আরিফ মঈনুদ্দীন

  ০৪ অক্টোবর, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ৩৫)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

না দোস্ত, চা খাব না। আমি গিয়ে তোকে ফোন দেব। আমার গাড়িটা তোদের পার্কিংয়ে রেখে তোর গাড়িতে যাব। অথবা দুজন আমার গাড়িতেও যেতে পারব।

আচ্ছা তুই আয়। আমার গাড়িতেই যাব।

ইদ্রিস আলী হাওলাদারের অ্যাপার্টমেন্টের নিচে এসে শফিক ফোন করল।

হাওলাদার বলল, অপেক্ষা কর। আমি নামছি।

ইদ্রিস আলীর গাড়িতে দুই বন্ধু রেজিস্ট্রি অফিসের দিকে রওনা হয়েছে। ইদ্রিস আলী বললেন, দোস্ত সব তো ভালোয় ভালোয় হয়ে যাচ্ছে, দেশে যাচ্ছিস কবে?

ভাবছি অক্টোবরেই যাব। আজ তো সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ। কালই ফ্লাইট দেখে টিকিট করে ফেলব। মেয়ের মা আর মেয়ে তো আমার শ্বশুরের কল্যাণে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়েই আছে। আমি আজ রাতে ওদের সঙ্গে আলাপ করে সময় ঠিক করে নেব।

দুই বন্ধু সব কাজ শেষ করে দুপুরে ইদ্রিসের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরে এসেছে। ইদ্রিস বলল, এক কাজ কর। আমার বাসায় চল। লাঞ্চ করে যা। ১টা তো বেজেই গেল।

রেজিস্ট্রি শেষ হওয়ার পরে শফিকের মনটা হঠাৎ কিছুটা খারাপ হয়েছিল। এই খারাপ ভাবটা সে লুকানোর চেষ্টা করেনি। ইদ্রিস সান্ত¡না দিয়ে বললেন, এখন তোর মন একটু খারাপ হতেই পারে। এটা অস্বাভাবিক না। এতদিনের বসবাস। এত শত-হাজার লক্ষ পদচিহ্ন মায়া তো পড়তেই পারে। তারপরও মানুষের চাওয়াটাকেই বিজয়ী করতে হয়- এটাই মানব ধর্ম।

তোর কথা ঠিক আছে। মায়া তো পড়েছে, তারপরও আমাকে কে যেন দেশের দিকেই টানছে- মেয়ের কাণ্ডকারখানাটা একটা উসিলাও হতে পারে। এমনি এমনি তো আর আমি এত দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতাম না। এমন একটা কাণ্ড ঘটেছে যে, আমাকে এক পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে দিয়ে দৌড়ের রেসের রেফারির মতো বাঁশিটা তোর ঠোঁটে তুলে দিয়েছে।

দোস্ত তা যা বলেছিস- এ না-হলে প্রফেসর। অবশ্য এমন কথা তো ভাবির মুখ থেকে শোনা যায় বেশি। তিনি যে বাংলার পণ্ডিত।

শফিক ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটিয়ে বললেন, আমি আর কম যাব কেন। আমি তো সেই পণ্ডিতেরই স্বামী। আচ্ছা চল তোর বাসা থেকে এবারের মতো শেষ খাওয়াটা খেয়ে যাই। ধুর শালা, অলক্ষুণে উচ্চারণের মতো শেষ খাওয়া বলছিস কেন?

আরে আমি এবারের মতো বলছি।

ও হ্যাঁ, তা-ই বলছিস।

আচ্ছা তোকে বলেছিলাম বিষয়টা টপ সিক্রেট- মনে আছে তো। আবার খুশির ঠেলায় ভাবির সামনে কিছু বলে ফেলিস না।

তা মনে আছে। তুই চিন্তা করিস না। এটা গোপনই থাকবে, তুই যতদিন চাস ততদিন।

ইদ্রিস আলী হাওলাদারের বাসায় লাঞ্চ সেরে শফিক আর দেরি করেনি। বাসায় গিয়ে ওদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে হবে। তার আগে একটি আবহ তৈরি করা প্রয়োজন। হুট করে বলার চেয়ে চা-নাশতা খেয়ে ধীরেসুস্থে মেজাজ মর্জিতে ইতিবাচক অবস্থান বিবেচনা করে কথা শুরু করতে হবে। শ্বশুর-শাশুড়ির মতামতকে প্রাধান্য দিয়ে বাড়ি যাওয়ার প্ল্যান করছে- এ কথাই গুরুত্ব পাবে।

শফিক সাহেব লিফট থেকে নেমে বাসার দরজার সামনে থামলেন। আজ আর চাবি দিয়ে দরজা খুলবেন না। অনেক দিন পর বাসার কলিংবেল বাজাতে ইচ্ছে করছে। তিনি বেল বাজাবেন। প্রীতি এসে দরজা খুলে দেবে। একটু কেমন যেন ভালোও লাগবে। ভাবতে ভাবতে তিনি কলিংবেলে আঙুল ছোঁয়ালেন, ভদ্রভাবে বেলটা চাপলেন। একটি মিষ্টি আওয়াজ হলো। ভেতর থেকে কোনো সাড়া-শব্দ পাচ্ছেন না। মিনিটখানেক পরে আবার বাজালেন।

ভেতর থেকে ‘কে এসেছেন’- বলতে বলতে প্রীতি এগিয়ে এলো। আইভিউয়ারে চোখ রেখে প্রীতি হাসতে হাসতে দরজা খুলে বলল, কী ব্যাপার, আজকে একেবারে অতিথি হয়ে গেলেন যে?

