রুখসানা কাজল
নিরীক্ষামূলক গদ্যের উদ্ভাবক হান কাং
দক্ষিণ কোরিয়ার কথাসাহিত্যিক হান কাং এ বছর সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন। তিনি বিশ্বের ১২১তম এবং এশিয়ার প্রথম নারী লেখক। তাকে নিয়ে আয়োজন
হান কাং-এর শুরু কবিতা দিয়ে। এরপর হান নদীর মতোই তিনি বয়ে গেছেন কথাসাহিত্যের মহাসমুদ্রে। ১৯৯৩ সালে প্রথমবার মুনহাকগুয়া-সাহো (লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি)-এর শীতকালীন ইস্যুতে পাঁচটি কবিতা দিয়ে তিনি সাহিত্যসমুদ্রে যাত্রা আরম্ভ করেন। এগুলোর মধ্যে হানের সেই বিখ্যাত ‘উইন্টার ইন সোল’ কবিতাটিও ছিল। তখন বয়স মাত্র ২৩। জন্মেছেন সাহিত্যমোদী পরিবারে। বাবা হান সাং উন একজন শিক্ষক এবং ঔপন্যাসিক। পরে শিক্ষকতা ছেড়ে তিনি সার্বক্ষণিক লেখায় মনোযোগ দেন। বড় ভাই হান ডং রিম সাহিত্যচর্চার সঙ্গে যুক্ত। তিনিও একজন ঔপন্যাসিক। ছোট ভাই হান কাং ইন কার্টুনিস্ট হলেও লেখালেখির জগতেই তার বিচরণ। আর যদিও বিচ্ছেদ হয়ে গেছে; তবু হান কাং-এর স্বামী হং ইয়ং হি ছিলেন কিউয়িং সাইবার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এবং একজন সাহিত্য সমালোচক। এমন একটি পরিবারের মেয়েকে সাহিত্যচর্চাই করতে হবে, এটা অমোঘ ছিল না। বা বাস্তবে এমন দেখাও যায় না। কিন্তু হান যেন সাহিত্যে চর্চা করবেন বলেই জন্মেছেন। তার মনের ভেতর উথলে ওঠা প্রশ্নগুলোই তার লেখা হয়ে বেরিয়ে আসছে বিভিন্ন কবিতা-গল্প-উপন্যাসে।
দক্ষিণ কোরিয়ার গুয়াংজু শহরে ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর জন্ম হয় হান কাং-এর। এই সেই গুয়াংজু। যেখানে ১৯৮০ সালে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্র-শিক্ষক এবং বেসামরিক জনগণের ওপর কোরিয়ার ক্ষমতাসীন সরকার নির্মম গণহত্যা শুরু করেছিল। বলা হয়ে থাকে, শৈশব শ্লেটের মতো। হ্যানের যখন ৯-১০ বছর, তার বাবা গুয়াংজু ছেড়ে চলে আসেন সিউলের সিয়ারু শহরে। ১২ বছর বয়সে হান পারিবারিক অ্যালবাম ঘাটতে গিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের তোলা ছবি এবং খবর থেকে ভালো করে জানতে পারেন গুয়াংজুর গণহত্যা সম্পর্কে। এ ঘটনা তার মনকে গভীরভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলে। এই যে এখন বিশ্বব্যাপী বোদ্ধা সমালোচক, প্রিয়তমাসু পাঠকরা জানাচ্ছেন- হানের গদ্য হচ্ছে কবিতার মতো গীতিময় কিন্তু রূপক হিসেবে তিনি ব্যবহার করেছেন সহিংসতা, শোক এবং পিতৃতন্ত্রের মতো বিষয়। সে কি গুয়াংজুর আন্দোলনরত মৃত এবং জীবিতদের কঠিন প্রভাব তার লেখালিখির ওপর ভর করেছে বলে!
১০ অক্টোবর হান কাং সাহিত্যে নোবেল পাওয়ার পর আনা কারিন পাম, সাহিত্যে নোবেল কমিটির একজন সদস্য হান সম্পর্কে খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং মনে রাখার মতো কথা বলেছেন। তিনি বলেন, সাহিত্যিক হানকে পাঠ করতে চাইলে প্রথমে তার ‘হিউমেন অ্যাক্টস’ দিয়ে শুরু করা দরকার।
কেন বললেন তিনি এ কথা?
