আরিফ মঈনুদ্দীন

  ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

উপন্যাস (পর্ব ৩৪)

তাহারা ফিরিয়া আসিলেন

প্রীতি ফোনটা হাতে নিয়ে প্রায় কান্নার সুরে সালাম দিয়ে বললেন, বাবা সরি আমার ফোনটা সাইলেন্ট করা ছিল। তোমরা কেমন আছ বলো।

কেমন আর থাকব। শরীর বেশি ভালো না। তোরা এলে আমার শরীর ভালো হয়ে যাবে। কতদিন থেকে বলছি- দেশে আয় দেশে আয়। কে শোনে কার কথা। আমি কিন্তু এবার রাগ করব। এবার যদি তোরা বাড়ি না আসিস- আমি আর কখনো ফোন করব না।

প্রীতি বললেন, আচ্ছা বাবা, তোমার রাগ করা লাগবে না। আমরা এবার অবশ্যই বাড়ি আসছি। শফিককে আমি আরো আগে থেকে সময় বের করতে বলেছি। এবার ইনশাআল্লাহ দেখা হবে।

আচ্ছা ঠিক আছে। আবার যেন ভুলে না যাস। আমার নানুভাইকে দে, কোথায়? ও যে কী চমৎকার বাংলা বলে। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনি। মা তোকে এই একটি বিষয়ে বাড়তি ধন্যবাদ। তুই আমার নাতনিকে বাংলা শিখিয়েছিস, ওকে ডাক।

বাবা তুমি লাইনে থাকো। আমি ওকে ডাকছি।

শিউলিকে ডেকে বললেন, এই শিউলি- নে কথা বল। তোর নানুভাইয়া ফোন করেছেন।

ফোনটা কানে লাগিয়ে শিউলি খুব সুন্দর করে নানুকে সালাম দিল। সালামের জবাব দিয়ে খান সাহেব উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠে বললেন, বাহ! বাহ! নানু কী চমৎকার উচ্চারণে সালাম দিল। আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এবার বলো আমাকে দেখতে কখন বাংলাদেশে আসছো।

শিউলি বলল, নানুভাইয়া তুমি কেমন আছ।

আমি ভালো নাইরে ভাই। তোমরা এলে আমি ভালো হবো। তুমি হলে গিয়ে আমার ডাক্তার, তোমার মুখ দেখা হলো গিয়ে আমার ওষুধ। কবে আমাকে মুখ দেখাবা।

আমি আম্মিকে বলছি। আম্মু যখন আসবে আমিও আসব।

খান সাহেব বললেন, তোমার আম্মু তো বলেছে এবার অবশ্যই আসবে।

আম্মু যখন বলেছে অবশ্যই আসবে। তাহলে আমিও বলছি- অবশ্যই আসব।

আমাদের তোমার দেখতে ইচ্ছে করে না?

হ্যাঁ অবশ্যই দেখতে ইচ্ছে করে। বাংলাদেশকেও দেখতে ইচ্ছে করে। কী সুন্দর আমাদের দেশ!

তাহলে এটাই শেষ কথা। তুমি অবশ্যই এবার আমাকে দেখতে আসছো।

জি নানুভাই। ধরো, আম্মুর সঙ্গে কথা বলো।

প্রীতি ফোন হাতে নিয়ে বলল, বাবা মাকে একটু দাও, কথা বলি।

প্রফেসর শফিক সাহেব দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা-নাতনির সংলাপ শুনছিলেন। মনে মনে তিনি এটাই আশা করেছিলেন। তিনি যা চাচ্ছেন তা-ই কার্যত ফলে যাচ্ছে। দেশ থেকে তিনি কেমন যেন একটা আবাহন অনুভব করছেন। বাংলাদেশ তাকে ডাকছে। কী আবদার নিয়ে দেশ তার দিকে হাত বাড়ায়- এটাই এখন দেখার বিষয়। প্রকৃতি তার মানুষকে নিয়ে একধরনের খেলায় মাতে। এই খেলায় প্রকৃতি মানুষকে বিজয়ীও করে। এবার প্রফেসর শফিক সাহেবের বিজয়ী হওয়ার পালা। এই মুহূর্তে তার মনের অবস্থা ভীষণ রকম ভালো। এখন ইদ্রিসের সঙ্গে কথা বলতে মন চাইছে। তিনি ফোনসেটের জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রীতি কথা বলছে তার মায়ের সঙ্গে। সংলাপ শুনে বোঝা যাচ্ছে। মায়েরও ওই একটিই বায়না দেশে যেতে হবে। তাদের কথা শুনে শফিক সাহেবের আনন্দে আরও একমাত্রা যোগ হলো।

প্রীতি কথা শেষ করে সেলুলার সেটটা শফিকের হাতে দিল। শফিক ইদ্রিসকে ফোন দিয়ে নিজের পড়ার রুমে ঢুকে দরজাটা চেপে দিল।

