সেই কবিতা (চিঠি)। কিন্তু এটি যে তার ভাইয়ের বন্ধু সুনীলের লেখা, তা আর বিশ্বাস করল না। মেয়েটি জানাল, সুনীলের নামের সঙ্গে মিলে গেছে কবির নাম।

বলাবাহুল্য, মেয়েটির কবিতার দিকে বিশেষ মনোযোগ ছিল। কথায় কথায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে এমন কিছু পঙ্ক্তির উদ্ধৃতি দিত, যা সুনীল আগে কখনো পড়েননি। পরে খুঁজে খুঁজে সেই কবিতা পড়ে নিতেন। মেয়েটির কাব্যের প্রতি মনোযোগ ছিল বলে সুনীল মুগ্ধ হতেন। তার মনোযোগ নিজের দিকে টেনে আনতেই কবিতায় আশ্রয় নিয়েছিলেন সুনীল। যদি মেয়েটির খেলাধুলায় উৎসাহ থাকত সুনীল বোধহয় খেলোয়াড়ই হতেন। এভাবেই লেখা হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম কবিতা।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close