কারণ সাহিত্য মনোরঞ্জনের মতো রিনিকঝিনিক ব্যাপার হলেও তার প্রভাব যুগ যুগান্তর ইস্তক বহমান। পাম ‘হিউমেন অ্যাক্টস’ উপন্যাসটি নিয়ে আরো বলেছিলেন, জীবিত এবং মৃতরা পরস্পর সংযুক্ত থাকে এবং এক প্রজন্মের পাওয়া আঘাত, অন্যায় অপমান, বঞ্চনার দুঃখ-পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যেও নিহত থাকে। নোবেল কমিটির সভাপতি হানের ‘হিউমেন অ্যাক্টস’ উপন্যাসকে তাই একটি ‘সাক্ষ্য সাহিত্য’ হিসেবে অ্যাখ্যা দিয়েছেন। এই উপন্যাসে ব্যক্তি এবং সমষ্টির যন্ত্রণা ফুটে উঠেছে। ধ্বনিত হয়ে উঠেছে গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলনরত নিহত, আহত এবং জীবিত গুয়াংজুবাসীদের মুক্তপ্রাণের তীব্র আহ্বান। ঘৃণা ছুটে বেরিয়েছে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। হান কাং-এর গদ্য তাই কোমলে গীতিময়। কঠোরে তীব্র নৃশংস। সাহিত্যের এটাই তো শক্তি আর তার প্রভাব অনন্ত অক্ষয় কাল নিরবধি। তাই তো ১০ বছরের বালিকা বয়সে গুয়াংজু থেকে বেরিয়ে আসা ১২ বছরের কিশোরীর পারিবারিক অ্যালবাম থেকে জানা গুয়াংজুবাসীর আন্দোলন হান তো ভোলেননি! পরবর্তী প্রজন্মকেও তিনি তার লেখায় সুকৌশলে জানিয়ে দিলেন ইতিহাস মুছে ফেলা যায় না। মুছতে হয় না। তাতে জাতির সম্মান খর্ব হয়। জাতি হয়ে উঠে পরজীবী। আর তাই হান কাং-এর নোবেল জিতে নেওয়ার প্রসঙ্গে নোবেল কমিটি জানায়, The Nobel Prize in Literature 2024 was awarded to Han Kang for her intense poetic prose that confronts historical traumas and exposes the fragility of human life। অর্থাৎ তার প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য ঐতিহাসিক আঘাতের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় এবং মানবজীবনের ভঙ্গুর বিচ্যুতিকে উন্মোচন করে দেয়।
লেখক হান কাং তাই অনন্য। তার লেখায় কাল চিরন্তন অনন্ত অসীমের স্বর ধ্বনিত হয়। অশুভের বিরুদ্ধে তার গদ্য যতখানি কোমল, ঠিক ক্ষমতার নিষ্ঠুরতা এবং নৃশংসতার বিপক্ষে তার চেয়েও বেশি ধারালো, আগুনে তরবারি। যে কারণে সুইডিস একাডেমি হানের লেখার প্রশংসা করে বলেছে, হান তার লেখায় শরীর এবং আত্মা, জীবিত এবং মৃতের মধ্যে সংযোগ স্থাপন সম্পর্কে এক অনন্য সচেতনতা সৃষ্টি করেছেন। তার লেখার শৈলী সমসাময়িক গদ্যের ক্ষেত্রে পরীক্ষামূলক উদ্ভাবকের কাজ করছে।