হ্যালো দোস্ত, তুই কি ফ্রি আছিস? একটু কথা বলব।

ইদ্রিস উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলল, অবশ্যই ফ্রি আছি দোস্ত। তোর সঙ্গে কথা বললে তো আমি উজ্জীবিত হই। বল কেমন আছিস? এদিকের সব কাজ কিন্তু গুছিয়ে ফেলেছি। কালই রেজিস্ট্রি করে ফেলব।

শফিক প্রসন্ন কণ্ঠে বলল, আলহামদুল্লিাহ্। দোস্ত একটি চমৎকার খবর আছে।

ইদ্রিসের কণ্ঠে স্পষ্ট আগ্রহ। বল বল শুনি।

ওই যে কথায় আছে না, মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি, অনেকটা ওরকম ব্যাপার। দেশ থেকে আমার শ্বশুরমশাই ফোন করেছেন। প্রীতি এবং তার মেয়েকে দেশে যাওয়ার জন্য এমন গোঁ ধরেছেন যে, ওদের এককথায় রাজি করিয়ে ছেড়েছেন।

ইদ্রিস আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠে বললেন, দোস্ত আমি তোকে বলিনি। এবার দেখ এটাকেই বলে ঘটনা পরম্পরা। একটা কথা আছে না- ‘ব্যর্থতা একা আসে না’- তোর এখানে উল্টো সফলতা বা আনন্দও একা আসে না- সঙ্গে আরো দল ভারী করে আনে। যাক বাবা তোর কোনো চেষ্টাচরিত্র, কসরত করতে হলো না। ঝক্কি-ঝামেলা থেকে পুরোপুরি বেঁচে গেলি। তার ওপর ছিল একটা প্রচ্ছন্ন সন্দেহ ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা। তা-ও আপনাআপনি কেটে গেল। যাক বাবা সবকিছু ভালোয় ভালোয় সেরে যাবে আশা করছি।

শফিক শতভাগ মনোযোগ দিয়ে ইদ্রিসের কথা শুধু শুনছেই-না উপভোগও করছেন। বোঝা যাচ্ছে সময় এখন তার অনুকূলে। ইউনিভার্সিটিতে ইস্তফা দেওয়ার বিষয়েও কিছু ফরমালিটি ছিল তাও এরই মধ্যে সেরে নিয়েছেন। তিনি ফুরফুরে মেজাজে বললেন, দোস্ত কালকে কখন আমাকে আসতে হবে।

তুই সকাল থেকে তৈরি থাকিস। আমি ফোন করলেই চলে আসবি। আশা করছি লাঞ্চের আগেই সেরে ফেলব। লেখালেখি কমপ্লিট করা হয়েছে। এখন শুধু অফিশিয়াল ফরমালিটিজ।

আচ্ছা ঠিক আছে। এখন রাখছি। ভালো থাকিস।

ইদ্রিস আলী হাওলাদার ধন্যবাদ বলে ফোন রেখে দিলেন।

বুধবারের সকাল। আজকের সকালটা শফিক সাহেবের কাছে একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে। এতদিনের সাধের সাজানো-গোছানো তাজ অ্যাপার্টমেন্টের এই ফ্ল্যাটটির মালিকানা চলে যাবে ইদ্রিস হাওলাদারের কাছে। ভাবতে একটু কষ্টই লাগছে। লন্ডনের ব্রিকলেনে আর কিছুক্ষণ পরে শফিক হয়ে পড়বে কপর্দকহীন এক ভিখিরি যেমন। তার বড় বেশি ভিখিরি হতে ইচ্ছে করছে। ভিখিরি হলেই তো ভালো। চলে যেতে হবে নিজের ঘরে। নিজের দেশে। আজ তার যে কষ্ট হচ্ছে- এই কষ্টেরও একটা আনন্দ আছে। আপাতত নিজেকে বিজয়ী ভাবতে ভালো লাগছে, নিজের দেশের একজন প্রথম শ্রেণির নাগরিক হিসেবে কটাক্ষের যে চাবুকের ঘা মাঝে মাঝে হজম করতে হতো তা থেকে নিষ্কৃতি পাবে- এটাও আনন্দের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি করেছে। শফিকের মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল। সকাল ৯টা ২০ মিনিট। ইদ্রিস ফোন করেছে। কানে লাগিয়ে শফিক বলল, দোস্ত বল। আমি তৈরি। এখন আসব।

ইদ্রিস বললেন, ও হ্যাঁ দোস্ত, চলে আয় বাসার নিচে এসে ফোন দে। আমি তৈরি হয়ে আছি। নাকি এক কাপ চা খাবি।

"

প্রতিদিনের সংবাদ ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন
আরও পড়ুন
  • সর্বশেষ
  • পাঠক প্রিয়
close