শফিক সাহেব মেজাজকে খোশ মেজাজের স্কেলে তুলে দিয়ে বললেন, বেশ তো তাহলে আজ একটু বেশি বেশি অতিথি সেবা শুরু করো।

বেলের আওয়াজ শুনে শিউলিও রুম থেকে বেরিয়ে এসেছে। বাবাকে দেখে সে একটু অবাক হলো। বাবা তো স্বভাবত বেল বাজিয়ে ঘরে ঢোকেন না। সে নিজের মনে কিঞ্চিৎ প্রমাদ গুনল। তাহলে কি বাবা তার দড়িধরা হাতটা রিলাক্স করে দিয়েছেন। এটা কি তার প্রতি অব্যাহত সমর্থনের আরো এক মাত্রা ছাড়? থাক! তিনি যা-ই মনে করুক। সে তার কাজ চালিয়েই যাবে।

শিউলিকে দেখে শফিক সাহেব বললেন, আয় রে মা। আজ তোর আম্মি আমাদের ভালো নাশতা খাওয়াবেন। তুইও কাজে লেগে পড়। ভালো নাশতার আয়োজনও তো বেশি- বেচারিকে একটু সাহায্য-সহযোগিতা কর।

শিউলিও খুশিখুশি গলায় বলল, কোনো অসুবিধা নেই আব্বু, আমরা তিনজন মাত্র মানুষ আয়োজন যত বড়ই হোক কষ্টের তো নয়ই।

শফিক সাহেব দেখলেন, ওরা মা এবং মেয়ে দুজনেরই মন-মেজাজ ভালো। কথা বলে আরাম পাওয়া যাবে। তিনি নিজের কক্ষে গিয়ে চেঞ্জ-টেঞ্জ করে ঘরের ড্রেস পরলেন। ধীরেসুস্থে ড্রইংরুমে এসে বসলেন। পত্রিকা হাতে নিয়ে ভাবছেন ডাইনিং টেবিলেই কথাটি তুলবেন। পত্রিকায় চোখ থাকলেও পড়ায় মন নেই। কখন ওরাসহ নাশতার টেবিলে বসবেন এরই প্রতীক্ষা চলছে মনে মনে। ভাবতে ভাবতে তিনি কিচেনে উঁকি মেরে বললেন, কই মহামান্য গিন্নি- কী নাশতা তৈরি হচ্ছে? জিহবায় কীসের স্বাদ জাগিয়ে অপেক্ষা করব একটু বলো-টলো না।

প্রীতি বললেন, আপাতত একটা স্যান্ডউইচ দিচ্ছি। তারপর দেখি আর কী করা যায়।

আচ্ছা সেমাই খেতে ইচ্ছে করছে। পারলে ওটা একটু করো। তারপর তোমার ঐতিহাসিক চা। ওতেই চলবে। তাড়াতাড়ি ডাইনিং টেবিলে আসো, কথাবার্তা আছে।

কথাবার্তা আর কী বলবে? ঘরের না বাইরের?

প্রীতির কথার টোন শুনে শফিকের বুঝতে কষ্ট হয়নি, সে কী বোঝাতে চাচ্ছে। তিনি হাসিমুখে বললেন, আরে না। আমাদের ঘরের কথা। ওই যে বাবা বললেন না দেশে যাওয়ার কথা। এসো দেখি, আলাপ করি কবে যাওয়া যায়।

প্লেটে স্যান্ডউইচ সাজাতে সাজাতে প্রীতি বললেন, হ্যাঁ তাইতো। ব্যবস্থা করে ফেলো। আর দেরি করব না। এবার যাবই। শিউলিরও মন ছুটেছে। শুধু বাড়ি না সে বাংলাদেশও দেখবে। মেয়ের ভেতর বাংলা ঢুকিয়ে দিয়েছি ভালোভাবে। ভালো বাংলা জানার এটাও একটি সুবিধা। দেশের প্রতি মমতা জন্মে, ভালোবাসা তৈরি হয়।

শফিক সাহেব খোশ মেজাজে বললেন, এই একটি বিষয়ে আমার ধন্যবাদের শতভাগ তোমার জন্য বরাদ্দ। আর যা কিছু করো-না-করো এটা ভালো করেছ। এখানের অভিবাসীদের এই বয়সের ছেলেমেয়েরা বাংলা তো জানেই না, বরং না-জানাটাকে গর্বের মনে করে। কত বড় আহাম্মকের দল। অবিশ্যি ওদের আর কী দোষ দেব। এই জন্যে তো ওদের গার্জেনরাই দায়ী। তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে ব্রিটিশদের লেজ ধরে ঝুলে থাকবে। আর লেজ ধরে ঝুলে থাকলে পরিণাম কী হয় জানো তো। গাভীর লেজ- গো মল আর গো মূত্র দুটোই সমানতালে ভাগ্যে জোটে।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close