১৯৯৩ সালে হানের কবিতা প্রকাশের পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯৪ সালে হান একটি ছোটগল্প, ‘দ্য স্কারলেট অ্যাংকর’ লেখেন এবং এটি সিউল শিনমুন বসন্ত সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার অর্জন করে। এই গল্পের মাধ্যমে হান কথাসাহিত্যের জগতে পা রাখেন। এরপর ১৯৯৫ সালে হানের ‘লাভ অফ ইয়েসু’ নামে গল্প সংকলন প্রকাশিত হয় এবং নিটোল সংঘবদ্ধ বর্ণনা রীতির জন্য বিজ্ঞজনের মনোযোগ আকর্ষণ করে। এরপর কোরিয়ার আর্ট কাউন্সিলের সহযোগিতায় ১৯৯৮ সালে তিনি লেখালিখি বিষয়ে আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিন মাসের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কর্মসূচিতে যোগ দিয়েছিলেন।
অর্থাৎ একজন সিরিয়াস লেখক হিসেবে নিজেকে বেশ তৈরি করেই নিয়েছেন তিনি। নোবেল পুরস্কার কমিটির পক্ষ থেকে জেনি রাইডেন হানের সঙ্গে তার লেখালিখি সম্পর্কে কথা বলেছেন। তিনি হানের কাছে জানতে চেয়েছেন, তার লেখালিখি বিষয়ে কার প্রভাব সবচেয়ে বেশি? হান এর উত্তরে বলেন, কোনো একক কবি, লেখক সাহিত্যিক নন। তার লেখালিখির ওপর রয়েছে অনেক কবি এবং লেখকের প্রভাব। তাদের যাবতীয় প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিই আমার প্রেরণা।
দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার সাক্ষাৎকারে হান কাং জানান, তিনি বেড়ে উঠেছেন বইভর্তি একটি পরিবারে। ‘আমার কাছে বই ছিল অর্ধজীবিত প্রাণীদের মতো। যারা ক্রমাগত তাদের সীমানা বাড়িয়েছে এবং প্রসারিত করে আমাকে ঘিরে থেকেছে।... আশপাশে বন্ধুত্ব করার আগে প্রতি বিকেলে আমার সঙ্গে থাকত বই।’
হানের ছোটবেলা কেটেছে কোরিয়ান শিশুসাহিত্যিকদের বই পড়ে। কৈশোরে পড়েছেন রুশ সাহিত্য। বড় হয়ে বিশ্বসাহিত্যের অন্য লেখক-সাহিত্যিকের যে বই তিনি পেয়েছেন, তাই পড়েছেন। এভাবে বই পড়ে তিনি নিজেকে গড়ে তুলেছেন।
এবার আসি আন্তর্জাতিক সাহিত্য মহলে হান কাং কীভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন সে প্রসঙ্গে। হানের লেখা ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন ডেবোরা স্মিথ। ডেবোরা স্মিথ ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন স্নাতক এবং কোরিয়ান ভাষাসাহিত্যের সফল ব্রিটিশ অনুবাদক। সে সময় আন্তর্জাতিক সাহিত্য অঙ্গনে কোরিয়ান সাহিত্যের তেমন অনুবাদ না ছিল না। ২০০৯ সালে ডেবোরা কোরিয়ান ভাষা শিখতে শুরু করেন। এরপর হান কাং-এর উপন্যাস ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যে ইংল্যান্ডে এবং ২০১৬ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বইটির ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয়। বলা চলে ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ আন্তর্জাতিক সাহিত্য মহলের পাঠক, সমালোচক এবং সাহিত্য বোদ্ধারা বেশ সমাদরে গ্রহণ করেন। কী ছিল দ্য ভেজিটেরিয়ান উপন্যাসে?
এই উপন্যাসের মূল নারী চরিত্র অনেকটা কাফকায়েস্কি ধরনে বিবর্তিত। একজন অতিসাধারণ স্বল্পভাষী কর্মরত, সংসারী নারীর হঠাৎ মাংসের প্রতি বিরাগ থেকে কীভাবে নিরামিষাশী হয়ে ওঠেন সেই পর্যায়গুলোর চমৎকার বর্ণনা ফ্রানৎ কাফকার ‘মেটামরফোসিস’-এর গ্রেগরের কথা কিছুটা হলেও মনে করিয়ে দেয়। পাঠক আপ্লুত হন ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এ। একই সঙ্গে বিদগ্ধজনদেরমুগ্ধতা, সমালোচকদের মনপ্রিয়তা অর্জন করে উপন্যাসটি। ফলে ২০১৬ সালে হান কাং এবং অনুবাদক হিসেবে ডেবোরা স্মিথ ‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’ উপন্যাসের জন্য সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ এবং সম্মানিত ম্যান বুকার পুরস্কার অর্জন করেন। যদিও মূল কোরিয়ান ভাষায় যারা উপন্যাসটি পড়েছেন তারা অনুবাদে ‘প্রচুর বিচ্যুতি’ ঘটেছে বলে দাবি করেন। ডেবোরা সমস্ত অভিযোগ মেনে নিয়ে উত্তর দেন, ‘আমার অনুবাদে “দ্য ভেজিটেরিয়ান” সম্পূর্ণ ভিন্ন বই মনে হলেও আমি বলতে চাই- সত্যিকার অর্থে আক্ষরিক অনুবাদ বলে কিছু নেই- কোনো দুটি ভাষার ব্যাকরণ সব সময় মেলে না, তাদের শব্দভাণ্ডার আলাদা হয় এমনকি বিরাম চিহ্নগুলোরও আলাদা ওজন থাকে- অনুবাদ বলে এমন কোনো জিনিস হতে পারে না, যা সৃজনশীল নয়।’
‘দ্য ভেজিটেরিয়ান’-এর লেখক হান কাং স্বয়ং ডেবোরা স্মিথের পক্ষে সমর্থন দেন। ডেবোরা হান কাং-এর ‘হিউম্যান অ্যাক্ট’ (২০১৬), হোয়াইট বুক (২০১৭) এবং কোরিয়ান সাহিত্যিক এবং শিল্প অনুবাদক এমিলি ইয়া উনের সঙ্গে ‘গ্রিক লেসন্স’ (২০২৩) বইটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন।
এত অল্প বয়েসে নোবেল পাওয়ায় অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তবে হান কাং অতিমানবীয় কেউ নন। নিরবচ্ছিন্নভাবে লিখে চলেছেন বলে তিনি কখনো রাইটিং ব্লকের শিকার হননি এমনও নন। মাদ্রিদ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় হান জানান, তিনিও লেখা বন্ধ করে গোটা একটি বছর বসে ছিলেন। কেন? এর উত্তরে বলেন, তিনি সে সময় আন্তরিক ছিলেন বলেই লিখতে পারেননি। অর্থাৎ এ কথা ধ্রুব যে, লেখালিখি করতে গেলে লেখককে সততায় আন্তরিক এবং অবশ্যই নিমগ্ন থাকতে হবে।
হান শুধু যে একজন লেখক-ঔপন্যাসিক তা নয়। তিনি কবিতার মতো সংগীত ভালোবাসেন। নিজে গান লেখেন, চর্চা করেন এবং গেয়েছেনও। সংগীত নিয়ে দীর্ঘদিনের সাধনা রয়েছে। তার নিজের গাওয়া গানের রেকর্ড রয়েছে A song singing camly নামে। ভবিষ্যতে গান নিয়ে আরো কিছু করার ইচ্ছে রয়েছে তার। ইউটিউবে তার যে গানগুলো শোনা যায় সেগুলো হলো- ভোরের গান, যদিও বলেছিলাম বিদায়, গাছ ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য, নোবেল পাওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত গানের গ্রুপ বিটিএসের সদস্যরা হানকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বিখ্যাত কোরিয়ান চলচ্চিত্র সমালোচক লি ডং জিন হানকে জানিয়েছেন উষ্ণ শুভেচ্ছা।
এটি দক্ষিণ কোরিয়ার দ্বিতীয় নোবেল পুরস্কার অর্জন। দক্ষিণ কোরিয়ার রাষ্ট্রপতি হান কাং-এর নোবেল জয়ে গর্বে উদ্বেলিত হয়ে বলেছেন, ‘দক্ষিণ কোরিয়ার সাহিত্য ইতিহাসে এটি একটি মহান অর্জন।’ তিনি আরো বলেন, Han has turned the painful scars of our Modern history into great literature।
এশিয়ার প্রথম নোবেলজয়ী নারী লেখক তিনি। তামাম এশিয়ার প্রস্ফুটিত গোলাপ ঔপন্যাসিক হান কাং-এর আগামী উপন্যাস ‘উই ডু নট পার্ট’-এর জন্য আগাম শুভেচ্ছা।
"